‘পুলিশ অভিযোগ তদন্ত কমিশন’ কেন নয়, হাই কোর্টের রুল

পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে স্বাধীন ‘পুলিশ অভিযোগ তদন্ত কমিশন’ গঠনের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না- তা জানতে চেয়েছে হাই কোর্ট।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Nov 2021, 07:38 AM
Updated : 28 Nov 2021, 07:38 AM

এক রিট আবেদনের শুনানি করে বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া এবং বিচারপতি মো. কামরুল হোসেন মোল্লার হাই কোর্ট বেঞ্চ রোববার এ রুল জারি করে।

আইন মন্ত্রণালায়ের দুই সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশ মহাপরিদর্শককে তিন সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।

‘স্বাধীন পুলিশ অভিযোগ তদন্ত কমিশন’গঠন করতে গত বছর ১০ সেপ্টেম্বর বিবাদীদের উকিল নোটিস পাঠিয়েছিলেন রিটকারীরা। তাদের সাড়া না পাওয়ায় সুপ্রিম কোর্টের শতাধিক আইনজীবীর পক্ষে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি হাই কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় এই রিট আবেদন করা হয়।

গত ২৩ নভেম্বর এ রিটের শুনানি শেষ হলে রোববার বিষয়টি আদেশের জন্য রেখেছিল হাই কোর্ট। রিটের পক্ষে শুননি করেন আইনজীবী শিশির মনির। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন।  

রিট আবেদনে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক, অবসরপ্রাপ্ত সচিব, আইনের শিক্ষক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন কমিশন গঠনের অন্তর্বর্তী আদেশ চাওয়া হলেও আদালত শুধু রুল দিয়েছে।

রিট আবেদনের সাথে ১ হাজার ৫২২ পৃষ্ঠার নথি (ডকুমেন্ট) যুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল; যেখানে আটটি যুক্তি দেখানো হয়েছিল কমিশন গঠনের পক্ষে। 

পুলিশ বাহিনী গঠনের উদ্দেশ্য, ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদান, পুলিশের গৌরবময় অর্জনের বর্ণনা তুলে ধরার পাশাপাশি পুলিশ বাহিনীর শৃঙ্খলায় বিদ্যমান আইনি কাঠামোর সীমাবদ্ধাও তুলে ধরা হয় রিটে।

সেই সাথে ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে গত বছর ডিসেম্বর পর্যন্ত ‘পুলিশ সদস্যদের মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধ ও অসদাচরণের’ ৫৮৯টি অভিযোগ তুলে ধরা হয়।

এসব ঘটনায় মোট ১৮ ধরনের ‘অপরাধ’ চিহ্নিত করা হয়, যার মধ্যে রয়েছে- বিচারবহির্ভূত হত্যা; হেফাজতে মৃত্যু; হেফাজতে নির্যাতন;  গুম, অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়; খুন, মারধর, হুমকি ও হয়রানি; ধর্ষণ, ইভটিজিং ও নারী নির্যাতন; চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই ও লুটপাট; চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, ঘুষ বাণিজ্য ও ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়; জমি দখল ও সম্পত্তি বিনষ্টকরণ; মাদক ব্যবসা ও উদ্ধারকৃত মাদক আত্মসাৎ; আটক বাণিজ্য; অপরাধীদের আশ্রয়, প্রশ্রয় ও টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়া; মামলা নিতে গড়িমসি ও মামলা তুলে নিতে চাপ প্রয়োগ; মিথ্যা ও পাল্টা মামলা দিয়ে হয়রানি; তদন্তে গাফিলতি, হয়রানি ও ঘুষ গ্রহণ; সাংবাদিক নির্যাতন; কর্তব্যে অবহেলা, সাক্ষ্য-প্রমাণ বিনষ্টকরণ ও আসামিদের নাম বাদ দেওয়া, নিয়োগ, পদায়ন ও পদোন্নতিতে দুর্নীতি।

আইনজীবী শিশির মনির সাংবাদিকদের বলেন, “এ বিষয়ে ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ‘পুলিশ অধ্যাদেশ’ নামে একটি আইনের খসড়া প্রস্তুত করেছিল। প্রস্তাবিত অধ্যাদেশের ৭১ দফায় ‘পুলিশ কমপ্লেইন্ট কমিশন’ গঠনের বিধান প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু সেই খসড়া অধ্যাদেশ আজও আইনে পরিণত হয়নি।”

এছাড়া রিটে আটটি আন্তর্জাতিক কনভেনশন ও নীতিমালা যুক্ত করা হয়েছে। এসব আন্তর্জাতিক দলিলে পুলিশের অপরাধ তদন্তে আলাদা কর্তৃপক্ষ বা কমিশন গঠনের জোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, নিউ জিল্যান্ড, ডেনমার্ক, দক্ষিণ আফ্রিকা, পাকিস্তান, কেনিয়া, ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগো, স্পেন, আয়ারল্যান্ড, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড, গ্রিস, সার্বিয়া, ক্রোয়েশিয়া, ফিনল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, হাঙ্গেরি, নরওয়ে, নেদারল্যান্ডস ও মাল্টা, ভারতসহ বিশ্বের অনেক দেশেই স্বাধীন ও স্বতন্ত্র তদন্ত কমিশন কার্যকর আছে বলে রিট আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

২০০৬ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের ‘প্রকাশ সিং বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া’ মামলায় পুলিশ ব্যবস্থার সংস্কারের জন্য যে ৭ দফা নির্দেশনা ছিল, তা এই রিট আবেদনে তুলে ধরা হয়েছে; যার মধ্যে আছে একজন বিচারপতির নেতৃত্বে ‘পুলিশ কমপ্লেইন্ট অথরিটি’ গঠনের নির্দেশনা। 

রিটে বলা হয়, ওই নির্দেশনায় ইতোমধ্যে ভারতের ২৭টি অঙ্গরাজ্যে ‘পুলিশ কমপ্লেইন্ট অথরিটি’ গঠন করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এ ধরনের স্বাধীন কমিশন বা কর্তৃপক্ষ গঠনের দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি।

ভারত ও বাংলাদেশের ১২টি মামলার নজির তুলে ধরে রিটে বলা হয়, আইনের ‘শূন্যতা ও দ্ব্যর্থতা’ নিরসনে উচ্চ আদালত প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিতে পারে।