লেজারের উপদ্রবে বিভ্রান্ত হচ্ছে পাইলটরা, তৈরি হচ্ছে ঝুঁকি

তারার আকাশে হঠাৎ তীরের মতো একযোগে এসে বিঁধতে শুরু করে সবুজ আলোর ফলা; জানালা ভেদ করে আলোর এমন বিদ্যুৎ গতির তীব্রতায় ভড়কে গিয়েছিলেন যাত্রীদের অনেকেই।

গোলাম মর্তুজা অন্তুবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Oct 2021, 06:34 PM
Updated : 26 Oct 2021, 06:34 PM

ঢাকার উপর অনেকটা নিচুতে নেমে আসা উড়োজাহাজের ফ্লাইট ক্রু তখন ঘোষণা দিচ্ছিলেন, আকাশের নীড় ছেড়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই মাটি ছুঁতে যাচ্ছে বিমান; তখন দেখা গেল এই রশ্মির বিচ্ছুরণ।

গত ২ অক্টোবর সন্ধ্যায় এমন ঘটনা দেখে খানিকটা উৎকণ্ঠা নিয়ে জানতে চাইলে একজন ক্রু বললেন, এ তো ‘রোজকার ঘটনা’।

পরে পাইলট আর উড়োজাহাজ সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সন্ধ্যার পর ঢাকার আকাশে একটু নিচুতে নেমে এলেই উড়োজাহাজে হয় এমন ‘লেজার হামলা’।

‘মজা করেই’ এমনটা করা হচ্ছে বলে তাদের ধারণা। তবে এতে যে বড় দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি করছে, সেটাও তারা বললেন।

তারা জানালেন, অত্যন্ত শক্তিশালী এই রশ্মি সরাসরি চোখে পড়লে কয়েক সেকেন্ডের জন্য ‘অন্ধের মতো’ লাগে। উড়োজাহাজ অবতরণের সময় প্রতিটি মুহূর্ত যখন গুরুত্বপূর্ণ, তখন এমন ঘটনায় হতে পারে মারাত্মক বিপদ।

এ বিষয়ে একই সঙ্গে বিরক্তি আর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অভিজ্ঞ পাইলট বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স পাইলট অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) সভাপতি মাহবুবুর রহমান।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ একটা ব্যাপার। ঢাকার আকাশে উড়োজাহাজ অবতরণের জন্য নিচে নেমে এলেই এমনটা হচ্ছে। টেকঅফের সময়ও হয়।

“তবে আমরা যখন উপরে থাকি তখন সেরকম সমস্যা হয় না। ল্যান্ডিংয়ের সময় ওই লেজারটা সরাসরি চোখে লাগলে কিন্তু আমরা সাময়িকভাবে অন্ধ হয়ে যাই, কিছুক্ষণের জন্য কিছু দেখতে পাই না।”

তুলনা করে তিনি বলেন, ওয়েল্ডিং মেশিন দিয়ে ঝালাইয়ের সময় উৎপন্ন হওয়া রশ্মির দিকে তাকালে যেমন কিছু সময়ের জন্য চোখ ধাঁধিয়ে যায়, লেজার রশ্মিটাও একই রকমভাবে করে।

বেশ কয়েকবার ‘লেজার হামলার’ শিকার এই পাইলট বলেন, “যেভাবেই হোক এটা বন্ধ করার একটা ব্যবস্থা নিতে হবে। পুলিশের সহায়তায় হোক বা জনসচেতনতা তৈরি করে হোক, বিষয়টা বন্ধ করতে হবে।

“যারা করছেন, হতে পারে তারা মজা করার জন্য করছেন। কিন্তু তারা বুঝতে পারছেন না কত বড় ঝুঁকি তারা তৈরি করছেন। ল্যান্ডিংয়ের সময় প্রত্যেকটা মুহূর্ত আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”

নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি জানালেন, সুতীব্র এই আলো দিয়ে যখন হামলাটা হয় তখন সেটা একযোগে হয়।

“বিশ্বাস করবেন না একটা মারে না কিন্তু, দুই-তিনজন দুই-তিন জায়গা থেকে একযোগে মারতে থাকে।”

লেজার কী?

‘লাইট অ্যামপ্লিফিকেশান বাই স্টিমুলেটেড এমিশন অব রেডিয়েশন’, যার সংক্ষিপ্ত রূপ হচ্ছে লেজার, এক ধরনের আলোক রশ্মি। বিশেষ উদ্দীপনায় বিকিরণ ঘটিয়ে সাধারণ আলোর ক্ষমতা ও শক্তি বহুগুণ বাড়িয়ে তৈরি করা হয় লেজার। বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের লেজার রশ্মি তৈরি করছেন। তা ব্যবহার হচ্ছে আধুনিক নানা প্রযুক্তিতে। সিডি, ডিভিডি প্লেয়ার, প্রিন্টার ইত্যাদিতে লেজার রশ্মি ব্যবহার করা হয়, ব্যবহার হয় বারকোড স্ক্যানিংয়ে। লেজার দিয়ে স্টিলের পাত কাটা যায়। চিকিৎসা ক্ষেত্রে কসমেটিক সার্জারি, ত্বকের চিকিৎসা, ক্ষতস্থান নিরাময়, দাঁত কিংবা চোখের চিকিৎসায় লেজার রশ্মির ব্যবহার হচ্ছে।

উড়োজাহাজ লক্ষ্য করে এমন লেজার আলোর ঝুঁকি নিয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেসরকারি একটি এয়ারলাইন্সের পাইলট বলেন, “যারা করছেন তারা হয়ত বুঝতেই পারছেন না, এটা কতটা বিপজ্জনক।”

তিনি বলেন, “প্রত্যেকটা এয়ারপোর্টের ল্যান্ডিংয়ের একটা চার্ট থাকে। এয়ারপোর্ট থেকে কত কিলোমিটার দূরে প্লেনকে কত ফুট উচ্চতায় রাখতে হবে এই হিসাব থাকে চার্টে। ল্যান্ডিংয়ের সময় আমাদের ওই চার্ট ফলো করতে হয়।

“এয়ারপোর্টের কন্ট্রোল টাওয়ারের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যোগাযোগ রাখতে হয়। ওই সময় লেজার হামলা যেমন মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটায়, তেমনি চোখ ধাঁধিয়ে গেলে চার্ট ও ইন্সট্রুমেন্ট দেখতেও সমস্যা হতে পারে।”

যোগাযোগ করা হলে ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের জনসংযোগ কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম জানান, তাদের উড়োজাহাজগুলোও এ ধরনের ঘটনার শিকার হচ্ছে।

তিনি বলেন, “ল্যান্ডিংয়ে আগ মুহূর্তে পাইলটের মনোসংযোগ ব্যাঘাতকারী যে কোনো ধরনের উপদ্রব মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করে। লেজার রশ্মি পাইলটকে বিভ্রান্তিতে ফেলে দিতে পারে। যেটা থেকে দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি হয়।

“আমার কাছে মনে হয়, যারা এমন করছেন তারা মজাচ্ছলেই করছেন। এটার পরিণতি কী হতে পারে, সেটা তারা ভাবছেন না বা ভাবার মতো সক্ষমতা তাদের নেই। তাদের মধ্যে সেই সচেতনতা তৈরি করতে হবে।”

এ ধরনের ঘটনা এড়াতে সাধারণ মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরি করাকেই প্রধান হাতিয়ার বলে মনে করেন এই এয়ারলাইন্স কর্মকর্তা।

আইনের দৃষ্টিতেও যে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ, তাও মনে করিয়ে দেন সংশ্লিষ্টরা।

বেসামরিক বিমান চলাচল আইন অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে অথবা বেপরোয়াভাবে এরকম কোনো কাজ করেন যাতে নির্বিঘ্নে বিমান পরিচালনায় অসুবিধা এবং মানুষের জীবন ঝুঁকির সম্মুখীন হয়, তা হলে সেটি একটি অপরাধ বলে গণ্য হবে। এজন্য মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং অনধিক পাঁচ কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে।

উড়োজাহাজের ওঠা-নামার দৃশ্য কেমন, তা কাছে থেকে দেখা যায় ঢাকার শাহ্জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ের পেছনে দলিপাড়া এলাকা থেকে, সেখানে ভিড় করেন অনেকে। ফাইল ছবি

কিছু দিন আগে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষকে দেওয়া এক সুপারিশের খবর গণমাধ্যমে এসেছে, যেখানে শাহজালার বিমানবন্দরের রানওয়ের ১৪ এবং ৩২ এর অ্যাপ্রোচ এলাকায় (উত্তরা, নিকুঞ্জ, আশুলিয়া, সাভার) বিমান ওঠা-নামার সময় লেজার রশ্মির মুখে পড়ার কথা উল্লেখ করা হয়।

আশপাশের আরও কিছু এলাকা থেকেও এমন ‘লেজার হামলা’ ঘটছে বলে পাইলটরা জানান।

যারা এমনটা ঘটাচ্ছেন, সেটা কী কারণে তা জানার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জিয়া রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে অব্যবস্থাপনা আর বিশৃঙ্খলার প্রভাবকে সামনে নিয়ে আসেন তিনি।

তিনি বলেন, “আমাদের শহরগুলো তৈরি হয়েছে। তবে মানুষের মধ্যে নাগরিক সংস্কৃতি বা নিয়ম মানার সংস্কৃতি তৈরি হয়নি। কেউ একজন যে যা ইচ্ছা তা করতে পারে না, এই বোধটা অনেকেরই তৈরি হয়নি।”

এর পেছনে ‘অরাজকতা’ আছে কি না, খতিয়ে দেখার তাগিদও দেন জিয়া রহমান।

“একই সময়ে এটা ভাবার সময়ও এসেছে সংঘবদ্ধ কোনো চক্র এ ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে কি না। এর মধ্যে কোন ধরনের এনার্কিজম কাজ করছে কি না। নাশকতা বা নেগেটিভ মোটিভ নিয়ে কেউ এই কাজ করছে কি না, সেটাও খতিয়ে দেখার দরকার আছে।”