বিচারক ছুটিতে, এস কে সিনহার রায় পেছাল

বিচারক ছুটিতে থাকায় সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাসহ ১১ আসামির বিরুদ্ধে ফারমার্স ব্যাংকের (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) ঋণের টাকা আত্মসাতের মামলার রায় পিছিয়ে গেছে।

আদালত প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Oct 2021, 06:01 AM
Updated : 5 Oct 2021, 06:01 AM

মঙ্গলবারঢাকার ৪ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারকশেখ নাজমুল আলমের এই রায় ঘোষণার কথা ছিল। তিনিনা থাকায় এ আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারকআলী হোসেন রায় পিছিয়ে ২১ অক্টোবর নতুন দিন ধার্য করেছেন।

এরআগে ১৪ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রও আসামি পক্ষের যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে বিচারক রায় ঘোষণার জন্য ৫ অক্টোবর তারিখ রেখেছিলেন।

আসামিদের পক্ষে যুকিতর্ক শুনানি করেন আইনজীবী বোরহান উদ্দিন, শাহীনুর ইসলাম অনিসহ কয়েকজন। তারা বিচারের মুখোমুখি হওয়া সাত আসামির খালাস চান।

আর রাষ্ট্রপক্ষে দুদকের আইনজীবী মীর আহমেদ আলী সালাম আসামিদের সর্বোচ্চ সাজার আবেদন করেন।

দণ্ডবিধি, দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ও মানি লন্ডারিংপ্রতিরোধ আইনের যেসব ধারায় এ মামলার অভিযোগগঠন করা হয়েছে, তাতে অপরাধ প্রমাণিত হলে আসামিদের সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন শাস্তি হতে পারে।

মৃত্যুদণ্ডের কোনো ধারা না থাকায় এসকে সিনহাসহ পলাতক আসামিদের পক্ষে কোনো আইনজীবীকে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি।

এর আগে গত ২৯ অগাস্টআদালতে আত্মপক্ষ সমর্থনে নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন বিচারের মুখোমুখি হওয়া সাত আসামি। তারা আদালতের কাছে ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করেন।

এই সাতজন হলেন- ফারমার্স ব্যাংক লিমিটেডের (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) অডিট কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মো. মাহবুবুল হক চিশতী (বাবুলচিশতী), ফারমার্স ব্যাংকের সাবেক এমডি এ কে এমশামীম, ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট স্বপন কুমার রায়, ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. লুৎফুল হক, সাবেক এসইভিপি গাজী সালাহউদ্দিন, টাঙ্গাইলের মো. শাহজাহান ও একই এলাকারনিরঞ্জন চন্দ্র সাহা। তাদের মধ্যে বাবুল চিশতী কারাগারে আছেন, বাকিরা জামিনে।

সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা,ফারমার্স ব্যাংকের সাবেক ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট সাফিউদ্দিন আসকারী, টাঙ্গাইলের বাসিন্দা রনজিৎ চন্দ্র সাহা ও তার স্ত্রীসান্ত্রী রায়কে পলাতক দেখিয়ে এ মামলার বিচারচলে।

গতবছর ১৩ অগাস্ট এই১১ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর নির্দেশ দিয়েছিলেন ঢাকার ৪ নম্বর বিশেষজজ আদালতের বিচারক শেখ নাজমুল আলম।

মামলা বৃত্তান্ত

নানা নাটকীয় ঘটনার মধ্যে বিচারপতি সিনহা তিন বছর আগে বিদেশে পাড়ি জমানোর পর দুদক অভিযোগপায়, তিনি ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে ব্যবসায়ী পরিচয়ে দুই ব্যক্তির নেওয়া ঋণের চার কোটি টাকা নিজের অ্যাকাউন্টে নিয়েছিলেন।

অভিযোগ পেয়ে ওই বছরই তদন্তেনামে দুদক। দীর্ঘ তদন্তে পর ২০১৯ সালের১০ জুলাই সিনহাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধেমামলা করেন দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন।

মামলার বিবরণে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর আসামিশাহজাহান ও নিরঞ্জন চন্দ্রফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখায় আলাদা দুইটি অ্যাকাউন্ট খোলেন। ব্যবসা বাড়ানোর জন্য পরদিন তারা ওই ব্যাংক থেকেদুই কোটি টাকা করে মোট চার কোটি টাকা ঋণের আবেদন করেন।

তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং ঋণের আবেদনে উত্তরার ১০ নম্বর সেক্টরের১২ নম্বর রোডের ৫১ নম্বর বাড়িরঠিকানা ব্যবহার করা হয়, যার মালিক ছিলেন তখনকার প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা।

ঋণের জামানত হিসেবে আসামি রনজিৎ চন্দ্রের স্ত্রী সান্ত্রী রায়ের নামে সাভারের ৩২ শতাংশ জমিরকথা উল্লেখ করা হয় ঋণের আবেদনে।ওই দম্পতি এস কে সিনহারপূর্ব পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ বলেউল্লেখ করা হয়েছে মামলার এজাহারে।

দুদক বলছে, ব্যাংকটির তৎকালীন এমডি এ কে এমশামীম কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই, ব্যাংকের নিয়ম-নীতি না মেনে, ক্ষমতারঅপব্যবহার করে ঋণ দুটি অনুমোদনকরেন।

মামলার এজাহারে বলা হয়, ৭ নভেম্বর ঋণেরআবেদন হওয়ার পর 'অস্বাভাবিক দ্রুততার' সঙ্গে তা অনুমোদন করাহয়। পরদিন মোট চার কোটি টাকার দুটি পে-অর্ডার ইস্যুকরা হয় এস কেসিনহার নামে। ৯ নভেম্বর সোনালীব্যাংকের সুপ্রিম কোর্ট শাখায় এস কে সিনহারঅ্যাকাউন্টে জমা হয়।

পরে বিভিন্ন সময়ে ক্যাশ, চেক ও পে-অর্ডারেরমাধ্যমে ওই টাকা উত্তোলনকরা হয়। এর মধ্যে এসকে সিনহার ভাইয়ের নামে শাহজালাল ব্যাংকের উত্তরা শাখার অ্যাকাউন্টে দুটি চেকে দুই কোটি ২৩ লাখ ৫৯হাজার টাকা স্থানান্তর করা হয় ওই বছরের২৮ নভেম্বর।

এজাহারে বলা হয়, “আসামি রনজিৎ চন্দ্র ঋণ দ্রুত অনুমোদনেরজন্য প্রধান বিচারপতির প্রভাব ব্যবহার করেন। রনজিৎ চন্দ্রের ভাতিজা হলেন ঋণ গ্রহীতা নিরঞ্জনএবং অপর ঋণ গ্রহীতা শাহজাহানও রনজিৎ ছোটবেলার বন্ধু। ঋণ গ্রহীতা দুইজনইঅত্যন্ত গরিব ও দুস্থ। তারাকখনও ব্যবসা-বাণিজ্য করেননি।”

পাঁচ মাসের তদন্ত শেষে দুদক কর্মকর্তা বেনজীর আহমেদ ২০১৯ সালের ৯ ডিসেম্বর ১১জনকে আসামি করে এ মামলার অভিযোগপত্রদেন। তদন্ত কর্মকর্তার আবেদনে এস কে সিনহারব্যাংক হিসাবের চার কোটি টাকা জব্দ করা হয়।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে অসৎ উদ্দেশ্যে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ফারমার্স ব্যাংকে ভুয়া ঋণ সৃষ্টি করেসেই টাকা বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর, উত্তোলন ও পাচার করেছেন,যা দণ্ডবিধির ৪০৯/৪২০/১০৯ ধারা, ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারাএবং ২০১২ সালের মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ৪(২)(৩)ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

দুদকের করা এই মামলার এজাহারেবাবুল চিশতীর নাম না থাকলেও অভিযোগপত্রেতাকে নতুন করে আসামি করা হয়। আর এজাহারে ফারমার্সব্যাংকের গুলশান শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক মো. জিয়া উদ্দিন আহমেদকে আসামি করা হলেও অভিযোগপত্রে মামলার দায় থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করেন তদন্ত কর্মকর্তা।

সেই অভিযোগপত্র আমলে নিয়ে ঢাকার ৪ নম্বর বিশেষজজ আদালত ২০২০ সালের ১৩ অগাস্ট সাবেকপ্রধান বিচারপতি সিনহাসহ ১১ আসামির বিরুদ্ধেঅভিযোগ গঠন করেন।

বাংলাদেশের ইতিহাসে সিনহাই প্রথম সাবেক প্রধান বিচারপতি, যিনি দুর্নীতিতে অভিযুক্ত হয়েছেন।

এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে মোট ২১ জন সাক্ষীরসবার সাক্ষ্য শুনেছে আদালত, তাদের মধ্যে এস কে সিনহারআপন বড় ভাই নরেন্দ্রকুমার সিনহা এবং মামাতো ভাইয়ের ছেলে শঙ্খজিৎ সিনহাও রয়েছেন।

তারা দুজনেই বলেছেন, ‘এস কে সিনহারকথাতেই’ তাদের নামে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের উত্তরা শাখায় হিসাব খোলা হয়েছে। পরে সেই হিসেবে সোয়া দুই কোটি টাকা স্থানান্তরের বিষয়ে তারা ‘জানতেন না’।

গত ২৪ আগস্ট আলোচিতএ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের পরিচালক বেনজীর আহমেদকে জেরা করেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। ওইদিন তার জেরা শেষ হওয়ায় আদালত আসামিপক্ষের আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য ২৯ আগস্ট দিনধার্য করেন।

এরপর দুই পক্ষের যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে মামলাটি রায়ের পর্যায়ে আসে।