এইচ বি এম ইকবাল: এক যুগ আগের রায়ের খবর নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরকে উকিল নোটিস

ডা. এইচ বি এম ইকবাল এবং তার পরিবারের বিরুদ্ধে হওয়া মামলায় আদালতের আদেশ নিয়ে গত এক যুগে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনের জন্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে উকিল নোটিস পাঠানো হয়েছে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Feb 2021, 04:57 PM
Updated : 2 Feb 2021, 06:20 PM

২০০৭, ২০০৮, ২০১০, ২০১৫ ও ২০১৭ সালের ওইসব প্রতিবেদনের জন্য ডা. ইকবালের পক্ষে ওই নোটিস পাঠিয়েছেন কাজী নাসির উদ্দিন বাবুল নামে এক ব্যক্তি, যিনি নিজেকে ডা. ইকবালের ‘বন্ধু’ হিসাবে পরিচয় দিয়েছেন।

আর নাসির উদ্দিন বাবুলের পক্ষে ওই নোটিসটি পাঠিয়েছেন বরিশালের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আতিকুর রহমান জুয়েল।

সেসব মামলার কার্যক্রম এবং আদালতের আদেশ নিয়ে বাংলাদেশের অন্যসব সংবাদমাধ্যমের মত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম যেসব সংবাদ প্রকাশ করেছিল, সেগুলো ‘মিথ্যা ও ভিত্তিহীন’ দাবি করে ‘নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা’ করতে বলা হয়েছে নোটিসে।

আর তা না করলে ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করারও হুমকি দেওয়া হয়েছে সেখানে।

প্রিমিয়ার ব্যাংকের চেয়ারম্যান এইচ বি এম ইকবাল বাংলাদেশের একজন সাবেক সংসদ সদস্য, যার মালিকানায় রয়েছে বেশ কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।

প্রিমিয়ার গ্রুপ অব কোম্পানিজের চেয়ারম্যান ইকবাল প্রিমিয়ার হোটেল ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি, বেঙ্গল টাইগার সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ, প্রিমিয়ার টেকনোলজি অ্যান্ড হোল্ডিংস, অ্যারো বেঙ্গল সেন্টার, অ্যাটাব সেন্টার, বুখারা রেস্টুরেন্ট, বনানী ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস, প্রিমিয়ার টেলি লিংক লিমিটেডেরও চেয়ারম্যান।

যা আছে নোটিসে

বরিশাল থেকে পাঠানো উকিল নোটিসে বলা হয়েছে, “বিগত ইংরেজি ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১০ তারিখ আপনাদের দ্বারা পরিচালিত অনলাইন নিউজ পোর্টাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে ডা. এইচ বি এম ইকবালকে নিয়ে একাধিক সংবাদ পরিবেশন করা হইয়াছে, যাহা সম্পূর্ণ মিথ্যা কাল্পনিক ও বানোয়াট বটে।”

সেসব সংবাদ ‘সম্পূর্ণ অসত্য’ দাবি করে নোটিসে বলা হয়, “আমার মোয়াক্কেল ডা. এইচ বি এম ইকবাল কোনো প্রকার দুর্নীতির এবং কোনো প্রকার অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেকে জড়িত রাখেনি এবং জড়িত থাকার তথ্য সম্পূর্ণ অযৌক্তিক বটে।”

ডা. ইকবালের পক্ষে ওই আইনজীবী বলছেন, “উক্ত মিথ্যা সংবাদ আপনি নোটিস গ্রহীতাগণ ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করিয়া বিভিন্ন ফেইসবুকে শেয়ার এবং বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় শেয়ার করেন। ফলে দেশে এবং বিদেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ দেখিতে পাইয়া আমার মোয়াক্কেলের চরিত্র হীন হয়েছে। যাহা শত কোটি টাকার দ্বারাও পরিমাপ করাও সম্ভব নহে।”

ওইসব সংবাদের কারণে ডা. ইকবাল ‘মানসিক ও সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন’ হয়েছেন দাবি করে নোটিসে বলা হয়, “যাহা আমাদের দেশে প্রচলিত আইনের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপরাধ সংঘটিত হইয়াছে বটে।

“আমার বিশ্বাস, আপনারা সংবাদ পরিবেশনায় আমার মোয়াক্কেলের প্রতিপক্ষ দ্বারা অবৈধভাবে প্রভাবিত হইয়াছেন। আপনাদের সদয় অবগতির জন্য আরও জানানো যাইতেছে যে, আমার মোয়াক্কেল হলফ করিয়া বলিতে পারে যে, তাহার বিরুদ্ধে সঠিক দুর্নীতির কোনো অভিযোগ নাই।”

ডা. ইকবালের দুই ছেলে মঈন ইকবাল ও ইমরান ইকবাল এবং মেয়ে নওরীন ইকবাল ও স্ত্রী মমতাজ বেগমের বিরুদ্ধে দুদকের এক মামলার বিচারিক কার্যক্রমের ভিত্তিতে ২০০৭, ২০০৮, ২০১৫ ও ২০১৭ সালের বিভিন্ন তারিখে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদনও ’মিথ্যা’ বলে দাবি করা হয়েছে ওই নোটিসে।

সেসব সংবাদ যে ‘বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়’ প্রকাশিত হয়েছে, সে কথা উল্লেখ করা হলেও নোটিসে আবার অভিযোগ করা হয়েছে, “উক্ত মিথ্যা সংবাদ পরিবেশনে একমাত্র উদ্দেশ্যেই হল নোটিশ দাতার বন্ধু ডা. এইচ বি এম ইকবাল এবং তাহার পরিবারের সম্মান হানী করা।”

আদালতের আদেশ নিয়ে করা ওইসব সংবাদ প্রতিবেদনের কারণে ডা. ইকবাল ‘সামাজিক, রাজনৈতিক এবং আর্থিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন’ হয়েছে দাবি করে নোটিসে বলা হয়েছে, “কোনোরূপ তথ্য উপাত্ত এবং দালিলিক সাক্ষ্য প্রমাণাদি ব্যাতিরেকে কোনো মানহানিকর সংবাদ পরিবেশন প্রচলিত আইনে দণ্ডনীয় বটে।”

নোটিসের শেষাংশে বলা হয়, “অতএব আপনাদের বিরুদ্ধে কেন আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে না অত্র নোটিস প্রাপ্তির ১৫ দিনের মধ্যে আমার বরাবরে কারণ দর্শাইবেন এবং আপনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের মাধ্যমে মিথ্যা, ভিত্তিহীন বলে আমার মোয়াক্কেল বরাবর নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করিবেন।

“অন্যথায় আপনাদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে আমার মোয়াক্কেল বাধ্য হইবেন।”

প্রতিবেদনে যা ছিল

ওই উকিল নোটিসের সঙ্গে নমুনা হিসেবে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ইংরেজি সংস্করণে প্রকাশিত ২০১০ ও ২০১৭ সালের দুটি প্রতিবেদনের অনুলিপি পাঠিয়েছেন আইনজীবী অ্যাডভোকেট আতিকুর রহমান জুয়েল।

এর মধ্যে একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ‘AL leaders relieved from 2001 murder case’

২০০১ সালে মালিবাগ মোড়ে হরতালের মধ্যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কর্মীরা মিছিল নিয়ে মুখোমুখি হলে গুলিতে বিএনপির চার কর্মী নিহত হয়।

ওই ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় ২০১০ সালের ২৬ অগাস্ট আওয়ামী লীগ নেতা এইচবিএম ইকবাল ও নুরুন্নবী চৌধুরী শাওনসহ ১৪ আসামিকে খালাস দেয় আদালত।

মামলাটিকে ‘রাজনৈতিক হয়রানিমূলক’ বিবেচনায় তা প্রত্যাহারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইন শাখার সুপারিশের পরিপ্রক্ষিতে ঢাকার ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল ওই রায় দেয়।

সেই রায়ের খবর নিয়েই বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম সেদিন ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যা অন্য সব গণমাধ্যমও করেছিল। 

 দ্বিতীয় যে প্রতিবেদনটির অনুলিপি উকিল নোটিসের সঙ্গে পাঠানো হয়েছে, তার শিরোনাম- ‘Ex-MP Iqbal's wife, three children appeal against conviction in ACC case’

বিগত সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ‘অবৈধ সম্পদ অর্জনের’ মামলায় ইকবালকে ১৩ বছরের দণ্ড দিয়েছিল আদালত। পরে ওই মামলায় ২০১১ সালের ১৮ জানুয়ারি হাই কোর্ট থেকে তিনি খালাস পান।

একই মামলায় ‘অবৈধ সম্পদ অর্জনে সহযোগিতার’ অভিযোগে ইকবালের স্ত্রী মমতাজ বেগম, দুই ছেলে মোহাম্মদ ইমরান ইকবাল ও মঈন ইকবাল এবং মেয়ে নওরীন ইকবালকে তিন বছর করে কারাদণ্ড এবং এক লাখ টাকা করে অর্থদণ্ড দিয়েছিল ঢাকার বিশেষ জজ আদালত।

সেই রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালের ৯ মার্চ হাই কোর্টে আপিল করেন তারা। সেই খবরই প্রকাশ করা হয়েছে সেদিন প্রকাশিত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ওই প্রতিবেদনে, যা অন্য সব সংবাদমাধ্যমেও এসেছে।

এসব প্রতিবেদনের কোন অংশ ‘মিথ্যা, ভিত্তিহীন, কাল্পনিক বা বানোয়াট’- সে বিষয়ে কিছু বলা হয়নি উকিল নোটিসে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের নিজস্ব কোনো অনুসন্ধান এসব প্রতিবেদনে নেই; সম্পূর্ণভাবে মামলার কার্যক্রম ও আদালতের আদেশই সেখানে বস্তুনিষ্ঠভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তাহলে এসব প্রতিবেদনে কীভাবে ‘উদ্দেশ্যমূলক সম্মানহানী’ ঘটানো হল, তাও বলেননি নোটিসদাতা।

তাছাড়া দেশের মূল ধারার সব সংবাদমাধ্যমই এসব খবর প্রকাশ করেছে সে সময়। সে কথা নোটিসে স্বীকারও করা হয়েছে। তাহলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের বিরুদ্ধে কেন ‘প্রতিপক্ষ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে’ সংবাদ প্রকাশের অভিযোগ আনা হচ্ছে, নোটিসে সে বিষয়টিও স্পষ্ট নয়।

তারা যা বললেন

এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আইনজীবী আতিকুর রহমান জুয়েলের সঙ্গে কথা বলেছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।

নোটিসদাতা কাজী নাসির উদ্দিন বাবুলের পরিচয় জানতে চাইলে আইনজীবী জুয়েল বলেন, “তিনি বরিশালের একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, আজকের বার্তা পত্রিকার মালিক ও সম্পাদক।

”উনার বক্তব্য হল, এই যে নিউজ ছাপা হয়েছে, তার মাধ্যমে ইকবাল সাহেবের মানহানি হয়েছে এবং বাবুল মনে করতেছেন তার প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের নিউজের কারণে তারও মানহানি হইছে।”

প্রতিবেদনগুলো পড়েছেন কি-না, জানতে চাইলে এই আইনজীবী বলেন, “আমার কাছে রিপোর্টগুলো আছে, রিপোর্টের স্ক্রিনশটগুলো আছে।

“ইকবাল সাহেবের পক্ষে কাজী নাসির উদ্দিন বাবুল বলতেছেন, এসব নিউজের কারণে তাদের ক্ষতি হইছে, তাদের মানহানি হইছে। তারাতো এই মামলা দিয়ে খালাস পাইছে। এ কারণে আমি তার পক্ষ হয়ে করেছি।”

আদালতের কার্যক্রমের ভিত্তিতে করা প্রতিবেদন নিয়ে কেন অভিযোগ করা হচ্ছে প্রশ্ন করলে এই আইনজীবী বলেন, “যদি আপনার ল’ইয়ার থাকে, তাইলে আপনি এগুলার জবাব দিবেন।”

২০০৭-২০০৮ সালের প্রতিবেদনের জন্য এতদিন পর উকিল নোটিস কেন- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “ফৌজদারি মামলায় কোনো টাইম-বাউন্ড নাই। তবে কোর্ট সিদ্ধান্ত নেবে এই মামলাগুলো চলমান হবে কি, হবে না। আমরা মামলা করতে পারব।”

সব মামলায় ডা. ইকবাল ২০১৯ সালের মধ্যে খালাস পেয়েছেন জানিয়ে আইজীবী জুয়েল বলেন, “পরে সে নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছে। এখন মনে করতেছে, তার প্রতিকার চাইবে।”

দেশের মূলধারার সব গণমাধ্যমে যেহেতু ওইসব মামলা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, সবাইকে উকিল নোটিস পাঠানো হয়েছে কি-না জানতে চাইলে জুয়েল বলেন, “হয়ত করবে। অন্যান্য জায়গায় যেগুলো হয়েছে করবে। অন্যগুলো এখন হয়েছে কি-না ইনফর্ম করতে পারব না।”

রিপোর্টগুলোতে মিথ্যা বা বানোয়াট কী ছিল- এই প্রশ্নে এই আইনজীবী বলেন, “সেটা হল পরের বিষয়। যখন মামলা করমু বা কোর্টের প্রসিডিংসে যাবে, তখন দেখব। সেটা মামলার সময় বলব, এখন বলব না।”

তার যুক্তি, “যেহেতু উচ্চ আদালত তাকে খালাস দিয়েছে, অবশ্যই রিপোর্ট মিথ্যা ছিল।”

একজন ‘বন্ধুর’ মাধ্যমে ওই উকিল নোটিস পাঠানোর বিষয়ে কথা বলতে ডা. ইকবালের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।

তিনি বলেন, “আমাকে বলছে যে, ‘কেন আপনার নামে এই রকম করবে, আমরাতো এটা নিয়ে চিন্তিত’। আমি বলেছি, আপনারা যা ভালো মনে করেন, করেন।

“ওরা আসছিল, এসব ব্যাপারগুলো দেখে ওরা কনসার্নড আর কি। আমার লোক না হলে আমার প্রতি সহমর্মিতা থাকবে কেন?”

প্রকাশিত প্রতিবেদন নিয়ে প্রশ্ন করলে সাবেক এই সাংসদ বলেন, “আমাদের ওয়ান-ইলেভেনের কেইস আজকে ১২ বছর হয়ে গেছে। এগুলো হাই কোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট থেকে কোয়াশ-আউট করে দিছে, আপনারা লোয়ার কোর্টের এটা সারা পৃথিবীতে জানায় রাখতেছেন।”