নতুন ঠিকানায় জীবনটাও ‘নতুন করে বুনতে চান’ তারা

নিজেদের কোনো দোষ না থাকলেও শুধু জন্মগত ভিন্নতার কারণে পরিবার-সমাজ বিচ্যুত হয়ে মানুষের কাছে হাত পেতে যে জীবন চলছিল, তা বদলে গেল মুজিববর্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহারে।

গোলাম মুজতবা ধ্রুববিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Jan 2021, 08:26 PM
Updated : 29 Jan 2021, 09:11 PM

ভূমিহীন-গৃহহীন, অসহায়-অস্বচ্ছলদের পুনর্বাসনে সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে, তারই উপকারভোগী হয়েছেন সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার তৃতীয় লিঙ্গের ৫০ জন মানুষ।

পাকা ঘরে বসবাসের সঙ্গে জীবিকার জন্য সেলাই মেশিন চালানোর পাশাপাশি গরু পালন ও সবজি চাষের মতো কাজে যুক্ত হয়ে তারা এখন বলছেন, হাত পেতে চলার সেই দিন তাদের ফুরোচ্ছে। বঞ্চনার জীবন থেকে সমাজের অন্যদের মতো সম্মান নিয়ে চলার দিন এসে গেছে। 

পরিবার-সমাজ বিচ্যুত হয়ে যে বঞ্চনার জীবন এতদিন বইতে হয়েছে, তার অবসান এবার ঘটেছে বলে জানিয়েছেন পরীমনি।

এই উপকারভোগীদের একজন পরীমনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আজীবন ভেবেছি অন্য দশটা মানুষের মতো আমার জীবনটা এক নয় কেন? পথে পথে ঘুরে মানুষের থেকে ভিক্ষা করে সারাটা জীবন কেটেছে। নিজের কোনো ঠিকানা ছিল না।

“এখন প্রধানমন্ত্রী মাথা গোজার ঠাঁই করে দিয়েছেন। নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়েছেন। এজন্য তার প্রতি মন থেকেই কৃতজ্ঞতা জানাই।”

উল্লাপাড়া উপজেলায় হাটিকুমরুল আশ্রয়ন প্রকল্পে ০.৬৬ একর জমিতে চারটি পাঁচ ইউনিটের সেমি পাকা ব্যারাকে পরীমনির মতো আরও ৪৯ জন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ আছেন মিলেমিশে।

শৈশব থেকে নিজেদের পরিবারের থেকে দূরে থাকা এই মানুষগুলোর আপন বলতে কেউ নেই। অবহেলিত এই মানুষগুলোকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে সরকারি খরচে ঘর করে দেওয়ার পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে লালন-পালনের জন্য তাদের গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগির পাশাপাশি কবুতর দেওয়া হয়েছে। ব্যারাকের বাসিন্দারা সেগুলো পালনের স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। পাশাপাশি নিজেদের চাহিদা মেটাতে সবজি চাষও করছেন কেউ কেউ। 

পরীমনি বলেন, “ছোটবেলায় সমাজের লোকেরা আমাকে নিয়ে বাবা-মাকে অনেক বাজে কথা বলত। এক সময় আমি নিজেই বাধ্য হয়ে ঘর ছেড়ে দেই। একজন গুরু মায়ের সাথে পরিচয়ের পর তার আশ্রয়েই থেকেছি, বড় হয়েছি।”

ব্যারাকের আরেক বাসিন্দা ৪০ বছর বয়সী জুঁই বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নিজেদের কোনো ঘর-বাড়ি ছিল না বলে সমাজে এতদিন আমাদের কোনো সম্মান ছিল না। আমাদের সাথে কেউ মিশতে চাইত না। আমাদের নিয়ে হাসি-তামাশা করত। অথচ এখন আমাদের নিয়ে অনেক মানুষেরই দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে। এজন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই।”

যে হাত এতদিন অন্যের অনুগ্রহ কুড়াত, সেই হাতে এখন চলছে সেলাই মেশিন।

ব্যারাকের একটি ঘরে কাপড় সেলাইয়ে ব্যস্ত বাহামনি (৩৫) বলেন, “আমাদের জীবনটাও আমরা নতুন করে বুনতে চাই। নতুন ঘর পেয়েছি, এখন নতুন করে জীবন গড়তে চাই।”

২৮ বছর বয়সী সখী বলেন, “আমরা আর কখনও মানুষের কাছে হাত পেতে বাঁচতে চাই না। এখন যেখানে আছি সেখানে ১০টা গরু রয়েছে। চারটি গরুর প্রতিটি থেকে প্রতিদিন ২৫ লিটার করে দুধ আসে। সেগুলো হাটে নিলে কিছু পয়সা আসে। কিন্তু এটা যথেষ্ট না। আমাদের আরও সহযোগিতা দরকার। নিজেরা পরিশ্রম করে আয় করতে চাই।”

সবজি চাষে জীবন চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় আছে সখী।

সহায়-সম্বলহীনদের জীবন বদলে দেওয়ার উদ্যোগ আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় সারা দেশে নির্মিত ৬৬ হাজার ১৮৯টি বাড়ি ভূমিহীন-গৃহহীনদের মাঝে গত শনিবার হস্তান্তর করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এসব পরিবারকে ২ শতাংশ খাস জমির মালিকানা দিয়ে সেখানে আধা পাকা ঘর করে দেওয়া হয়েছে।

একই দিনে ২১টি জেলার ৩৬টি উপজেলায় ৭৪৩টি ব্যারাকে ৩ হাজার ৭১৫টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। এই ব্যারাকগুলোর একটি পেয়েছেন উল্লাপাড়ার তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা। ব্যারাকের ২০ কক্ষের মালিকানা ওই দিন তৃতীয় লিঙ্গের ২০ জনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। সেখানে নিজেদের মতো করে ৫০ জন বসবাস করছেন। 

এর পাশাপাশি দিনাজপুর জেলার সদর উপজেলার বাঙ্গি বেচা ব্রিজ সংলগ্ন পল্লীতেও আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় তৃতীয় লিঙ্গের ১২৫ জনকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। নতুন ঘরের পাশাপাশি জীবিকার উপায় পেয়েছেন তারাও।

আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন নোয়াখালী জেলার চরপোড়াগাছা গ্রাম পরিদর্শনে যান এবং ভূমিহীন-গৃহহীন অসহায় মানুষের পুনর্বাসনের নির্দেশ দেন। জাতির পিতাকে ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার পর ভূমিহীন-গৃহহীন ছিন্নমূল মানুষের পুনর্বাসন কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে যায়। 

পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সরকার গঠন করলে ১৯৯৭ সালের ২০ মে ঘূর্ণিঝড়ে আক্রান্ত কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলার সেন্টমার্টিন পরিদর্শন করেন এবং ঘূর্ণিঝড় আক্রান্ত ভূমিহীন-গৃহহীন মানুষের পুনর্বাসনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দেন।

পরবর্তীতে ভূমিহীন-গৃহহীন ছিন্নমূল মানুষের পুনর্বাসনে ১৯৯৭ সালে ‘আশ্রয়ণ’ নামে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়, যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়।

এই প্রকল্পের আওতায় ১৯৯৭ সাল থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ৩ লাখ ২০ হাজার ৫২টি ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়।

১০টি গরু পালছেন উল্লাপাড়ার ব্যারাকে স্থান পাওয়া তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা, চারটি গরুর প্রতিটি থেকে প্রতিদিন ২৫ লিটার করে দুধ আসে বলে জানালেন সোনিয়া।

এবার মুজিববর্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দেন, বাংলাদেশে একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না। তার এই ঘোষণা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ‘মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে দেশের সকল ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য গৃহ প্রদান নীতিমালা ২০২০’ প্রণয়ন করা হয়।

এ লক্ষ্যে গত বছর জুনে সারা দেশে ভূমিহীন ও গৃহহীন ৮ লাখ ৮৫ হাজার ৬২২টি পরিবারের তালিকা করা হয়। আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় তাদের জীবন বদলের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

তারই অংশ হিসেবে শনিবার ৬৬ হাজারের বেশি পরিবারকে নতুন ঘর দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারই ২০১৪ সালের ২৬ জানুয়ারি ‘হিজরা’ সম্প্রদায়কে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। বর্তমানে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তালিকা অনুযায়ী, বাংলাদেশে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের সংখ্যা ১১ হাজার, যাদের সবাইকে পর্যায়ক্রমে পুনর্বাসন করার কথা ভাবছে সরকার।