টিকা: আপাতত শুধু ওয়েবসাইটে সীমিত নিবন্ধনের সুযোগ

করোনাভাইরাসের টিকাদান কার্যক্রম উদ্বোধনের দিনই নিবন্ধনের অ্যাপ ও ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন উন্মুক্ত করার চিন্তা থাকলেও আপাতত কেবল ওয়েবসাইট থেকেই রেজিস্ট্রেশন করা যাচ্ছে; আর ব্যবস্থাপনার সুবিধার জন্য সেই সুযোগও সীমিত রাখা হয়েছে।

ওবায়দুর মাসুমশামীম আহমেদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Jan 2021, 05:32 PM
Updated : 29 Jan 2021, 05:32 PM

সুরক্ষা প্ল্যাটফর্মের ওয়েব অ্যাপ্লিকেশনে (www.surokkha.gov.bd) যেসব ক্যাটাগরিতে নিবন্ধনের সুযোগ রাখা হয়েছে, তার সবগুলো এখনও উন্মুক্ত করা হয়নি। আর মোবাইল অ্যাপ চালুর বিষয়ে সরকারের মন্ত্রী ও কর্মকর্তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন রকম বক্তব্য পাওয়া গেছে।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, এখন ওয়েব অ্যাপ্লিকেশনে নিবন্ধনের কাজটি করা যাচ্ছে। তবে নিবন্ধনের জন্য কোনো মোবাইল অ্যাপ এখনও উম্মুক্ত করা হয়নি।

“স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে ওয়েব অ্যাপ্লিকেশনে নিবন্ধনের জন্য প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছিল আমরা সেইভাবে প্রস্তুতি নিয়েছি এবং কাজ করেছি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যদি মোবাইল অ্যাপের বিষয়ে আগ্রহ দেখায়, তাহলে আমরা অ্যাপ চালু করার প্রস্ততি নেব।”

ওয়েব অ্যাপ্লিকেশনটির মোবাইল ভার্সন থাকায় ‘সহজেই’ সেটি ব্যবহার করা যাচ্ছে জানিয়ে পলক বলেন, “নিবন্ধন শুরু হওয়ার পর শুক্রবার সকাল পর্যন্ত প্রায় ৩ হাজার নিবন্ধন সম্পন্ন হয়েছে, যারা নির্ভুলভাবে তথ্য দিচ্ছেন, তাদের সবারই নিবন্ধন সঠিকভাবে হচ্ছে।”

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে মোবাইল অ্যাপের ব্যাপারে আগ্রহ দেখানো হয়েছিল কি না জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যদি অ্যাপ রেডি থাকে তাহলে ওয়েবে পাবে, মোবাইল অ্যাপে পাবে না এটা তো একটু ক্ল্যারিফিকেশন দরকার। এটা তো একসঙ্গেই হওয়ার কথা।

“এ বিষয়টি উনারাই (আইসিটি মন্ত্রণালয়) কন্ট্রোল করে। আইসিটি মিনিস্ট্রি অ্যাপ বানিয়েছে এবং এতে যা যা প্রয়োজন তারাই করে দেবে। আমাদের শুধু বলা যে শুরু করে দেন। এতদিনে তো শুরু হয়ে যাওয়ার কথা।”

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২৭ জানুয়ারি ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে করোনাভাইরাসের টিকাদান কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন।

তার আগে ২৫ জানুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিমন্ত্রী পলক বলেছিলেন, টিকা কার্যক্রম উদ্বোধনের দিনই নিবন্ধনের ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন ও মোবাইল অ্যাপ উন্মুক্ত করার প্রস্তাব করবেন তিনি।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরের প্রোগ্রামারদের ব্যবস্থাপনায় তৈরি কোভিড-১৯ ভ্যাক্সিন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম ‘সুরক্ষা’ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে হস্তান্তর উপলক্ষে ওই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল।

পলক সেদিন বলেছিলেন, “আমরা সাথে সাথে মোবাইল অ্যাপও তৈরি করে রাখছি। যদি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কিংবা প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর আমাদের নির্দেশ দেয়, তাহলে আমরা এটা উন্মুক্ত করে দেব।”

অ্যাপের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আপাতত আইফোন অ্যাপ ব্যবহার করা যাবে না। কিন্তু অন্যান্য স্মার্টফোন থেকে এটা হওয়ার কথা। আমাদের তাই বলা হয়েছিল। কিন্তু এখন কেন হচ্ছে না সেটা নিয়ে কথা বলে দেখি।”

নিবন্ধন করতে পারছেন কারা

সুরক্ষা ওয়েব অ্যাপ্লিকেশনে প্রাথমিকভাবে ১৯টি শ্রেণিতে নিবন্ধন করার সুযোগ রাখা হয়েছে। এর মধ্যে একটি শ্রেণি ৫৫ বছরের বেশি বয়সী নাগরিকদের জন্য। বাকিগুলো সম্মুখসারিতে থাকা বিভিন্ন পেশাভিত্তিক শ্রেণি অথবা বিশেষ শ্রেণির জন্য।

ওই ১৮টি শ্রেণিতে আছেন সরকারি স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারী; অনুমোদিত সকল বেসরকারি স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা-কর্মচারী; প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত সকল সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্য সেবা কর্মকর্তা-কর্মচারী; বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনা; সম্মুখসারির আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য; সামরিক ও আধা সামরিক প্রতিরক্ষা বাহিনী, রাষ্ট্র পরিচালনায় অপরিহার্য কার্যালয়ের কর্মীরা।

এছাড়া রয়েছেন সম্মুখসারির গণমাধ্যমকর্মী; নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি; সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার সম্মুখসারির কর্মকর্তা-কর্মচারী; ধর্মীর প্রতিনিধি (সকল ধর্ম); মৃতদেহ সৎকারে নিয়োজিত ব্যক্তি; বিদ্যৎ, পানি, গ্যাস, পয়ঃনিস্কাশন ও ফায়ার সার্ভিসের মত জরুরি সেবার সম্মুখসারির কর্মী; রেল স্টেশন, বিমান বন্দর ও নৌ বন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারী; জেলা ও উপজেলায় জরুরি জনসেবায় সম্পৃক্ত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, ব্যাংক কর্মী ও প্রবাসী অদক্ষ শ্রমিক এবং জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা।

নরসিংদীর সদর উপজেলার মাধবদীর অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক আলেক মিয়া জানালেন, ৫৫ বছরের বেশি বয়সী নাগরিকদের শ্রেণিতে নিবন্ধনের চেষ্টা করে তিনি পারেননি।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তথ্য পূরণ করার পর মোবাইলে একটি ওটিপি (ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড) আসে। কিন্তু ‘মোবাইল OTP প্রদান করুন’ এই ঘরে তিনি আর নম্বর বসাতে পারেননি।

“আমি করোনাভাইরাসের টিকা নিতে নিবন্ধন করতে চাই। কিন্তু এখন পর্যন্ত নিবন্ধন করতে পারি নাই,” বলেন ৭১ বছর বয়সী এই বৃদ্ধ।

সম্মুখসারির গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে ওয়েবসাইটে নিবন্ধন করতে গিয়ে তা করতে পারেননি এ প্রতিবেদনের একজন প্রতিবেদক।

সুরক্ষা ওয়েবসাইটের ‘কোভিড-১৯’ নিবন্ধন ফরমে গিয়ে পরিচয় যাচাই অপশনে ধরন নির্বাচন, উপ-শ্রেণি নির্বাচন, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, জন্ম তারিখ দেওয়ার পর ক্যাপচা কোড লিখে পরের ধাপে যাওয়ার জন্য ‘যাচাইকরণ’ অপশনে ক্লিক করলে তাকে লাল কালিতে লেখা দেখানো হয়- “দুঃখিত... বর্তমানে শুধুমাত্র মনোনীত সম্মুখসারির করোনা যোদ্ধা ও ৫৫ বা তদূর্ধ্ব বয়সীদের নিবন্ধন চলমান রয়েছে।”

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার লাইন ডিরেক্টর এবং মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, শুরুর চাপ এড়াতে অ্যাপ্লিকেশনে প্রবেশে ‘কিছু সীমাবদ্ধতা’ রাখা হয়েছে।

সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে সাংবাদিক কোটাতেও নিবন্ধন করা যায়নি জানালে নাজমুল ইসলাম বলেন, বিভিন্ন সাংবাদিক ইউনিয়ন থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে নামের তালিকা দিয়েছে। সেই নামের তালিকা ওয়েব অ্যাপ্লিকেশনের সঙ্গে সিনক্রোনাইজ করা আছে।

“সেই তালিকায় যাদের নাম আছে তারা নিবন্ধন করে ফেলতে পারবেন। যাদের বয়স ৫৫ বছরের কম অথবা ওই তালিকায় নাম নাই, তারা একটু পরে সুযোগ পাবেন। এটা নির্ভর করছে প্রথম তালিকায় নাম থাকাদের নিবন্ধন কত তাড়াতাড়ি শেষ করতে পারেন তার ওপর। প্রথম অংশটা কমপ্লিট হলেই পরের গেটওয়েটা খুলে যাবে।”

আর ৫৫ বছরের বেশি বয়সী যারা নিবন্ধন করতে গিয়ে সমস্যায় পড়ছেন, তাদের বিষয়ে প্রশ্ন করলে ওয়েব অ্যাপ্লিকেশনের কাজে যুক্ত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নিবন্ধনকারীরা জন্ম তারিখ ও মাস ইনপুট দেওয়ার সময় ভুল করায় মূলত সমস্যা তৈরি হচ্ছে।

“অনেকে জন্মদিনের স্থানে মাস এবং মাসের স্থানে দিন দিচ্ছেন। এজন্য এনআইডি ডেটাবেইজে যাচাইয়ে সমস্যাটা হচ্ছে। এসব বিষয় কীভাবে সহজ করা যায়, সেই চেষ্টা করা হচ্ছে।“  

বৃহস্পতিবার বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে করোনাভাইরাসের টিকা দান শুরু হয়েছে

আবার নিবন্ধনকারীদের অনেকে এনআইডির পুরাতন ১৩ ডিজিট নম্বর বা ১৭ ডিজিটের নম্বর ইনপুট দিলে তাতেও কিছুটা সমস্যা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “অনেকেই ভুলভাবে ইনপুট দেওয়ায় সমস্যাগুলো হচ্ছে, যা শিগগিরই সমাধান হয়ে যাবে।”

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, “কিছুটা সমস্যা হচ্ছে, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর যাচাইয়ে অনেক সময় রিফিউজ হয়ে যায় ২ থেকে ৫ শতাংশ।”

দেশের বিপুল সংখ্যক নাগরিক একসঙ্গে নিবন্ধনের চেষ্টা করলে তা কতটা সামাল দেওয়া যাবে এবং তথ্যের সুরক্ষার ব্যবস্থা কতটা নেওয়া হয়েছে, সে বিষয়েও জানতে চাওয়া হয়েছিল প্রতিমন্ত্রীর কাছে।

উত্তরে তিনি বলেন, “এ অ্যাপ্লিকেশন হোস্ট করা হয়েছে ন্যাশনাল ডেটা সেন্টারে। ফলে যতজন এটাতে নিবন্ধন করতে চাইবেন তাতে কোনো সমস্যা হবে না, প্রয়োজন অনুযায়ী এর সক্ষমতা বাড়ানো যাবে।”

আর অ্যাপ্লিকেশনে নিরাপত্তা এবং তথ্য সুরক্ষায় সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে জানিয়ে পলক বলেন, “দেশের বাইরে থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এই অ্যাপ্লিকেশনটি তৈরি করার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছিল, তবে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের নিজস্ব প্রোগ্রামার দিয়ে এটি তৈরি করা হয়েছে।

“তথ্য নিরাপত্তায় `ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সি’ সহ এ সংক্রান্ত অন্যান্য নিরাপত্তা সংস্থাগুলো প্রয়োজনীয় উদ্যেগ গ্রহণ করেছে।”