জঙ্গিবাদ নির্মূলে এরইমধ্যে কঠোরতার পাশাপাশি এই মতবাদে বিশ্বাসীদের বুঝিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার সুযোগ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
বৃহস্পতিবার ঢাকার উত্তরায় র্যাব সদরদপ্তরে তেমন নয়জনের সমাজে ফেরার এক অনুষ্ঠানে উপস্থিত বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থী এ বিষয়ে কথা বলেছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে।
তাদের মতে, পরিবারে সন্তানের সঙ্গে বাবা-মায়ের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এবং শৈশব-কৈশোরের যথাযথ শিক্ষা জঙ্গিবাদের অন্ধকার জগত থেকে তাদের আড়াল করতে পারে।
উত্তরা মডেল কলেজের শিক্ষক ইশরাত জাহান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সবার আগে মনোযোগ দেওয়া উচিত কীভাবে একজন জঙ্গি কিংবা সন্ত্রাসী তৈরি না হতে পারে সেদিকে। সে ব্যাপারে পরিবারকে যেভাবে মনোযোগ দিতে হবে, তেমনভাবে শিক্ষকদের ভূমিকাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
“একটা বাচ্চা যখন পৃথিবীতে আসে সবার আগে সে তার মায়ের কথা শোনে। তার মা, তারপর তার বাবা এবং এর পরেই একটি শিশু প্রাথমিক শিক্ষার পর্যায়ে তার শিক্ষকদের বিশ্বাস করে। আর প্রাথমিক শিক্ষার সময়েই একজন শিক্ষার্থীকে কাদামাটির পুতুলের মতো গড়ে তোলা সম্ভব।”
সেক্ষেত্রে তাকে কীভাবে গড়ে তোলা হবে, সেই দায়িত্ব তার শিক্ষকের উপরই থাকে বলে মনে করেন ইশরাত।
তিনি বলেন, “এক্ষেত্রে হাই স্কুল, কলেজ লেভেলের শিক্ষকদের চেয়েও প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের ভূমিকা বহু গুণে বেশি। তার দেওয়া শিক্ষা অনুযায়ীই একটি শিশুর মানসিক বিকাশের ভিত মজবুত হতে পারে।”
উত্তরা গার্লস হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী আফরিনা
আকতার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ধর্মীয় অপব্যাখ্যা দিয়েই জঙ্গিবাদের প্রতি কিশোর ও তরুণদের আকৃষ্ট করা হয়। তারা মনে করতে বাধ্য হয়, ধর্মে এমনটাই বলা হয়েছে, মানুষকে মেরে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আসলে তা ভুল। ধর্মকে সঠিকভাবে জানাটা খুব দরকার।”
রাজারবাগ পুলিশ লাইনস স্কুল অ্যান্ড কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী পারভেজ মৃধা মনে করেন, পরিবারে সদস্যদের মধ্যে সম্পর্ক একটি শিশুকে ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয়ভাবেই প্রভাবিত করতে পারে।
“পরিবারে সন্তানদের সাথে বাবা-মায়ের সম্পর্ক যদি বিশ্বস্ততার ও বন্ধুসুলভ না হয়, সেক্ষেত্রে সেটি সন্তানের মানসিক বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সন্তানের সৃষ্টিশীল কাজে নিরুৎসাহিত করা, নানাভাবে সন্তানের উপর চাপ সৃষ্টি করা- এসব কারণে সেই সন্তানের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হবে। সে বাইরের জগত থেকে নানাভাবে সেই হতাশা দূর করার জন্য চেষ্টা করতে করতে এক সময় অন্ধকারেও নিমজ্জিত হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।”
এছাড়া ইন্টারনেটে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করাটাও শিশুকে অপরাধের পথে পা বাড়ানোর সুযোগ করে দিতে পারে বলে মনে করেন দ্বাদশ শ্রেণির এই শিক্ষার্থী।
রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজের আরেক শিক্ষার্থী মোহাম্মদ আলী বলেন, “আমরা যারা মেইনস্ট্রিম শিক্ষা ব্যবস্থায় পড়াশোনা করি, তাদের অনেকেরই ধর্ম সম্পর্কে গভীর জ্ঞান থাকে না। এরপর নানা পারিপার্শ্বিক কারণে এবং নীতি-নৈতিকতার অভাবে অনেকেই খারাপ পথে পা বাড়াই, হতাশা তৈরি হয়। তখন মনে হয় সৃষ্টিকর্তাকে পাওয়ার শর্টকাট রাস্তা হিসেবে জিহাদ করা কিংবা মানুষ খুন করা একমাত্র সমাধান। আর জঙ্গিবাদের মূল ওইখানেই তৈরি হয়।”
মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের জঙ্গিবাদে ঝুঁকে পড়ার শঙ্কা বেশি বলে অনেকে মনে করলেও তার সঙ্গে একমত নন মিরপুরের দারুস সালাম কওমী মাদ্রাসার শিক্ষার্থী মোহাম্মদ হাসান।
আগেকার দিনের মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে বর্তমানের শিক্ষা ব্যবস্থার বিস্তর পার্থক্য রয়েছে বলেও মনে করেন হাসান।
জঙ্গিবাদ দমনে ‘যুগোপযোগী ভূমিকা’ রাখার উদ্দেশে র্যাবের গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের আওতায় জঙ্গিদের ‘ডি-র্যাডিক্যালাইজেশন অর্থাৎ বি-জঙ্গিকরণ’ কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।
ডি র্যাডিকালাইজেশন হল, উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ ব্যক্তিকে চরমপন্থা থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা এবং সামগ্রিকভাবে সহনীয় নীতি মধ্যমপন্থায় উদ্বুদ্ধ করার প্রক্রিয়া। এর মাধ্যমে জঙ্গিদের স্বাভাবিক জীবনে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
তাদের পরবর্তী জীবনের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়, সে যেন আবারও জঙ্গিবাদে জড়িয়ে না পড়ে সেজন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নজরদারি অব্যাহত থাকে। এভাবে একজন জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ ব্যক্তিকে পুনরায় সমাজে স্বাভাবিক জীবন যাপনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার মোট নয়জন তাদের ভুল বুঝতে পেরে বিনা শর্তে র্যাবের কাছে আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
এরা হলেন- শাওন মুনতাহা ইবনে শওকত (৩৪), ডা. নুসরাত আলী জুহি (২৯), আবিদা জান্নাত আসমা (১৮), মোহাম্মদ হোসেন (২৩), মোহাম্মাদ সাইফুল্লাহ (৩৭), সাইফুল ইসলাম (৩১), আবদুল্লাহ আল মামুন (২৬), সাইদুর রহমান (২২) ও আবদুর রহমান সোহেল (২৮)।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের কারণে প্রতিনিয়ত আতঙ্কে কাটাতে হয়েছে তাদের। কর্মক্ষেত্রে বা আবাসিক এলাকায় নিজের নাম পরিচয় ব্যবহার করার সাহস তারা পেতেন না। পারিবারিক অশান্তি, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুবান্ধব থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে তারা মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন। তারা সবাই এক পর্যায়ে নিজেদের ভুল বুঝতে পারেন এবং র্যাবের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ হয়।
তাদের আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠানে মনোবিজ্ঞানী ইয়াহিয়া আমিন বলেন, “পারিবার থেকেই একজন মানুষের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলোকে খেয়াল রাখা প্রয়োজন। পরিবারের একটা শিশু থেকে শুরু করে উঠতি বয়সের একজন কী করছে, কী করতে চাচ্ছে, তার কী জন্য কী দরকার- এই বিষয়গুলো খেয়াল রাখা জরুরি। এইটা করা যাবে না, ওইটা করা যাবে না- এমনটা না করে কেন করা যাবে না, এর ফলাফল কীভাবে খারাপ হতে পারে, সেটি আন্তরিকতার সাথে বোঝানো উচিত।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ফারজানা রহমান বলেন, “মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ইউরোপের উপর র্যান্ড করপোরেশন নামের একটি সংস্থার একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস দমনের ক্ষেত্রে ডি-র্যাডিক্যালাইজেশন অনেক বেশি কার্যকর। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো র্যাবের এই উদ্যোগ, যেটি শুধু রি-প্যাট্রিয়েশন না, বরং রিহ্যাবিলিটেশনের মাধ্যমে তাদেরকে সমাজের সাথে একাত্মতা তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে, সেটি নিঃসন্দেহে স্বাগত জানানোর মতো।”
এই প্রক্রিয়ায় সফলতার আশাবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, “জঙ্গিবাদ একটি ভাবাদর্শ। এই ভাবাদর্শকে প্রতিহত করার জন্য আমাদের ভাবাদর্শ দিয়েই প্রতিহত করতে হবে। সেজন্য আমি মনে করি, দেশপ্রেম, অসাম্প্রদায়িকতা, প্রগতিশীলতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে র্যাব এক্ষেত্রে কাজ করে গেলে সাফল্য অবশ্যই সম্ভব।”