কারণ টানা ছয় মাস বন্ধ থাকার পর খুলেছে রমনা পার্ক; আর তাতে আবারও চঞ্চল হয়ে উঠেছে রাজধানীর এই সবুজ প্রাঙ্গণ।
সকাল-বিকালে নানা বয়েসী মানুষজন আবার ছুটে আসছেন এই পার্কে; কেউ হাঁটাহাটি করতে, কেউ আসছেন কিছুক্ষণ প্রকৃতির সান্নিধ্যে সময় কাটতে; আসছে শিশুরাও।
সোমবার বৈকালিক ভ্রমণে আসা ৭২ বছর বয়সী অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা আহসান হাবিব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অনেকদিন বাসার ছোট্ট আঙিনায় হাঁটাহাঁটিটা সারতে হয়েছে। বলতে পারেন একরকম বন্দিজীবনের মতো।
“পার্ক খুলেছে। সকালেও এসে আধা ঘণ্টা ওয়াকিং সারলাম। একবুক ভরা বিশুদ্ধ বায়ুর নিঃশ্বাস … কী প্রশান্তি!”
দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটলে গত ২৬ মার্চ থেকে সরকারি ছুটি ঘোষণার পর রমনা পার্কও জনসাধারণের প্রবেশ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
গত ৩১ মে সরকারি ছুটি তুলে নেওয়া হলেও রমনা পার্ক খোলেনি। গত ৮ সেপ্টেম্বর পার্কটি খোলার জন্য হাই কোর্টে রিট আবেদন করা হলে রোববার গণপূর্ত অধিদপ্তর পার্কটি খোলার নির্দেশনা দেয়।
অধিদপ্তরের কর্মকর্তা আবদুস শহিদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্রতিদিন ভোর ৬টা থেকে সকাল ১০টা এবং বিকাল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত পার্ক খোলা থাকবে।
সোমবার বিকালে গিয়ে দেখা গেছে, রমনার সবুজ চত্বর রঙিন আবার নানা ধরনের, নানা বয়সী মানুষের আনাগোনায়।
কাঠ বিড়ালী, দোয়েল, শালিক, বকসহ নানা পাখির বিচরণের পাশাপাশি এখানে কুকুরও ছিল বেশ কয়েকটি, বাগানগুলোতেও ফুলের সমারোহ।
বন্ধ থাকা অবস্থায় রমনা পার্কের ‘ওয়াক ওয়ে’, বিভিন্ন ছাউনি, বসার স্থানগুলো সংস্কার করা হয়েছে।
যারা নিয়মিত আসতেন, তাদের জন্য পার্কটি দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা ছিল মনঃকষ্টের কারণ।
বেইলি রোড থেকে আসা শিক্ষক সাদিকা শফিউল্লাহ বলেন, “আমি খুব মনঃকষ্টে ছিলাম।পার্ক খুলেছে শুনে ছুটে এসেছি সকালে। ঢাকা শহরে এমনিতেই একটু নিরিবিলি নিঃশ্বাস ফেলার জায়গা নেই। রমনা পার্কের প্রাকৃতিক পরিবেশ মনটাকে সজীব করে তোলে।”
পার্কে শিশুদের জন্য নির্ধারিত স্থানটিতেও কয়েকটি শিশুকে খেলায় মাততে দেখা যায়।
সন্তান টিউলিপ ও বন্যাকে নিয়ে সেগুন বাগিচা থেকে এসেছেন শিক্ষক হালিমা বেগম।
তিনি বলেন, “বাচ্চারা হাঁপিয়ে উঠেছে। আর কত বন্দি রাখা যায় বাসায়। সেজন্য বাচ্চাদের নিয়ে পার্কে এসেছি। দেখুন না কত আনন্দ তাদের মনে জেগেছে।”
পার্ক খুলে দিলেও বিভিন্ন রাস্তার সংস্কার কাজ এখনও চলছে। গাছ-গাছড়ার ঢাল-পালা ঝুলে আছে, ঘাস-আগাছাও বেশ বড় হয়েছে।
পার্কের কর্মী দিদারুল আলম বলেন, আগাছা পরিষ্কারের কাজ চলছে।
লিয়াকত আলী একজন প্রাতঃভ্রমণকারী। পার্কের শতায়ু অঙ্গনে ভোরে যোগ ব্যায়াম করেন দল বেঁধে।
তিনি বলেন, “গতকাল পার্ক খোলার পর আজ ভোরে আমরা ৫৫ জন একসাথে ব্যায়াম করেছি।
এই সংখ্যা বাড়বে। গত মার্চ মাসে এই সংখ্যা ছিল দুই শতাধিক।”
এত দিন পার্ক বন্ধ রাখা হলও সংস্কার কাজগুলো শেষ না করায় অসন্তোষ ঝরে তার কণ্ঠে।
এ বিষয়ে পার্কের কর্মীদের বক্তব্য হচ্ছে, কোভিড-১৯ এর কারণে উন্নয়ন কাজে শ্রমিকও পাওয়া যায়নি প্রথম দিকে। সেজন্য কয়েক মাস পরে কাজ শুরু করা হয়েছে।
শিল্পকলা একাডেমির কাছে একটি এপার্টমেন্টে থাকেন সিদ্দিকুর রহমান। ছোট দুই ছেলেকে নিয়ে পার্কে এসেছেন তিনি।
সিদ্দিকুর বলেন, “কিছুক্ষণ ব্যায়াম করেছি দুই ছেলেকে নিয়ে। এত দিন পার্ক বন্ধ ছিল। পার্কের সীমানা প্রাচীরের বাইরে ফুটপাতে আমরা এসে বিকালে হাঁটতাম।
“মেইন রোডের ফুটপাতের এরকম হাঁটাটা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। কিন্তু কিছু করার নেই। আমি ডায়াবেটিকের রোগী। আমাকে দিনে কমপক্ষে এক-দেড় ঘণ্টা হাটতে হয়। পার্ক খুলে দেওয়াতে খুশি হয়েছি।”
শরীয়তপুর থেকে আসা আরজ আলী মন্ত্রিপাড়ায় এসেছিলেন কাজে, বিকালে রমনা পার্কে ছিলেন বিশ্রাম নিতে।
তিনি বলেন, “মন্ত্রী সাহেবের সাথে সন্ধ্যায় দেখা হবে। সেজন্য পার্কে এসেছি সময় কাটাতে। এত সুন্দর পার্ক, মনে হয় গ্রাম-গঞ্জে আছি। এরকম গাছ-গাছড়ার মধ্যে লেকের পাশে বসলে যে বাতাস, তাতে ইলেক্ট্রিক ফ্যান হার মানবে।”
রমনা পার্কে লেকের পাশে যেসব চেয়ারগুলো রয়েছে, তাতে অনেককে আগের মতো বসে থাকতে দেখা যায়।
আবিদা, রাজন ও রিপন এই তিন ভাই-বোন একসঙ্গে বসেছিলেন। আবিদা বলেন, “কাকরাইলে থাকি। ভাইদেরকে নিয়ে এসেছি পার্কে। অনেক দিন পর নেচারের কাছে আসতে পেরেছি। খুব ভালো লাগছে।”
সেগুন গাছের সারি, নানা প্রজাতির গাছ-গাছালি, পাখির মেলা, আর গারে ডালে কাঠবিড়ালীর বিচরণ, কৃত্রিম লেক- ইত্যাদি মিলিয়ে রাজধানীর ‘ফুসফুস’ হিসেবে বিবেচিত রমনা পার্ক অনেকের প্রিয় স্থান ।
কয়েকশ বছর পুরনো এই পার্কের বর্তমান আয়তন প্রায় ৬৮ দশমিক ৫ একর। এই রমনা পার্কের বটমূলেই প্রতিবছর ছায়ানটের বৈশাখ বরণের অনুষ্ঠানটি হয়।