আগুনে পোড়া স্বজনের জন্য উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা

“ফরিদরে দ্যাখছেন?”- আইসিইউর দরজা থেকে কর্তব্যরত চিকিৎসক বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে উৎকণ্ঠা ভরে জিজ্ঞাসা করলেন শেখ ফরিদের বাবা মো. এমদাদুল হক।

নিজস্ব প্রতিবেদকমেহেরুন নাহার মেঘলাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Sept 2020, 03:44 PM
Updated : 10 Sept 2020, 04:57 AM

হাসপাতালের করিডোরে বসে একটু পরপরই বিলাপ করছেন ফরিদের মা মোসাম্মৎ খোদেজা। অপেক্ষা করছেন ছেলেকে নিয়েই বাড়ি ফিরবেন।

শরীরের ৯৩ শতাংশ পোড়া নিয়ে শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন ২১ বছর বয়সী ফরিদ।

কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ার চর আলগী গ্রামের এই যুবক নারায়ণগঞ্জের ডিসি অফিসে কাজ করার পাশাপাশি বিএ (অনার্স) পড়ছেন।

গত ৪ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার পশ্চিম তল্লা এলাকায় বায়তুস সালাত জামে মসজিদে এশার নামাজ পড়তে গিয়ে বিস্ফোরণে যে ৩৭ জন দগ্ধ হন তাদের একজন এই ফরিদ।

৩৭ জনের প্রায় সবারই শ্বাসনালীসহ দেশের বেশিরভাগ অংশ আগুনে পুড়েছিল। তাদের মধ্যে ২৯ জন মারা গেছেন। একজন শঙ্কামুক্ত হয়ে বাসায় ফিরতে পেরেছেন, বাকিরা সবাই এখনও হাসপাতালে ভর্তি।

এই আটজনের স্বজনরা এখন অনিশ্চয়তা নিয়ে অপেক্ষা করছেন বার্ন ইন্সটিটিউটের আইসিইউর সামনে। কেননা, তাদের অবস্থাও সঙ্কটাপন্ন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

দগ্ধ অবস্থায় দুই ভগ্নীপতিকে বার্ন ইন্সটিটিউটে নিয়ে আসেন মো. রাজন। তার এক ভগ্নিপতি ইমরান হোসেন মারা গেছেন। শরীরের ২৫ শতাংশ পোড়া নিয়ে আইসিইউতে আছেন আরেক ভগ্নিপতি আমজাদ।

রাজন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দুইজন সবসময় একত্রে মসজিদে নামাজ পড়তো। সেদিন নামাজের জন্যই গিয়া একজন মারা গেছেন, আরেকজন লড়তেছেন মরণের সাথে।”

শুক্রবার সেই মসজিদে এশার নামাজে সেজদারত অবস্থায় বিস্ফোরণে ফতুল্লার নজরুল ইসলাম (৫০) দগ্ধ হন বলে তার ছেলে মো. মনির জানিয়েছেন।

শরীরের ৯৪ শতাংশ দগ্ধ অবস্থায় জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে আছেন পটুয়াখালীর মোহাম্মদ রাজ্জাকের ছেলে নজরুল।

মনির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এইখানে চিকিৎসা ভালো চলতেছে, তা না হইলে এত পোড়া নিয়া এখনও আব্বার বাইচা থাকার কথা না।”

নারায়ণগঞ্জে মসজিদে বিস্ফোরণে দগ্ধদের স্বজনরা উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষায় ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। ছবি: কাজী মোবারক হোসেন

মসজিদের সামনেই লন্ড্রির দোকান আবদুল আজিজের (৪০)। সেই সময়ে দোকানেই কাজ করছিলেন তিনি।

তার ছেলে মাদ্রাসার শিক্ষার্থী আবু সায়ীদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন,  “বিস্ফোরণে দোকানের গ্লাস ভেঙে আগুনের হলকা এসে ঢোকে দোকানে। দোকানে থাকা জামাকাপড় সব পুড়ে যায়, আর আব্বারও শরীরে আগুন লাগে।”

শরীরের ৪৭ শতাংশ পুড়ে গেছে আজিজের। বাবাকে বাড়ি ফিরিয়ে নেওয়ার আশায় আছে সাঈদ, মাও রয়েছেন তার পাশে।

ময়মনসিংহ থেকে মেয়ের শ্বশুড়বাড়িতে গিয়েছিলেন ৫৫ বছর বয়সী ফরিদ। তারপর মসজিদে গিয়ে বিস্ফোরণে দেহের ৫০ শতাংশ দগ্ধ হয়ে এখন রয়েছেন হাসপাতালে।

ফরিদের জন্য হাসপাতালে আছেন তার ভাই ফজলুল হক এবং স্ত্রী রীনা বেগম।

রীনা বেগম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার স্বামী পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। মাইয়ার শ্বশুড়বাড়িত গিয়া মসজিদে নামাজ পড়তেই গেছিল, আইছে পোড়া নিয়া।”

নারায়ণগঞ্জে মসজিদে বিস্ফোরণে দগ্ধদের স্বজনরা উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষায় ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। ছবি: মেহেরুন নাহার মেঘলা

এছাড়াও আইসিইউতে শরীরের ৩০ শতাংশ পোড়া নিয়ে পটুয়াখালীর মো. কেনান (২৪), ২২ শতাংশ পোড়া নিয়ে ফতুল্লার নিউ খানপুর ব্যাংক কলোনির রিফাত (১৮), ২৫ শতাংশ পোড়া নিয়ে নোয়াখালীর কোম্পানিগঞ্জের আমজাদ (২৭) এবং ১৫ শতাংশ পোড়া নিয়ে মামুন (২৩) রয়েছেন হাসপাতালে। তাদের সবারই শ্বাসনালী পুড়েছে।

বুধবার সকালে প্রেস ব্রিফিংয়ে ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, “হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি আটজনের কারও অবস্থাই শঙ্কামুক্ত নয়।”

বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের চিকিৎসক জুলফিকার লেলিন রোগীদের তদারকির জন্য আসবেন বলে জানান তিনি।

সামন্ত লাল বলেন, “রোগীদের চিকিৎসার জন্য কী কী লাগবে তার একটি তালিকা আমরা তৈরি করছি। কাল জুলফিকার লেলিন আসার পর এ ব্যাপারে তার সাথে আলোচনা করা হবে।”