গর্ভপাতের শাস্তির বিধান কেন সংবিধান পরিপন্থি নয়: হাই কোর্ট

গর্ভপাতের সাজা সংক্রান্ত দণ্ডবিধির ৩১২ থেকে ৩১৬ ধারা কেন বৈষম্যমূলক ও সংবিধানের মৌলিক অধিকার পরিপন্থি ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছে হাই কোর্ট।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 August 2020, 03:48 PM
Updated : 18 August 2020, 03:48 PM

জনস্বার্থে করা একটি রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি তারিক উল হাকিম ও বিচারপতি এস এম কুদ্দুস জামানের ভার্চুয়াল হাই কোর্ট বেঞ্চ মঙ্গলবার এ রুল জারি করে। 

আইন সচিব, নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলসহ সংশ্লিষ্ট পাঁচ বিবাদীকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।

আদালতে রিট আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন রিটকারী আইনজীবী সৈয়দা নাসরিন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত দাস গুপ্ত।

আদশের পর সৈয়দা নাসরিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গর্ভপাতের কারণে দণ্ডবিধির ২১২ থেকে ৩১৬ পর্যন্ত বিধিতে দণ্ডের যে ধারাগুলো আছে, রিটে সেগুলো চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। কারণ এই বিধিগুলো একজন মেয়ে বা নারীর মৌলিক অধিকারকে লংঘন করে। এই ধারাগুলো একজন নারীর পছন্দ বা মতের স্বাধীনতার পরিপন্থিই নয়, জীবন ও স্বাস্থ্যগত স্বাধীনতা, অধিকারেরও পরিপন্থি।”

তিনি বলেন, “দণ্ডবিধি অনুযায়ী গর্ভপাত যেহেতু অবৈধ তাই গর্ভপাত ঘটাতে কোনো ভালো রেজিস্ট্রার ডাক্তার বা ভালো মেডিকেলে যেতে পারেন না একজন নারী। যে কারণে অনিরাপদ গর্ভপাতের শিকার হচ্ছেন নারীরা। এর ফলে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়তে হচ্ছে নারীকে। অনিরাপদ গর্ভপাতের কারণে ক্যান্সার, বন্ধ্যাত্বসহ নানা মারাত্মক রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এসব কারণে অনেক নারীর জীবন নাশও ঘটছে।”

এ আইনজীবী বলেন, “প্রায়ই পত্র-পত্রিকায় আমরা দেখতে পাই, ডাস্টবিনে বা রাস্তার পাশে বাচ্চা ফেলে রেখে চলে গেছে মা। তার মানে বাচ্চাটা সে চায়নি। কারণ যিনি বাচ্চাটা ফেলে রেখে গেছেন তিনি নিজেই তো ভিকটিম। হয় তিনি ধর্ষণের শিকার হয়ে গর্ভধারণ করেছেন, নয়ত স্বামী ছেড়ে গেছে বা প্রতারণার শিকার হয়েছেন।

“অর্থাৎ না চাইলেও বা ইচ্ছার বিরুদ্ধে একজন নারীকে অনেক সময় গর্ভধারণ করতে হচ্ছে। সামাজিক দায়, পীড়ন, লাঞ্ছনা, বঞ্চনা সবই ওই নারীকে নিতে হচ্ছে।”

সৈয়দা নাসরিন বলেন, “আরেকটি বিষয় প্রায়ই পত্র-পত্রিকায়  আসে ১০-১১ বছরের মেয়ে গর্ভবতী হয়েছে। এ ঘটানাটা বেশিরভাগই ঘটছে ধর্ষণের শিকার হয়ে। শুধু ধর্ষণ না, না বুঝেও অনেকে হয়ত সেটি করে ফেলেন। ফ্যান্টাসির কারণে শারীরিক অন্তরঙ্গতা এক জিনিস আর মাতৃত্ব বা অভিভাবকত্ব আরেক জিনিস। আমি মা বা বাবা হতে চাই, সেটি অনেক বড় একটি দায়িত্বশীলতার বিষয়।

“যে মেয়েটা ১২-১৩ বছরের সে নিজেই তো এখনও বাচ্চা। আইন দিয়ে গর্ভপাতের পথ রুদ্ধ করে সেই বাচ্চাটাকে তো মাতৃত্বে বাধ্য করতে পারি না। এছাড়া কেউ অপ্রত্যাশিতভাবে গর্ভধারণ করলেও সে গর্ভপাতের সুযোগ পাচ্ছে না। ফলে আইনের বাধ্যবাধকতায় রাষ্ট্র বা সমাজ কারও মৌলিক অধিকার কেড়ে নিতে পারে না। তাই দণ্ডবিধির এই বিধানগুলো চ্যালেঞ্জ করে রিট করা।”

দণ্ডবিধিতে গর্ভপাত সম্পর্কে বলা হয়েছে, ভ্রূণ গর্ভে স্থিতি লাভের পর থেকে গর্ভকাল পূরণ হওয়ার আগে গর্ভস্থিত ভ্রূণ অপসারণ করাকে গর্ভপাত বলে।

৩১২ ধারায় বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে গর্ভবতী স্ত্রীলোকের গর্ভপাত করায়, এবং যদি সে গর্ভপাত সরল বিশ্বাসে উক্ত স্ত্রীলোকের জীবন বাঁচাবার  উদ্দেশ্যে না করা হয়ে থাকে, তবে সে ব্যক্তি তিন বৎসর পর্যন্ত যে কোন মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে, অথবা অর্থ দণ্ডে, অথবা উভয়বিধ দণ্ডেই দণ্ডিত হবে; এবং যদি স্ত্রীলোকটি শিশুর বিচরণ অনুভব করে, তবে সে ব্যক্তি সাত বৎসর পর্যন্ত যে কোন মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে, এবং তদুপরি অর্থ দণ্ডেও দণ্ডিত হবে।

এই ধারাটির ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, যে স্ত্রীলোক নিজে থেকে গর্ভপাত করে সে স্ত্রীলোকও অত্র ধারার তাৎপর্যাধীন হবে।

৩১৩ ধারায় বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি যদি পূর্ববর্তী ধারায় বর্ণিত অপরাধটি সংশ্লিষ্ট স্ত্রীলোকের সম্মতি ছাড়া সম্পাদন করে-স্ত্রীলোকটি আসন্ন প্রসবা হোক বা না হোক- তবে সে ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে অথবা দশ বৎসর পর্যন্ত যে কোন মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং তদুপরি অর্থ দণ্ডেও দণ্ডিত হবে।

৩১৪ ধারায় বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি যদি কোন গর্ভবতী স্ত্রীলোকের গর্ভপাত করানোর উদ্দেশ্যে কৃত কোন কাজের ফলে সে স্ত্রীলোকটির মৃত্যু ঘটায়, তবে সে ব্যক্তি দশ বৎসর পর্যন্ত যে কোন মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে, এবং তদুপরি অর্থ দণ্ডেও দণ্ডিত হবে।

৩১৫ ধারায় বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি যদি কোন শিশুর জন্মের পূর্বে এমন কোন কাজ করে, যাতে শিশুটি জীবিত অবস্থায় ভূমিষ্ট হতে না পারে বা জন্মের পরে তার মৃত্যু হয় এবং অনুরূপ কাজের ফলে শিশুটি জীবিত অবস্থায় ভূমিষ্ট না হয় বা ভূমিষ্ট হওয়ার পর তার মৃত্যু হয়- এবং যদি কাজটি মাতার জীবন রক্ষার জন্য সরল বিশ্বাসে কৃত না হয়, তবে সে ব্যক্তি দশ বৎসর পর্যন্ত যে কোন মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে, অথবা অর্থ দণ্ডে, অথবা উভয়বিধ দণ্ডেই দণ্ডিত হবে।

৩১৬ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোন ব্যক্তি এমন কোন কার্য করে, যদ্ধারা সে কোন মৃত্যু ঘটালে তা হলে সে অপরাধজনক নরহত্যা অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হত এবং অনুরূপ কার্যের সাহায্যে একটি জীবন্ত অজাত শিশুর মৃত্যু ঘটায়, তবে উক্ত ব্যক্তি যে কোন বর্ণনার কারাদণ্ডে যার মেয়াদ দশ বৎসর পর্যন্ত হতে পারে, দণ্ডিত হবে এবং তদুপরি অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবে।