একটা সময়ে কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, অভিনেতা, রাজনীতিবিদ, চলচ্চিত্রকারদের অবাধ বিচরণ ও আড্ডার প্রাণকেন্দ্র ছিল বিউটি বোর্ডিং। এখন আর তেমন কারও পা পড়ে না এখানে।
কালের স্রোতে ঢাকার বিস্তৃতি বেড়েছে, বেড়েছে জৌলুস, চাকচিক্য। বিপরীতে নিষ্প্রাণ হয়েছে বিউটি বোর্ডিং।
সম্প্রতি ‘মরার ওপর খাড়ার ঘাঁ’ এর মতো যোগ হয়েছে করোনাভাইরাস মহামারী। ভাইরাস সংক্রমণের শঙ্কায় বোর্ডার নেওয়া বন্ধ সেই মার্চ থেকে। অবশ্য খাবারের হোটেলটি কিছুদিন আগে চালু হয়েছে, কিন্তু খদ্দেরের দেখা পাওয়াই ভার।
এখনও প্রতিবছর ঈদের সময় অনেকেই ভিড় করতেন, আড্ডা জমাতেন বিউটি বোর্ডিংয়ে। কিন্তু এবার মহামারীর কারণেই তাও হওয়ার সম্ভাবনা কম।
সবমিলিয়ে ইতিহাসের গন্ধমাখা দোতলা বাড়িটির অবস্থা এখন নিভু নিভু প্রদীপের মতো।
গত শতকের চল্লিশের দশকে বাংলাবাজারকে ঘিরে গড়ে উঠে প্রকাশনা শিল্প। সেখানকার নিঃসন্তান জমিদার সুধীর চন্দ্র দাসের বাড়িটিতে ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের আগে সাপ্তাহিক ‘সোনার বাংলা’ পত্রিকার অফিস। কবি শামসুর রাহমানের প্রথম কবিতা ছাপা হয়েছিল এ পত্রিকায়ই। ভারত ভাগের সময় পত্রিকা অফিসটি কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়। এরপর ১৯৪৯ সালে দুই ভাই প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহা ও নলিনী মোহন সাহা এই বাড়িতে গড়ে তোলেন আবাসিক ও খাবার হোটেল।
প্রহ্লাদ চন্দ্রের ছেলে সমর সাহা বলেন, “১১ কাঠা জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত বিউটি বোর্ডিংয়ের নামকরণ করা হয় নলিনী সাহার বড় মেয়ে বিউটির নামে। একাত্তরে এই বিউটি বোর্ডিং হয়ে উঠে মুক্তিযোদ্ধাদের মিলনস্থল। বঙ্গবন্ধু এখানে আসতেন। আমি তখন ছোট ছিলাম, বয়স হয়ত ৯/১০ হবে। রাজাকাররা বিষয়টি জানতে পারে, পরে ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ এখানে হামলা চালায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। শহীদ হন আমার বাবাসহ ১৭ জন।”
পরবর্তীতে প্রহ্লাদ চন্দ্রের পরিবার ভারত চলে যায়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে প্রহ্লাদ চন্দ্রের স্ত্রী প্রতিভা সাহা দুই ছেলে সমর সাহা ও তারক সাহাকে নিয়ে বিউটি বোর্ডিং পুনরায় চালু করেন।
বিউটি বোর্ডিংয়ের আড্ডা আগের মতো না থাকলেও খাবার ঘরে এখনো ভোজনরসিকদের ভিড় লেগেই থাকে। ঐতিহ্য ধরে রাখতে ভোজনরসিকদের আজও এখানে স্টিলের থালা-গ্লাসে খাবার ও পানি পরিবেশন করা হয়। সকালে নাস্তা, দুপুরে ভাত, বিকালে সুস্বাদু লুচি ও রাতেও রয়েছে খাবারের ব্যবস্থা।
বিউটি বোর্ডিংয়ে ছোট-বড় মিলিয়ে কক্ষ রয়েছে ২২টি। একমাত্র বড় রুমের ভাড়া এক হাজার ২০০ টাকা আর সিঙ্গেল রুমের ভাড়া ২০০ থেকে ৩০০ টাকার মধ্যে। স্বল্প খরচে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও এখানকার বেশির ভাগ কক্ষই খালি থাকে।
বিউটি বোর্ডিংয়ের সেকাল-একাল
পুরান ঢাকার বাংলাবাজারে ঢুকে একটু এগোলেই বুড়িগঙ্গার তীরের শ্রীশচন্দ্র লেন। এই লেনের এক নম্বর বাড়িতে বিউটি বোর্ডিং। সাইনবোর্ড পেরিয়ে ছোট গেট দিয়ে হলুদ রঙের দোতলা বাড়িটির আঙিনায় ঢোকার পরই যে কোনো মানুষের মন ভরে যাবে এর অবারিত সৌন্দর্যে। ভবনটির প্রাচীন আমলের গাঁথুনি মুহূর্তেই কাউকে নিয়ে যাবে একশ বছর পেছনে। মাঝখানে প্রশস্ত উঠান; ফুলের বাগান দিয়ে ঘেরা। বেশ আড্ডার জায়গা।
পাশে খাবার ঘরের দেয়ালে টাঙানো আছে প্রাচীন আড্ডার কয়েকটি ছবি। এরপর শোবার ঘর, পেছনে সিঁড়িঘর- সবই গল্পের বইয়ে লেখা প্রাচীন জমিদার বাড়ির বর্ণনার মতো। আঙিনার এক কোণে কবি শামসুর রাহমানের স্মৃতিফলক। একটু সামনে এগোলেই চোখে পড়বে মুক্তিযুদ্ধে ১৭ জন শহীদের নামফলক।
জন্মলগ্ন থেকেই এখানে আড্ডা দিতেন প্রথিতযশা কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাংবাদিক, চিত্রপরিচালক, নৃত্যশিল্পী, গায়ক, অভিনেতাসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। একসময় প্রমত্তা বুড়িগঙ্গার ভরা যৌবনের মতোই প্রণোচ্ছল ছিল বিউটি বোর্ডিংয়ের সেই দিনগুলো।
নতুন প্রজন্মের কাছে খুব চেনাজানা না হলেও বোদ্ধামহল ও সুধীজনদের কাছে এর কদর একটুও কমেনি। যার কারণে এখনও একটু সময় পেলেই অনেকেই এখানে ছুটে আসেন।
বিউটি বোর্ডিং তার জৌলুস হারালেও প্রতিবছর ঈদের সময় কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, অভিনেতা, রাজনীতিবিদ, চলচ্চিত্রকারদের অনেকেই আসর বসান। হৈ-হুল্লর আর আড্ডায় মেতে উঠেন। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে থেমে গেছে সব আড্ডা। আড্ডা দিতে না পেরে অনেকেই আক্ষেপ করেছেন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সেই ষাটের দশক থেকে আমরা কয়েকজন বিউটি বোর্ডিংয়ে নিয়মিত আড্ডা দিতাম। এখনও প্রতিবছর ওখানে মিলিত হই। এবারও যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু করোনাভাইরাস সংকটে যাওয়া কোনোভাবেই ঠিক হবে না। তাই এবার আড্ডা দেওয়া আর হচ্ছে না।”
এক সময়ে নিয়মিত পা পড়ত কবি নির্মলেন্দু গুণের। বিউটি বোর্ডিংয়ের সেই ফেলে আসা দিনগুলোর কথা ভেবে ভারাক্রান্ত তিনিও।
“এক সময় বাংলাবাজারে প্রকাশনার কাজে নিয়মিত যেতে হতো, তখন আড্ডাটা দিতাম বিউটি বোর্ডিংয়ে। ওখানে বসে কবিতা লিখতাম, সাহিত্য চর্চা করতাম। এখন আর যাওয়া হয় না।”
১৯৯৫ সালে সাবেক বিউটিয়ানদের নিয়ে গঠিত হয় ‘বিউটি বোর্ডিং সুধী ট্রাস্ট’। আর ২০০৩ সালে কবি ইমরুল চৌধুরীকে আহ্বায়ক ও সদ্যপ্রয়াত তারক সাহাকে সদস্য সচিব করে ৬০ সদস্যবিশিষ্ট ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হয়। আর এই ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে ২০০৫ সাল থেকে দেয়া হচ্ছে ‘বিউটি বোর্ডিং সম্মাননা’। স্ব-স্ব ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রতি বছর এক বা একাধিক ব্যক্তিকে এই সম্মাননা দেওয়া হয়।
করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে বোর্ডার নেওয়া বন্ধ থাকলেও গত ৭ জুলাই থেকে খাবার ব্যবস্থাটা ফের চালু করেছে বোর্ডিং কর্তৃপক্ষ।
বিউটি বোর্ডিংয়ের পরিচালক সমর সাহা বলেন, “খাবার চালু করলেও লোকজন আসছে একেবারেই কম।”
ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন জানিয়ে সমর বলেন, “মহামারীর কারণে আমরা কষ্টে আছি, অনেক ক্ষতি হয়েছে আমাদের। সবাই এখানে আসে আড্ডা দেয়, কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ কোনো সহযোগিতা করেনি। সরকারের পক্ষ থেকেও কেউ খবর নেয় না।”
অনেকে বিউটি বোর্ডিং দখলের চেষ্টায় আছে বলেও জানান তিনি।
“একটি মহল চক্রান্ত করে জাল দলিলের মাধ্যমে এই ঐতিহ্য আমার বাপ-দাদার সম্পত্তি দখলের চেষ্ট করে।
ঢাকা তথা বাংলাদেশের ঐতিহ্য বিউটি বোর্ডিং যেন আধুনিকতার উত্থানে পিছিয়ে পড়া এক ঐতিহ্য, এতে লোকসান গুণতে হচ্ছে জানিয়ে সমর সাহা বলেন, দিনের পর দিন লোকসান দিয়েও শুধু ঐতিহ্য ধরে রাখতেই প্রতিষ্ঠানটিকে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে বেশিদিন টিকে থাকা যাবে না।