আনিসুজ্জামানের মৃত্যুতে ‘অভিভাবক’ হারানোর হতাশা

মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতা ও কূপমণ্ডুকতার বিপরীতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল সমাজ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে দীর্ঘ দিন সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মৃত্যুতে ‘অভিভাবক’ হারানোর হতাশা জানিয়েছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় লেখক, অধ্যাপক ও সংস্কৃতি কর্মীরা।

রাসেল সরকারমো. , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 May 2020, 07:59 PM
Updated : 14 May 2020, 07:59 PM

প্রায় সাত দশক শিক্ষকতা ছাড়াও লেখালেখি, গবেষণা এবং সংকটকালে দিক নির্দেশনামূলক বক্তব্য নিয়ে হাজির হওয়া অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ৮৩ বছর বয়সে বৃহস্পতিবার মারা গেছেন।

জাতীয় জীবনে আনিসুজ্জামানের ভূমিকা স্মরণ করে কবি নির্মলেন্দু গুণ বলেছেন, “মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যে শক্তি তার বড় স্তম্ভ ছিলেন তিনি। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান স্বৈরাচারবিরোধী, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী, কূপমণ্ডুকতাবিরোধী আন্দোলনে দীর্ঘদিন নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলন থেকে শুরু করে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তীতে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে আমরা তাকে অগ্রভাগে ভূমিকা দেখেছি।

“বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে সংবিধান প্রণয়নেও তিনি যুক্ত ছিলেন। সেই সংবিধানের চার মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ,গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা- এ থেকে যখন বহু পরিবর্তন হয়েছে দেশে, তা পুনঃস্থাপনার কাজেও অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ব্রতী ছিলেন।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আনিসুজ্জামানের সহকর্মী জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি আমার ভাইকে হারালাম। এ শূন্যতা কোনো দিন পূরণ হবে না। যদিও তিনি আমার সহকর্মী ছিলেন এবং তিনি আমার থেকে কিছু কনিষ্ঠ ছিলেন, কিন্তু বিদ্যা-বুদ্ধি, জ্ঞান-পাণ্ডিত্য ও গবেষণায় তিনি আমাদের থেকে অনেক উঁচুতে ছিলেন। আমাদের দেশের ভাষা ও সাহিত্য গবেষণায়, মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তীকালে তার ভূমিকা, তার সাহসের তুলনা হয় না।”

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, “আমিও হসপিটালে আছি। আমাকে যখন প্রধানমন্ত্রী হসপিটালে পাঠিয়েছেন, তার পরের দিন আনিসুজ্জামান সাহেবকে পাঠানো হয়েছিল এখানে (সিএমএইচ)। উনি আজ চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে। আমি ব্যক্তিগতভাবে তো বটেই, পারিবারিকভাবেও আমরা শোকাহত। কারণ উনি আমাদের ৬৫ বছরের পারিবারিক বন্ধু। আমার বাবা উনাকে ছেলেবেলা থেকে দেখাশুনা করেছেন।”

মুনতাসীর মামুন বলেন, “আনিসুজ্জামানের মতো মানুষ শতকে একজন-দুজনই জন্মায়। বাংলাদেশের সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতি ভাবনায় তার অবদান অনস্বীকার্য। সবচেয়ে বড় বিষয় গত পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মুক্তি ও বৈষম্য নিরসনের জন্য যারা কাজ করেছেন, আনিসুজ্জামান তাদের অন্যতম ছিলেন। তিনি আমাদের সুধী সমাজ বলি, বুদ্ধিজীবী বলি, যেটাই বলি উনি শুধু আমাদের একজন শিক্ষকই নন, আমাদের একজন আশ্রয়স্থল ছিলেন। সমাজের মুরুব্বি বলে কিছু মানুষ থাকে যারা বিপদে এসে দাঁড়ান, আনিসুজ্জামান ছিলেন সে রকম একজন লোক।”

করোনাভাইরাসের কারণে অন্য সময়ের মতো প্রিয় মানুষটিকে বিদায় জানাতে না পারার আফসোস জানিয়ে তিনি বলেন, “অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ৭০ বছর এদেশের সেবা করে গেলেন।কোনো দিন কিছুই চাননি তিনি। আমরা খুবই হতভাগ্য যে, গত এক মাসে আমাদের বোরহান উদ্দিন জাহাঙ্গীর, জামিলুর রেজা চৌধুরী, আজ আনিসুজ্জামান চলে গেলেন। কিন্তু এমন একটা সময়ে তারা চলে গেলেন যখন তাদেরকে আমরা রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করতে পারছি না, যথাযোগ্য মর্যাদায় তাদেরকে বিদায় জানাতে পারলাম না!”

আনিসুজ্জামানের এক সময়ের ছাত্র ও পরবর্তীতে সহকর্মী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক রফিক উল্লাহ খান বলেছেন, “বাঙালির মুক্তবুদ্ধি ও প্রগতিচিন্তার অনন্য বাতিঘর ছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। এ বেদনা ভাষাতীত, ব্যাখ্যাতীত…।

“অধ্যাপক আনিসুজ্জামান যা কিছু রেখে গেছেন, বাংলা ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি তার থেকে অনেক লাভবান হবে। অনেক কাল ধরে আনিসুজ্জামান আমাদের পথ দেখাবে।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার আরেক অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বাঙালির মননশীলতার উজ্জ্বল এক প্রতিনিধি ছিলেন। আমাদের জাতির নানা ক্রান্তিকালে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। এই মানুষটির মৃত্যতে বাংলাদেশ অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়ল। আমাদের মননশীলতার জগতটা অনেক দরিদ্র হয়ে গেল এবং এই দারিদ্র্য বহু বছরের সাধনাতেও আমরা পূরণ করতে পারব বলে আমি মনে করি না।”

বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী বলেন, “আনিসুজ্জামান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় যোদ্ধা। তার গবেষণা বাংলা গদ্য সম্পর্কে যেমন দিক উন্মোচন করেছে তেমনি তার অজস্র সম্পাদনাকর্ম আমাদের সাহিত্যকে করেছে সমৃদ্ধ।

“তিনি ছিলেন বাংলা একাডেমির প্রথম বৃত্তিপ্রাপ্ত গবেষক, একাডেমির সম্মানিত ফেলো এবং একাডেমির ইতিহাসে সর্বাধিক কালপর্বের সভাপতি। বাংলা একাডেমি পরিবার তাকে হারিয়ে শোকস্তব্ধ।”

বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বলেন, “কী অসাধারণ পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন স্যার! সাহিত্যে বিজ্ঞান সচেতনতা ও পাণ্ডিত্যে তার তুলনা মেলে না। স্যারের অনন্য গুণ ছিল, অনেক কথা তিনি খুব অল্পতে বলে দিতে পারতেন। অনেক যেখানে দশ পাতা লিখবেন, স্যার সেখানে দেড় পাতায় লিখে দিতেন। এত অল্পে সব কথা বলে দিতে পারতেন স্যার। বাংলাদেশের সংস্কৃতি অঙ্গন আজ সত্যি শূন্য হয়ে গেল।”

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় কমিটির সমন্বয়ক ও কবি কামাল চৌধুরী বলেন, “বাঙালির সৃজন ও মনন চর্চার এক অসাধারণ প্রতিভা ছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। তিনি ছিলেন আমাদের কাছে বটবৃক্ষের মতো। তার ছায়া সব সময় তরুণ প্রজন্মকে উজ্জ্বীবিত করেছে। তার কলম সদা মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলেছে। আমি দেখেছি, মানুষকে কত সহজে কাছে টেনে নিতেন তিনি।

“জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনে তিনি আমাদের আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করেছেন, দিয়েছেন নানা পরামর্শ। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পক্ষে তার যে অবস্থান, তা তরুণ প্রজন্মকে সব সময় উজ্জ্বীবিত করবে।”

এক শোকবার্তায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান বলেন, “জাতির যে কোনো সংকটকালে ও দুর্যোগময় মুহূর্তে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ বিকাশের আন্দোলনে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ছিলেন সামনের সারির একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব। জাতির বাতিঘর হিসেবে পরিচিত অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মৃত্যুতে দেশ ও জাতির যে ক্ষতি হল, তা কখনই পূরণীয় নয়। দেশের শিক্ষা, শিল্প ও সাহিত্য অঙ্গনে অসাধারণ অবদানের জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।”

উপাচার্য বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এমিরিটাস অধ্যাপক এবং বাংলা একাডেমির সভাপতি আনিসুজ্জামান ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিক্ষাবিদ, গবেষক, লেখক, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী। তিনি ছিলেন প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক চেতনার একজন অসাধারণ গুণী ব্যক্তি।

“বাহান্নোর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, মহান মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান অসাধারণ অবদান রেখে গেছেন। তিনি ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগর সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য এবং ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে ড. কুদরাত-এ-খুদা জাতীয় শিক্ষা কমিশনের সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এএসএম মাকসুদ কামাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি শিক্ষক সমাজের পক্ষ থেকে উনার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি। তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের, গণতান্ত্রিক শক্তির পক্ষের, সর্বোপরি বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের পক্ষে একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন।তার মৃত্যুতে আমরা যারা গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক শক্তিসহ যারা শুভ বুদ্ধির চর্চা করি, তার বিদায়ে অভিভাবক শূন্য হয়ে গেলাম। এ মৃত্যু অত্যন্ত অপূরণীয়। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান যে আদর্শ রেখে গেছেন তা আমাদের চলার পাথেয় হবে।”

বাংলাদেশ কবিতা পরিষদের সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উপ-উপাচার্য (প্রশাসন)  অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আনিসুজ্জামান আমাদের দেশের একজন অসামান্য পণ্ডিত ছিলেন। একজন অসামান্য পণ্ডিত হয়েও তিনি সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছেন। তার দেশপ্রেম, তার আদর্শ আমাদেরকে উদ্বুদ্ধ করেছে। বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে আমরা তাকে অভিভাবকের ভূমিকায় পেয়েছি।

“আমরা তার আদর্শের সাথে সব সময় থেকেছি। তার মৃত্যুতে এক অপূরণীয় ক্ষতি হল। তার প্রজন্মের মানুষগুলো একে চলে যাচ্ছে। আমরা মনে করি, তার যে আদর্শ তা যদি আমরা ধরে রাখতে পারি তাহলেই তার প্রতি যথাযথ সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হবে।”

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, “এক কথায় বলব, আজ আমরা হারিয়ে ফেললাম আমাদের জাতির বিবেককে। বাতিঘরের মতো তিনি আমাদের পথ দেখিয়ে গিয়েছেন। জাতির সামনে যখনই কোনো সঙ্কট এসেছে, আমরা তার মতামত নিয়েছি। সেই মতামত ছিল আমাদের কাছে শিরোধার্য।”

অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মৃত্যুতে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম ও মুক্তিযুদ্ধ-৭১ এর চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল  কে.এম. সফিউল্লাহ, ভাইস চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সি আর দত্ত এবং মহাসচিব হারুন হাবীব শোকবার্তায় বলেন, “বরেণ্য জাতীয় অধ্যাপক ও কৃতী শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মৃত্যু বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে এক গভীর শূন্যতার সৃষ্টি করেছে।

“ফোরাম মনে করে, ভাষা আন্দোলন, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থেকে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বাংলাদেশকে ঋণী করেছেন।

“ধর্মান্ধতা ও মৌলবাদবিরোধী সকল কর্মকাণ্ড এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে তিনি ছিলেন  সর্বজন শ্রদ্ধেয় জাতীয় বিবেক, দুর্দিনের বাতিঘর। তিনি জাতিকে আলোকিত করেছেন।  শত সংকটেও আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি।” 

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ছিলেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির উপদেষ্টা।

তার মৃত্যুতে শোক জানিয়ে সংগঠনটির এক বার্তায় বলা হয়েছে, “১৯৯২ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের প্রতীকী বিচারের জন্য গঠিত গণআদালতের অন্যতম অভিযোগকারী ছিলেন তিনি। আমৃত্যু নির্মূল কমিটির উপদেষ্টা হিসেবে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী নাগরিক আন্দোলনে অসামান্য অবদান রেখেছেন।

“ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক অধ্যাপক আনিসুজ্জামান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন, তিনি সংবিধানের অনুবাদক, দেশের সব প্রগতিশীল আন্দোলনের অগ্রবর্তী মানুষ। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মৃত্যুতে আমাদের প্রগতিশীল সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে এবং সর্বোপরি জাতীয় জীবনে যে বিশাল শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে তা সহজে পূরণ হবে না।”

অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মৃত্যুতে শোক জানিয়ে ছায়ানট বলেছে, “বাহান্নোর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ ও নব্বইয়ের স্বৈরশাসনবিরোধী সংগ্রামে তার উজ্জ্বল উপস্থিতি আমাদের প্রাণিত করেছে। তিনি ছিলেন ছায়ানটের শুভান্যুধায়ী ও বিশেষ বন্ধু। দেশ ও সমাজের প্রতি তার অবদান মানুষ চিরকাল মনে রাখবে।”

শোক জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, “অধ্যাপক আনিসুজ্জামান গত ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে আমার ব্যক্তিগত ও পারিবারিকভাবে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ছিলেন এক আলোকবর্তিকা। তার মৃত্যুতে জাতি একজন শ্রেষ্ঠ সন্তানকে হারাল। প্রগতিশীল চেতনার অধিকারী এ মহান ব্যক্তিকে বাঙালি জাতি চিরদিন স্মরণ রাখবে।”

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান'র মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক নাসরীন আহমাদ।

তাদের এক শোকবার্তায় বলা হয়েছে, “অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ভাষা আন্দোলন ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।এছাড়াও তিনি দেশ ও জাতির যে কোনো ক্রান্তিলগ্নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।

“তার মৃত্যু দেশ, জাতি ও বাংলা সাহিত্যের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশে এবং ভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার কারণে তিনি দেশবাসীর কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।”

অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা গণফোরাম সভাপতি কামাল হোসেন, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি জাফরুল্লাহ চৌধুরী, গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক রেজা কিবরিয়া, বিকল্পধারা বাংলাদেশ একাংশের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নুরুল আমিন বেপারী।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে দেশে মুক্তবুদ্ধি চর্চার ‘অন্যতম পথিকৃৎ’ অভিহিত করে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি -সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মাদ শাহ আলম শোক বিবৃতি দিয়েছেন।

লেখক, সাংবাদিক ও অধিকার কর্মী বেবী মওদুদের পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে শুক্রবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে স্মরণ সভায় জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। ছবি:আব্দুল্লাহ আল মমীন

বিবৃতিতে তারা বলেন, “বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক হিসেবে তিনি বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। পাকিস্তানি আমলে শাসকগোষ্ঠীর বাংলা, বাঙালি সংস্কৃতি ও সাহিত্য বিরোধী যে কোনো অপতৎপরতার বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার কণ্ঠ ছিলেন।

“তিনি আফ্রো-এশিয়ার নিপীড়িত মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন। আফ্রিকা, এশিয়া ও ল্যাতিন আমেরিকায় সাম্রাজ্যবাদী, ঔপনিবেশিক ও নয়া ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার কণ্ঠ ছিলেন। তিনি সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে আজীবন লড়াই করে গেছেন।”

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার এক শোকবার্তায় বলেন, “অধ্যাপক আনিসুজ্জামান স্বাধীন বাংলাদেশেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় প্রগতিশীল ধারায় সামাজিক রাষ্টীয় বিকাশের জন্য আলোকবর্তিকা ও জাতির বিবেক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ব্যক্তিগত কোনো চাওয়া-পাওয়া-লোভ-মোহ-স্বার্থের হিসাব করে সত্য কথা বলা বা সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলা থেকে এক মুহূর্তের জন্য বিরত ছিলেন না।”

বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন শোক বিবৃতিতে বলেন, “অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তার বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থান, প্রগতিশীল ভাবনা ও চিন্তক হিসেবে দেশে-বিদেশে সম্মানিত ছিলেন। তিনি বাংলাদেশের জন্য অনেক সম্মান বয়ে এনেছেন। তার মৃত্যুতে এদেশের মুক্তিবুদ্ধির চর্চার একটি অধ্যায়ের অবসান ঘটল।”

বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান বিবৃতিতে বলেন, “অধ্যাপক আনিসুজ্জামান জাতির বিভিন্ন ক্রান্তিকালে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি ছিলেন সেক্যুলার গণতান্ত্রিক চেতনার প্রতীক। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন তিনি। ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদ বিরোধী আন্দোলনে তিনি ছিলেন সামনের সারির যোদ্ধা।”

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ‘অকৃত্রিম সুহৃদ’ ছিলেন বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করেছেন দুর্নীতি বিরোধী সংস্থাটির চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ।

এক শোক বার্তায় তিনি বলেন, “দুর্নীতি দমন কমিশনের অনেক প্রতিরোধমূলক কর্মসূচিতে তার উপস্থিতি ও পরামর্শ আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করত। তার অমূল্য পরামর্শ সমাজে সততা ও নৈতিকতার বিকাশে দুদকের প্রতিরোধমূলক কার্যক্রমে প্রতিফলন ঘটত। তিনি ছিলেন দুদকের একজন অকৃত্রিম সুহৃদ।

“এ দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের অবদান জাতি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। সমাজে শুদ্ধাচার বিকাশে তার ভূমিকা ছিল অনন্য সাধারণ।”

বাংলাদেশ আইন কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক, সদস্য বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীরসহ কমিশনের অন্যান্য কমর্কর্তারা অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মৃত্যুতে শোক জানিয়ে তার আত্মার শান্তি কামনা করেছেন।

কমিশনের জ্যেষ্ঠ সচিব হাসান মো. আরিফুর রহমান ফোনে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের এই প্রয়ান জাতির জন্য  অপূরণীয় ক্ষতি। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের বাংলা ভাষ্যের রচয়িতা জাতির এই কৃতী সন্তান বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন।

“বাংলা আইন পরিভাষার সমৃদ্ধিকরণে এই মহান শিক্ষাবিদ যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করেছেন। আইন কমিশনের উদ্যোগে তার যৌথ সম্পাদনায় ‘আইন শব্দকোষ’ গ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণ বর্ধিত কলেবরে প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে।”