নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ যদি একবার এই ক্যাম্পের কারও মধ্যে ঘটে, তাহলে তা ছড়াতে সময় লাগবে না।
সেই ঝুঁকির বিষয়টি মাথায় রেখে এখন জেনেভা ক্যাম্পের সবগুলো ফটকই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, ক্যাম্প থেকে কেউ যেন বের হতে না পারে, সেজন্য রয়েছে পুলিশের পাহারা।
কিন্তু বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক ছড়ানো এই ভাইরাস সংক্রমণ এড়াতে সাধারণ যে সতর্কতা, তার কোনো বালাই দেখা গেল না এই ক্যাম্পের ভেতরে।
দোকান-পাট সবই রয়েছে খোলা, ভেতরে শিশুদের খেলাধুলাও আগের মতোই চলছে। ভিড় করেই সবাই চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। ‘গরম চা খেলে করোনাভাইরাস ধরে না’- এমন অবৈজ্ঞানিক ধারণায় চায়ের দোকানে ভিড় গেছে বেড়ে।
গজনবী রোড, বাবর রোড, শাহজাহান রোড, হুমায়ুন রোড ঘিরে অবাঙালিদের জন্য গড়ে উঠা এই জেনেভা ক্যাম্পে ঢোকা এবং বের হওয়ার মূল পথ তিনটি; এছাড়া বাসার ভেতর দিয়ে রাস্তায় উঠতে ডজনখানেক পকেট গেইট রয়েছে।
সাত বছর আগের সরকারি হিসাব বলছে, ক্যাম্পে আছে ৬ হাজার ২৫০টি পরিবার। কিন্তু এখন তা ১০ হাজারেরও বেশিই হবে। কোনো পরিবারেই চারজনের কম সদস্য নেই। ভাড়া কম হওয়ায় কযেকশ বাঙালি পরিবারও ঢুকে পড়েছে এখনে।
মোট ৯টি সেক্টরে ভাগ করা এই জেনেভা ক্যাম্পের ভেতরে রোববার ঢুকে দেখা যায়, ভাইরাস সংক্রমণ এড়াতে লকডাউনের কারণে বাইরে যে নির্জন পরিবেশ, ভেতরে তার বিপরীত। অধিকাংশ বাসার সামনে দল বেঁধে চলছে আড্ডা। চায়ের দোকান, হোটেলসহ বিভিন্ন ধরনের দোকানের সবগুলোই খোলা। পাশেই কাঁচাবাজারে চলছে হরদম কেনা বেচা।
তবে এই ক্যাম্পের চারদিকে মুল সড়ক ঘেঁষে যে সব দোকানপাট রয়েছে, তার সবগুলোই বন্ধ। বাঁশ দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে প্রবেশ এবং বের হওয়ার পথগুলো।
তবে সারাক্ষণ ঘরে থাকা যে কঠিন, সেটাও জানালেন ক্যাম্পের বাসিন্দারা।
এই ক্যাম্পের ভেতরে অপরিকল্পিতভাবে প্রচুর উঁচু ভবন গড়ে উঠেছে। আট-দশ হাত কক্ষগুলোতে ঠাসাঠাসি করে চারপাঁচজন করে থাকেন। কোনো কোনো ঘরে ‘শিফটিং’ করেও ঘুমানো হয়।
নুরুল ইসলাম বলেন, এ অবস্থায় তাদের ঘরের মধ্যে থাকাটা পুরোপুরি অসম্ভব। আড্ডা বা সময় কাটাতে এজন্য ঘরের বাইরে ক্যাম্প এলাকার মধ্যে থাকতে হয়।
এখানে একবার কারও করোনাভাইরাস সংক্রমণ হলে বিপদ যে বড়, সেটা নুরুল বোঝেন, তার মতো হাসান ও জাভেদ নামে আরও দুজন বললেন, সেটা তারাও বোঝেন, কিন্তু উপায় কী?
নাদিম আলীর বয়স ষাটের কাছাকাছি। এই জেনেভো ক্যাম্পের ৩ নম্বর সেক্টরে থাকেন। বিকালে ৫/৬জন মিলে ক্যাম্পের কাছে ভ্যানের মধ্যে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন।
করোনাভাইরাস সম্পর্কে নাদিমের একটা ধারণা হয়েছে। কিন্তু তার উপায় কেন নেই- সেই ব্যাখ্যায় বলেন, “ঘরে জোয়ান মেয়ে, ছেলের বউ আছে। রাতটা কোনো রকমে ঘরে থাকি।”
ক্যাম্পের ভেতরের কয়েকটি সড়ক ঘুরে দেখা যায়, আগের মতোই আড্ডা দিচ্ছে অনেকে, কিন্তু অধিকাংশের মুখে নেই মাস্ক, নেই দূরত্ব রাখার বালাই।
জেনেভা ক্যাম্পের কাছাকাছি হুমায়ুন রোডে অবাঙালিদের আরেকটি ক্যাম্প রয়েছে। মার্কেট ক্যাম্প নামে পরিচিত ওই ক্যাম্পের দৃশ্য একই।
শাহজাহান রোড ঘেঁষে ক্যাম্প এলাকায় একাধিক কাবারের দোকান রয়েছে। এক দোকানের কর্মচারী নভেল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ভেতরে অধিকাংশ খোলা রয়েছে। তবে এসব দোকানের অধিকাংশ গ্রাহক ক্যাম্পের বাসিন্দারাই।
তিনি বলেন, “ক্যাম্পের ভেতরটা একটা বাড়ি মনে হয়। সবাই এই বাড়ির মধ্যে চলাচল সীমাবদ্ধ রেখেছে।”
ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার ওয়াহেদুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঘরগুলোর যে অবস্থা, এখানে সামাজিক দুরত্ব থাকার বিষয়টি কাজে আসবে না। তারপরেও তাদের সতর্ক করা হচ্ছে। সচেতনতা বাড়াতে কাজ চলছে।
“সেই সাথে তারা যেন ক্যাম্প এলাকার বাইরে বের না হন, সে ব্যাপারে সতর্ক করা হচ্ছে। আমরা নজরদারি করছি। প্রয়োজনে তাদের সব কিছু সরবরাহ করা হবে।”
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ৩২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সৈয়দ হাসান নূর ইসলাম রাস্টন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এই ক্যাম্পর পুরোটাই এখন ‘একটা বাড়ি’ এবং এই বাড়ির প্রায় ৫০ হাজার সদস্যকে ‘হোম কোরেনটাইনের’ মধ্যে থাকতে বলা হয়েছে।
ক্যাম্পের ভেতরে কয়েকটি ড্রাম বসিয়ে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “তাদের অনুরোধ করা হচ্ছে ঘরে না থাকলেও যেন ক্যাম্পের বাইরে না যায়।”