মৃদু আক্রান্তদের বাড়িতেই চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব: আইইডিসিআর

প্রাণঘাতী নভেল করোনাভাইরাস নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নাই বলে জানিয়েছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 March 2020, 03:12 PM
Updated : 8 March 2020, 06:16 AM

প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেছেন, “বাড়িতে আইসোলেশন নিশ্চিত করতে পারলে মৃদু আক্রান্তদের বাড়িতে বসেই চিকিৎসা সম্ভব। সেজন্য আমরা সাবধান হব, কিন্তু আতঙ্কিত হব না।”

শনিবার করোনাভাইরাস এর সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “আক্রান্ত দেশগুলোতে এখন পর্যন্ত  সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন ৫৫ হাজারেরও বেশি রোগী। শুধুমাত্র মৃত্যুর সংখ্যার দিকে তাকিয়ে আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ছি।

“মৃত্যুর সংখ্যার চাইতে অনেক বেশি সংখ্যক মানুষ কিন্তু সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন বা যাচ্ছেন। ওই দিকটা থেকে আসলে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।”

গুজবে কান না দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “ইটালিতে আমাদের নাগরিক যিনি আইসিইউতে আছেন তিনি ছাড়া বাকিদের অন্য কোনো রোগ ছিল না। যিনি আইসিইউতে আছেন তার আগে থেকেই শ্বাসতন্ত্রের রোগ ছিল।”

করোনাভাইরাস মোকাবেলায় নিজেদের প্রস্তুতি তুলে ধরে তিনি বলেন, “সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতালে আইসোলেশন ইউনিটের ব্যবস্থা রাখতে বলা হয়েছে। অনেকে আমাদের আইসোলেশন ইউনিটের ছবি পাঠাচ্ছে। ছবি দেখে কিভাবে আরও উন্নত করা যায় সে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। তাছাড়া সিভিল সার্জন মহোদয় পরিদর্শন করে উপযুক্ত আইসোলেশন ইউনিটের ব্যবস্থা করছেন।”

বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরস শনাক্তরণ কিটের অপ্রতুলতার কথা তুলে ধরে মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, “আমাদের দুই হাজারের বেশি কিট রয়েছে। কিটের তুলনায় পরীক্ষা এখনও অনেক কম করেছি। তবে কিট আনার প্রক্রিয়া চালু আছে। কিট শেষ হয়ে গেলে আবার আসবে। পাশাপাশি এ কথাও জানা থাকা দরকার কিটের অপ্রতুলতা বা অভাব কিন্তু বিশ্বব্যাপী। কারণ ভাইরাসের ধরন জেনে কিট তৈরি করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আমাদের যেমন কিট দিচ্ছে, আমরাও বিভিন্ন মাধ্যমে কিট সংগ্রহ করছি।”

পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে আইইডিসিআরের সক্ষমতা রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এ নিয়ে কোনোরকম অনিশ্চয়তায় ভোগার অবকাশ নেই। যে ভাইরাস নিয়ে আমরা কাজ করছি সেটা অত্যন্ত ছোঁয়াচে। এই ভাইরাসটির পরীক্ষা করার জন্য খুবই উন্নত ধরনের ল্যাবরেটরি প্রয়োজন হয়। যে কোনো ল্যাবরেটরিতে এটা পরীক্ষা করা যাবে না। এটার একটা বায়ো সেফটি লেবেল আছে। যে লেবেলে না গেলে এই পরীক্ষাটি করা যাবে না।

“এরকম বায়ো সেফটি ল্যাবরেটরি সরকারি-বেসরকারি যেসব সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানে আছে তাদের সাথে আমরা যোগাযোগ করে রেখেছি। যদি কোনো কারণে সহযোগিতা নেওয়ার প্রয়োজন হয় আমরা তাদের কাছ থেকে নেব। আমাদের যে মেশিন এবং কিট রয়েছে তাতে একদিনে অনেকগুলো নমুনা সংরক্ষণ করতে পারব।”

তিনি বলেন, “প্রস্তুতির দিক থেকে বলছি, যদি অনেক রোগী হয় আমাদের যে মেশিন রয়েছে তাতে একটা মেশিনেই এক সঙ্গে ৯০টি নমুনা পরীক্ষা করা যাবে। এই পরীক্ষাটা করতে দুই থেকে তিন ঘণ্টা সময় লাগে। বিভিন্ন ধরনের এরকম মেশিন রয়েছে ৮টি। পরীক্ষা করার মত যথেষ্ট প্রস্তুতি আমাদের রয়েছে।

“তবে এই মুহূর্তে আমরা এই পরীক্ষাটি অন্য কোথাও করাতে দিতে পারব না। কারণ রোগী শনাক্ত হওয়ার পরে রোগীকে ফলো করা, কোয়ারেন্টিনে রাখা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তাই একটা জায়গা থেকে আমরা পরীক্ষা করছি। প্রতিটা রোগীর প্রতিটা কনট্যাক্ট যেন আমরা খুঁজে বের করতে পারি। স্থানীয় সংক্রমণ ঠেকাতে কনট্যাক্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”

মীরজাদী সেব্রিনা বলেন, করোনাভাইরাসে চীনসহ এ পর্যন্ত আক্রান্ত দেশের সংখ্যা ৮৯টি। ভুটান, ক্যামেরুন, সার্বিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা নতুন করে আক্রান্ত দেশের তালিকায় যুক্ত হয়েছে।

এখন পর্যন্ত সারা বিশ্বে ৯৮ হাজার ১৯২ জন আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় দুই হাজার ৮৭৩ জন নতুন রোগী যুক্ত হয়েছে।

করোনা ভাইরাসে এখন পর‌্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা ৩ হাজার ৪০০। গত ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন ৯৯ জন।

চীনের বাইরে আক্রান্ত দেশ এবং রোগীর সংখ্যা বাড়ছে জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, চীনের বাইরে রোগীর সংখ্যা ১৭ হাজার ৪৮১। তার মধ্যে ২ হাজার ৭২৭ জন গত ২৪ ঘণ্টায় সংযোজিত হয়েছে। মোট মৃত্যুর সংখ্যা ৩৩৫ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন ৬৯ জন মারা গেছেন।

দিক্ষিণ কোরিয়া, ইরান ও ইতালিতে পরিস্থিতি এখনও উদ্বেগজনক। আক্রান্ত দেশগুলোর পরিস্থিতি সার্বিক এবং নিবিড়ভাবে লক্ষ্য রাখা হচ্ছে বলে জানান আইইডিসিআর পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা।   

শুধু তাই নয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং দূতাবাসের মাধ্যমে ওইসব দেশে বাংলাদেশের নাগরিকরা কেমন অছেন, সে খবরও রাখা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা বলেন, ইতালিতে একজন, আরব আমিরাতে একজন এবং সিঙ্গাপুরে পাঁচজন বাংলাদেশি আক্রান্ত হয়েছেন।

সিঙ্গাপুরে আক্রান্ত পাঁচজনের মধ্যে তিনজন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। একজনের অবস্থা স্থিতিশীল ও একজন এখনও সঙ্কটাপন্ন বিবেচনায় আইসিসিইউতে আছেন।

ভারতে ৩১ জনের আক্রান্ত হওয়ার কথা জানিয়েছে আইইডিসিআর। গত ২৪ ঘণ্টায় সেখানে একজন আক্রান্তের খবর জানা গেছে।

তার মধ্যে দিল্লিতে তিনজন, হরিয়ানাতে ১৪ জন (সবাই বিদেশি পর্যটক), কেরালাতে তিনজন, রাজস্থানে দুজন (বিদেশি), তেলঙ্গানাতে একজন ও উত্তর প্রদেশে আটজন আক্রান্ত হয়েছেন। 

মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, “যেহেতু ভারতের সাথে আমরা সীমান্ত ভাগাভাগি করি সেহেতু ভারতের কোন অঞ্চলের কী অবস্থা সেটা আমাদের জানা দরকার।

“বাংলাদেশে ১১১ জনের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করেছি। এর মধ্যে তিনজনের নমুনা শুক্রবার সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়েছে। কারও মধ্যেই করোনাভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। এছাড়া হটলাইনের মাধ্যমে ১৯৫টি কল পেয়েছি আমরা। এর মধ্যে ১৭৮টি কলই করোনা সংক্রান্ত কল। একজন সরাসরি সেবা নিতে এসেছিলেন।”

যারা আক্রান্ত দেশে ভ্রমণ করে এসেছেন অথবা করোনা আক্রান্ত কোনো রোগীর সংস্পর্শে গেছেন এবং যাদের মধ্যে লক্ষণ, উপসর্গ দেখা দিয়েছে এমন তিনজন আইসোলেশনে আছেন বলে জানান তিনি।

গত ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ৪৮ জনকে আইসোলেশনে এনে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়েছে।তবে আইসোলেশনে থাকা তিন ব্যক্তির নমুনা সংগ্রহ করা হলেও সে নমুনার পরীক্ষা এখনও হয়নি বলে জানান তিনি। 

এক প্রশ্নে সংবাদ সম্মেলনে সরকারের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের পরিচালক মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, “গত মাসের শুরু থেকে আমরা প্রস্তুতি শুরু করেছি। দেশের সকল হাসপাতালে আইসোলেশন বেড প্রস্তুত রাখার নির্দেশ দিয়েছি। কিভাবে অইসোলেশন বেড হবে, বেডের ডিসটেন্স কত হবে ইত্যাদি সব নির্দেশনা আমরা দিয়েছি।

“শুধু তাই না, আমাদের বড় একটি স্টেকহোল্ডার হচ্ছে প্রাইভেট সেক্টর। প্রাইভেট সেক্টরকেও নির্দেশনা দিয়েছি। ক্লিনিকগুলোকে ডেকে একাধিকবার আমরা সভা করেছি। তাদের মাধ্যমে আমরা চেষ্টা করছি সারা দেশে যেসব বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক আছে, বেডওয়াইজ আইসোলেশন ইউনিট নির্ধারণ করে দিতে।”

রোববার ঢাকার সব বড় বড় হাসপাতালের সঙ্গেও আলোচনা হবে জানান তিনি।