‘সময়ক্ষেপণে’ আটকে হুমায়ুন আজাদ হত্যার বিচার

দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা হুমায়ুন আজাদ হত্যা মামলা বিচার শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছে বলে গতবছর জানিয়েছিলেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা। তারপর কেটে গেছে আরও একটি বছর; বিচারের অপেক্ষা ১৬ বছরেও ফুরায়নি।

প্রকাশ বিশ্বাসপ্রকাশ বিশ্বাসবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Feb 2020, 04:38 AM
Updated : 28 Feb 2020, 04:38 AM

মামলার বাদী হুমায়ুন আজাদের ছোট ভাই মঞ্জুর কবির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিচার হবে না এটা দাদাও জানতেন। মারা যাওয়ার আগে সবাইকে বলে গিয়েছিলেন কেন দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে এ মামলার অভিযোগপত্র থেকে অব্যাহতি দেওয়া হল।”

গতবছর ৬ মে আসামিদের আত্মপক্ষ শুনানি শেষে ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মাকছুদা পারভীন এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক শুনানির জন্য ১৭ জুন দিন ঠিক করে দেন।

রাষ্ট্রপক্ষের অন্যতম কৌঁসুলি বিপুল দেবনাথ সেদিন বলেছিলেন, “দীর্ঘ প্রতীক্ষিত এ মামলার বিচার অবশেষে শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছে। যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে আদালত রায়ের তারিখ ঠিক করে দেবে। আশা করছি, শিগগিরই এ মামলার রায় হবে।”

যুক্তিতর্ক শুনানির তারিখ কয়েক দফা পিছিয়ে ৩০ সেপ্টেম্বরে গেলে সেদিন দুই আসামির পক্ষ থেকে সাফাই সাক্ষ্য দেওয়ার আবেদন করা হয়। বিচারক সাফাই সাক্ষ্যের জন্য ২০ অক্টোবর দিন রাখেন।

এই দুই আসামি হলেন জেএমবির শূরা সদস্য মিজানুর রহমান ওরফে মিনহাজ ওরফে শফিক এবং আনোয়ার আলম ওরফে ভাগ্নে শহিদ।

এরপর চলে গেছে আরও চার তারিখ। কিন্তু আসামিপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে না পেরে বার বার সময় চেয়েছে।

সর্বশেষ গত ১৩ ফেব্রুয়ারি মামলার ধার্য তারিখেও মিজানুর রহমানের পক্ষে সাক্ষ্য পেছানোর আবেদন করেন তার আইনজীবী। পরে বিচারক সাফাই সাক্ষ্য শোনার জন্য ৮ এপ্রিল দিন রাখেন।

বিচার শেষ হতে বিলম্বের কারণ জানতে চাইলে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি বিপুল দেবনাথ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শেষ পর্যায়ে এসে সাফাই সাক্ষ্য দেবে বলে বিচার বিলম্বিত করার চেষ্টা করছে আসামিপক্ষ। আমরা রাষ্ট্রপক্ষ থেকে সাফাই সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য বার বার সময় চাওয়ার বিরোধিতা করছি।”

এ বিষয়ে কথা বলতে মিজানুর রহমানের পক্ষে মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবী ফারুক আহাম্মাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি দাবি করেন, মামলাটি তিনি ছেড়ে দিয়েছেন। ভাগ্নে শহীদের আইনজীবী মো. নাজম উদ্দিন জাহেদও দাবি করেন, তিনিও এখন মামলাটি পরিচালনা করেন না।

ওই দুই আসামির পক্ষে কে তাহলে মামলা পরিচালনা করছেন, সে তথ্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জানতে পারেনি। 

২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির রাতে বাংলা একাডেমির উল্টো পাশের ফুপপাতে আক্রান্ত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক হুমায়ুন আজাদ, যিনি তার লেখার জন্য সাম্প্রদায়িক শক্তির হুমকি পেয়ে আসছিলেন। একুশে বইমেলা থেকে ফেরার পথে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে তাকে জখম করা হয়।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় ওই হামলার ঘটনায় বিক্ষোভে ফেটে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা। কয়েক সপ্তাহ আন্দোলনের এক পর্যায়ে হামলাকারীদের গ্রেপ্তার ও শাস্তি দাবিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি দিতে গেলে আন্দোলনকারীদের ওপর চড়াও পুলিশ, আহত হন বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী।

চরমপন্থী ইসলামী জঙ্গিরা হুমায়ুন আজাদের ওপর ওই হামলা চালিয়েছিল বলে পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে।

কয়েক মাস চিকিৎসা নেওয়ার পর ২০০৪ সালের অগাস্টে গবেষণার জন্য জার্মানিতে যান এই লেখক। ওই বছর ১২ অগাস্ট মিউনিখে নিজের ফ্ল্যাট থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়।

হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলার পরদিন তার ছোট ভাই মঞ্জুর কবির রমনা থানায় একটি হত্যাচেষ্টা মামলা করেন। পরবর্তীতে আদালতের আদেশে অধিকতর তদন্তের পর সেই মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হয়।

সিআইডির পরিদর্শক লুৎফর রহমান মামলাটি তদন্তের পর ২০১২ সালের ৩০ এপ্রিল পাঁচজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন।

মো. মিজানুর রহমান মিনহাজ ওরফে শফিক ওরফে শাওন ওরফে হামিম ওরফে হাসিম, আনোয়ারুল আলম ওরফে ভাগ্নে শহীদ, নূর মোহাম্মদ শামীম ওরফে জে এম মবিন ওরফে সাবু, সালেহীন ওরফে সালাউদ্দিন ওরফে সজীব ওরফে তাওহিদ এবং হাফিজ মাহমুদ ওরফে রাকিব ওরফে রাসেলকে সেখানে আসামি করা হয়।

২০১২ সালের ১০ সেপ্টেম্বর তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেয় আদালত।

আসামিরা নিষিদ্ধ সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের (জেএমবি) বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা। তাদের মধ্যে মিনহাজ ও আনোয়ার কারাগারে আটক রয়েছেন। নূর মোহাম্মদ শুরু থেকেই পলাতক।

সালাহউদ্দিন সালেহীন ও হাফিজ মাহমুদ গ্রেপ্তার হলেও ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ত্রিশালে প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে তাদের ছিনিয়ে নিয়েছিল জঙ্গিরা। সালেহীন পালিয়ে যেতে পারলেও হাফেজ মাহমুদ পুলিশের হাতে আটক হওয়ার পর কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন।

হুমায়ুন আজাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ওয়াজে বিষোদগার করা যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে প্রথমে এ মামলার আসামি করা হলেও পরে তার নাম বাদ দেওয়া হয়।