রুম্পার মৃত্যু ঘিরে রহস্য কাটেনি

ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী এলাকা থেকে স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রুবাইয়াত শারমিন রুম্পার লাশ উদ্ধারের পর দুই দিন পেরিয়ে গেলেও উত্তর মেলেনি অনেক প্রশ্নের। 

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Dec 2019, 06:04 PM
Updated : 3 Jan 2020, 01:52 PM

এ ঘটনায় হত্যা মামলা দায়ের করে সেভাবেই তদন্ত চালাচ্ছে পুলিশ। কিন্তু বুধবার রাতে টিউশনি সেরে শান্তিবাগের বাসার নিচে গিয়ে ২০ বছর বয়সী ওই তরুণী কেন কানের দুল, আংটি আর মোবাইল ফোন রেখে গিয়েছিলেন,  কেন তিনি আবার আধা কিলোমিটার দূরে সিদ্ধেশ্বরী সার্কুলার রোডে গিয়েছিলেন, সেসব প্রশ্নের উত্তর না মেলায় রহস্য আরও ঘনীভূত হয়েছে।  

রুম্পার ভাই আশরাফুল আলমের সন্দেহ, এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। আর রুম্পার সাবেক প্রেমিককে নিয়ে সন্দেহের কথা বলেছেন তার সহপাঠী এক বান্ধবী।   

সুবিচারের দাবিতে শুক্রবার সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন করেছেন স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। রুম্পাকে হত্যা করা হয়েছে অভিযোগ করে তারা সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের দাবি জানিয়েছেন।

ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা জোনের সহকারী কমিশনার এসএম শামীম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হত্যার সম্ভাবনা মাথায় রেখেই তদন্ত চলছে। এরই মধ্যে অর্ধশত ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে। কিন্তু হত্যা না আত্মহত্যা- সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হবে।”

পুলিশ পরিদর্শক রোকনউদ্দিনের দুই সন্তানের মধ্যে বড় মেয়ে রুম্পা স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছিলেন। আর তার ভাই আশরাফুল খিলগাঁও আইডিয়াল কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র।

চাকরির কারণে পুলিশ কর্মকর্তা রোকনউদ্দিন থাকেন হবিগঞ্জে। আর তার পরিবারে থাকে ঢাকার মালিবাগে শান্তিবাগের বাসায়।

বুধবার রাতে বাসা থেকে আধা কিলোমিটার দূরত্বে আয়েশা শপিং কমপ্লেক্সের পেছনে সিদ্ধেশ্বরী সার্কুলার রোডের এক গলি থেকে রুম্পার লাশ উদ্ধার করা হয়। আশপাশের কোনো ভবন থেকে পড়ে ওই তরুণীর মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা করলেও সেই রাতে তাকে শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ।

ঢাকার স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী রুবাইয়াত শারমিন রুম্পা ‘হত্যার’ বিচারের দাবিতে শুক্রবার সিদ্ধেশ্বরীতে প্রধান ক্যাম্পাসের সামনে শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন।

ঘটনাটি রহস্যজনক হওয়ায় রমনা থানার এসআই আবুল খায়ের সেই রাতেই অজ্ঞাতপরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মর্গে গিয়ে রুম্পার লাশ শনাক্ত করেন স্বজনরা।

পরিবারের সদস্যরা জানান, দুটো টিউশনি করতেন রুম্পা। সেদিনও সন্ধ্যার আগে বাসা থেকে টিউশনিতে বের হন। পরে সাড়ে ৬টার দিকে শান্তিবাগের বাসার নিচে এসে ফোন করে পুরানো একজোড়া স্যান্ডেল পাঠিয়ে দিতে বলেন।

তার কথায় ক্লাস টু পড়ুয়া চাচাতো ভাই এক জোড়া স্যান্ডেল নিয়ে বাসার নিচে যায়। রুম্পা তার পায়ে থাকা স্যান্ডেল জোড়া বদলে পুরনো স্যান্ডেল পরেন। এরপর কানের দুল, আংটি, মোবাইল ফোন আর সেই স্যান্ডেল চাচাতো ভাইকে দিয়ে আবার বেরিয়ে যান।

এর কয়েক ঘণ্টা পর সিদ্ধেশ্বরী সার্কুলার রোডে ৬৪/৪ নম্বর বাসার নিচে লাশ পায় পুলিশ। অন্যদিকে রুম্পা বাসায় না ফেরায় এবং তার কাছে ফোন না থাকায় পরিবারের সদস্যদের রাত কাটে উদ্বেগের মধ্যে। পরদিন তারা রমনা থানায় গিয়ে ছবি দেখে রুম্পাকে শনাক্ত করেন।

রমনা থানার ওসি মনিরুল ইসলাম  বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রুম্পাকে হত্যা করা হয়েছে কি না- সে সম্ভাবনা মাথায় রেখেই তদন্ত চলছে। কিন্তু তার স্যান্ডেল, মোবাইল, কানের দুল, আংটি বাসায় ফেরত পাঠানোর বিষয়টি আমাদের বেশ ভাবিয়ে তুলেছে।”

মামলার বাদী রমনা থানার এসআই আবুল খায়ের বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, রুম্পার মাথা, বুকসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় জখমের চিহ্ন ছিল। মেরুদণ্ড ছিল ভাঙ্গা, ডান পায়ের গোড়ালিও ভেঙে গেছে। দুই হাতে জখম ছিল, নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বের হতে দেখা গেছে। এসব তথ্য সুরতহাল প্রতিবেদনেও লেখা হয়েছে।

রুম্পার লাশের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সোহেল মাহমুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে উঁচু জায়গা থেকে পড়ে তার মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর আগে ধর্ষণের মত কিছু ঘটেছে কি না- তা জানতে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হচ্ছে। পরীক্ষার ফল পাওয়ার পরেই ময়নাতদন্তের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।”

সহকারী পুলিশ কমিশনার এসএম শামীম বলেন, রাস্তার যে জায়গায় রুম্পার লাশ পড়েছিল, তাতে আয়েশা শপিং কমপ্লেক্সসহ তিনটি ভবনের যে কোনো একটি থেকে সে পড়ে থাকতে পারে।

“ওই তিনটি ভবনের প্রতিটি ফ্লোরে গিয়ে বাসিন্দাদের সাথে আমাদের কথা হয়েছে। তারা কেউ মেয়েটিকে চিনতে পারার কথা বলেনি। সেখানে তার কোনো আত্মীয়র বাসাও নেই। দুই-একজন কেবল বলেছেন, ভারী কিছু নিচে পড়ার মত একটা শব্দ তারা শুনেছেন। তবে বিস্তারিত কিছু জানেন না।”

ঢাকার স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী রুবাইয়াত শারমিন রুম্পা ‘হত্যার’ বিচারের দাবিতে শুক্রবার সিদ্ধেশ্বরীতে প্রধান ক্যাম্পাসের সামনে শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন।

তিনটি ভবনের ছাদে সরাসরি যাওয়ার সুযোগ ছাড়াও একটি ভবনের ৫ ও ৮ তলা দিয়ে নিচে পড়ার সুযোগ রয়েছে জানিয়ে শামীম বলেন, “রুম্পা ভবন থেকে পড়ে মারা গেছে, না নির্যাতনের পর লাশ ফেলে দেওয়া হয়েছে- সেটা তদন্ত শেষ না করে বলা মুশকিল।”

এই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ওই ভবনগুলো ও আশপাশে থাকা সিসি ক্যামেরার ভিডিও তারা সংগ্রহ করেছেন। তাছাড়া রুম্পার মোবাইল ফোনও পরীক্ষা করা হচ্ছে। কাছাকাছি সময় কাদের সঙ্গে তার ফোনে কী কথা হয়েছে, সে বিষয়গুলোও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। 

রুম্পার বান্ধবী স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী একটি টেলিভিশনকে বলেছেন, একটি ছেলের সঙ্গে রুম্পার প্রেমের সম্পর্ক ছিল গত কয়েক মাস। কিন্তু সম্প্রতি তাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়। এ নিয়ে টানাপড়েন ছিল। 

কথিত সেই সাবেক প্রেমিকের সঙ্গে ফোনে কথা বলে তার একটি অডিও প্রচার করা হয়েছে সময় টেলিভিশনের খবরে। সেখানে বলা হয়, ঘটনার দিনও রুম্পার সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল।

“৪ তারিখে আমার একটা ফ্রেন্ডের বার্থডে ছিল। আমাকে ইনভাইট করা হয়েছিল আমাদের ফ্রেন্ডের মাধ্যমে। দেন আমি ওইখানে গেছিলাম আর কি। আমি তো রুম্পাকে বুঝায়ে বলছি যে আমাদের মধ্যে রিলেশন সম্ভব না।”

যে ভবনের নিচে রুম্পার লাশ পাওয়া গেছে, ওই ভবনের নিচতলা ও তৃতীয় তলায় স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন শিক্ষার্থী মেস করে থাকেন। উল্টো দিকে থাকা ভবনে ছাত্রী হোস্টেলেও স্ট্যামফোর্ডের কয়েকজন শিক্ষার্থী থাকেন। তবে কারও কাছ থেকেই কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।     

রুম্পার ভাই আশরাফুল বলেন, শুক্রবার ময়মনসিংহ সদরের বিজয়নগরে তাদের গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়েছে তার বোনকে।

সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে এর বিচার চেয়ে এই কলেজছাত্র বলেন, “এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। আমার বোন সিদ্ধেশ্বরীর ওই জায়গায় গেল কেন? এর সঙ্গে ওর সহপাঠী কেউ জড়িত থাকতে পারে। পুলিশ সঠিকভাবে তদন্ত করলে বিষয়টি বেরিয়ে আসবে।”