ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে শুধু আপিল বিভাগে তালিকাভুক্ত আইনজীবীদেরই আদালত কক্ষে ঢুকতে দেওয়ার ব্যবস্থা নিতে প্রধান বিচারপতির কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।
খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন না আসায় সকালে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে ছয় বিচারকের আপিল বেঞ্চ জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় তার জামিন প্রশ্নে শুনানি এক সপ্তাহ পিছিয়ে দেয়।
তখন থেকে জামিন আবেদনের শুনানি এগিয়ে আনার দাবিতে বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা প্রায় তিন ঘণ্টা আপিল বিভাগের এজলাস কক্ষে অবস্থান নিয়ে তুমুল হট্টগোল করেন; তারা স্লোগান দেন- ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’, ‘বেইল ফর খালেদা জিয়া’।
বিশৃঙ্খলার মধ্যে আর কোনো মামলার কার্যক্রম চালানো যায়নি। পুরোটা সময় আদালতকক্ষ থেকে বের হতে বা নতুন করে কাউকে ঢুকতে বাধা দেন বিএনপি সমর্থক আইনজীবীরা। বার বার চেষ্টা করেও বিচারকাজ শুরু করতে না পেরে বেলা সোয়া ১টার দিকে এজলাস থেকে নেমে যান বিচারপতিরা।
বিশৃঙ্খলায় ক্ষুব্ধ প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেন, এটা ‘নজিরবিহীন’, ‘বাড়াবাড়ির’ একটা সীমা থাকা দরকার।
ঘটনার বিবরণ দিয়ে তিনি বলেন, “সকাল ৯টায় আদালত বসেছে। তাদের আইটেমটা যখন মুলতবি করা হয়েছে আগামী বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তারপরে তারা যে আচরণ করেছেন, এটা অভাবনীয় এবং ফ্যাসিবাদী আচরণ।”
খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা আদালত কক্ষে বসে থেকে ‘কেউ এটা থামানোর চেষ্টা করেননি’ জানিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “কিছু আইনজীবী যারা এই আদালতে অপরিচিত তারা আদালতে শ্লোগান, হট্টগোল, গণ্ডগোল করে সোয়া ১টা পর্যন্ত আদালত বসে ছিলেন, অন্যান্য আইনজীবীরা বসে ছিলেন। তারা আদালতের কাজে বাধা সৃষ্টি করেছেন।
“এই হট্টগোল করে, শ্লোগান দিয়ে আদালতের কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করা চরম ফ্যাসিবাদী একটা কাজ। এভাবে শ্লোগান দিয়ে, হট্টগোল করে জবরদস্তি করে আদালতের ওপর চাপ সৃষ্টি করার প্রয়াস।”
“একটা অপরাধী অপরাধ করেছেন, তার বিচার হবে। বিচারে আদালত যদি মনে করে জামিন দিবে বা জামিন দিবে না। কিন্তু আদালতের সামনে গিয়ে এ রকম শ্লোগান, হট্টগোল করে আদালতের কাজে বাধার সৃষ্টি করার মতো চরম ফ্যাসিবাদী কাজ আর হয় না।”
রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা বলেন, “প্রধান বিচারপতির কাছে অনুরোধ করব, এই আদালতে (আপিল বিভাগে) যারা তালিকাভুক্ত শুধুমাত্র তাদেরকেই যাতে ঢুকতে দেওয়া হয়। যাতে আদালতে এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে। বিচার বিভাগের মর্যাদা আমরা সমুন্নত রাখব যে কোনো মূল্যে।”
সংবাদ সম্মেলনে বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান ও বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের আহ্বায়ক ইউসূফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, “বিএনপি যে আইনের শাসনে বিশ্বাস করে না আজকে তার প্রমাণ হয়েছে। আমি জীবনে বিশ্বাস করি নাই সুপ্রিম কোর্টের ভিতরে ঢুকে তারা এ ধরনের আচরণ করবে। তারা যে আচরণ করেছে তা অত্যন্ত দুঃখজনক।
বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের সদস্য সচিব ও সংসদ সদস্য ফজলে নূর তাপস বলেন, “আজকে আদালতে যে ঘটনা ঘটেছে তা বিচারকে প্রভাবিত করার জন্য। বিএনপি গোষ্ঠী জোরপূর্বক জামিন আদায়ের চেষ্টা নিয়েছে বা চেষ্টা তারা করেছে। এর মাধ্যমে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, বেগম খালেদা জিয়া আসলেই অসুস্থ না। তাদের এই ন্যক্কারজনক কর্মকাণ্ডে এটাই বোঝা যাচ্ছে, তিনি আসলে অসুস্থ না, জোরপূর্বকভাবে জামিন আদায় করবে বিচারলায় থেকে।”
ঘটনার নিন্দা জানিয়ে তাপস বলেন, “আমরা মনে করি এবং বিশ্বাস করি, আইনের শাসন সর্ব ঊর্ধ্বে। এই আইনাঙ্গনকে যখনই কলুষিত করার চেষ্টা নেওয়া হয়েছে আমরা তার দাঁতভাঙা জবাব দিয়েছি, আমরা তার প্রতিবাদ করেছি ও প্রতিরোধ করেছি।
“কিন্তু তারা (বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা) এজলাসে প্রধান বিচারপতিসহ পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে এই নজিরবিহীন ঘটনা ঘটিয়েছে, তরা আদালত কক্ষে শ্লোগান দিয়েছে, তারা বিশৃঙ্খলা করেছে এবং বিচারের পরিবেশ বিনষ্ট করেছে।
“ভবিষ্যতে যাতে এ রকম ন্যক্কারজনক ঘটনার অবতারণা না ঘটে তার জন্য প্রশাসনকে আমরা অনুরোধ করব, তারা যেন সমুচিত ব্যবস্থা নেয়। এবং আমরা আইনজীবীরা সমুচিত জবাব দেওয়ার জন্য আমরাও ব্যবস্থা নিব এবং আমরা প্রস্তুত থাকব।”
সাবেক আইনমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরু বলেন, “সুপ্রিম কোর্টের মালিক এই দেশের মানুষ। দেশের মানুষের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। সুপ্রিম কোর্টের পবিত্রতা, নিরপেক্ষতা, ভাবমূর্তি রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের সকলের। সুপ্রিম কোর্টে তারা যে আচরণ করেছে, তারা সমস্ত সুপ্রিম কোর্ট বন্ধ করে রেখেছে।
“তারা আদালতের কাজে বাধা দিয়ে আদালত অবমাননার অপরাধ করেছেন, এটা শাস্তিযোগ্য। মাননীয় প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন করতে চাই, ভবিষ্যতে না, এই ঘটনার জন্য যারা দায়ী তাদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে আনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হোক। না হলে ভবিষ্যতেও তারা এ রকম ধৃষ্টতাপূর্ণ কাজ করবে। আগামী তারিখে একই ঘটনা করবে।”
খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “সর্বশেষ আশ্রয় স্থলকে ধ্বংস করার অধিকার কারও নাই। জোর করে খালেদা জিয়ার জামিন নেওয়া যাবে? আপনারা অপেক্ষা করুন, শুনানি করুন, আস্থা রাখুন। কিন্তু তারা আদালত অবমাননা করেছেন। যে ঘটনা করেছেন তার ধিক্কার জানানোর ভাষা আমাদের নেই।”
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এম আমিন উদ্দিন বলেন, “আমি কোনো দিন এ ধরনের ঘটনা দেখিনি। এটা ন্যক্কারজনক, নিন্দনীয় ঘটনা। আদালতকে আদালতের কাজ পরিচালনা করতে বাধা সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে নিন্দনীয়ভাবে তারা কাজ করে গেছে। দুর্ভাগ্যজনক হল, যারা এ ধরনের কাজ করল তারা কিন্তু অধিকাংশই এই আদালতের আইনজীবী না। তারা বহিরাগত, তাদের নিয়ে আসা হয়েছে।”
ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে সেজন্য এই ঘটনায় জড়িতদের আদালত থেকে বহিষ্কারের দাবি জানান তিনি।
“তারা যদি বাংলাদেশের আইনজীবী হন তাহলে তাদেরকে আইন পেশা থেকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বহিষ্কার না করলে এ ধরনের অন্যায়ের প্রতিকার করা যাবে না। বিচার চাওয়া তাদের অধিকার আর জামিন দেওয়া আদালতের এখতিয়ার।”
আগামী দিনও এ ধরনের পরিস্থিতির আশঙ্কা থাকলে জামিন আবেদনের শুনানি বন্ধ রাখারও অনুরোধ করেন আইনজীবী সমিতির সভাপতি।
তিনি বলেন, “তারা (খালেদার আইনজীবীরা) বলছে জামিন ছাড়া কাজ করা যাবে না। তাদের কথামতো কাজ না হলে আদালতকে তারা বসতে দেবে না, কাজ করতে দেবে না, এই ধরনের মনোভাব নিন্দনীয়।
“ভবিষ্যতে এই ধরনের কাজ করলে আমরা অনুরোধ করব, এই মামলার শুনানি না করার জন্য। আদালতে সঠিক ব্যবহার না করা পর্যন্ত মামলার শুনানি বন্ধ রাখার জন্য আমি আদালতের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি।”