‘অপহরণের পর নিহত’ শিশুকে জীবিত মিলল ৫ বছর পর

পাঁচ বছর আগে ঢাকার হাজারীবাগ থানায় একটি শিশু অপহরণের পর হত্যার অভিযোগে মামলা হলে তদন্তে নেমেছিল ডিবি পুলিশ; তাতে গ্রেপ্তার আসামিরা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দেন বলে বলেও জানানো হয়েছিল। কিন্তু পাঁচ বছর পর অন্য একটি মামলার তদন্তে ওই শিশুটিকে জীবিত পেল থানা পুলিশ।

প্রকাশ বিশ্বাসপ্রকাশ বিশ্বাস আদালত প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Sept 2019, 04:46 AM
Updated : 1 Sept 2019, 05:59 AM

ওই শিশুটি, তার মা, বাবা ও ফুফাকে এখন প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ আদায়ের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শনিবার আদালতের মাধ্যমে তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজতেও নেওয়া হয়েছে।

‘অদ্ভুত’ এই ঘটনায় পুলিশের তদন্তের অসারতা ও অপকর্মের বিষয়টি ধরা পড়েছে মন্তব্য করে জড়িতদের শাস্তি চেয়েছেন সংশ্লিষ্ট এক আইনজীবী।

২০১৪ সালের ১৭ এপ্রিল পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্র হারিয়ে গেছে উল্লেখ করে হাজারীবাগ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়। ওই জিডির পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ৭ জুলাই এক নারীসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) এবং জানায়, শিশুটিকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়েছে।

জিজ্ঞাসাবাদের পর দুই আসামি আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। তাদের দুজনের দেওয়া জবানবন্দির ভিত্তিতে ডিবি জানিয়েছিল, শিশুটিকে বরিশালগামী লঞ্চ থেকে মেঘনা নদীতে ফেলে হত্যা করা হয়েছে।

বরিশালের হিজলা থেকে তখন সোনিয়া আক্তার, তার ভাই আফজাল, ফুফাতো ভাই সাইফুল ও আরেক আত্মীয় শাহীন রাজিকে গ্রেপ্তার করে এবং তাদের আসামি করে অভিযোগপত্রও দেন ডিবির এসআই রুহুল আমিন।

এরপর অপহরণের পর হত্যামামলায় রূপান্তরিত হয় জিডিটি। মামলাটি ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৫ এ বিচারাধীন। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য আগামী ৫ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য রয়েছে।

তার আগেই হাজারীবাগ থানা পুলিশের তদন্তে উন্মোচিত হল যে শিশুটিকে অপহরণের পর হত্যার ঘটনাটি সাজানো এবং শিশুটি বেঁচেই আছে।

ওই মামলার আসামি সোনিয়ার এক মামলার তদন্তে ওই শিশুটি তার বাবা মোহাম্মদ আজম, মা মাহিনুর বেগম এবং আব্দুল জব্বার নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে শনিবার আদালতে হাজির করেন হাজারীবাগ থানার এসআই লন্ডন চৌধুরী।

তিনি সব আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৫ দিনের জন্য হেফাজতে চাইলেও মহানগর হাকিম নিভানা খায়ের জেসি দুদিন রিমান্ডের আদেশ দেন বলে সোনিয়ার আইনজীবী আইনজীবী ওয়াহিদুজ্জামান জানিয়েছেন।

রিমান্ড আবেদনে বলা হয়, আসামিরা পরস্পর যোগসাজসে সোনিয়ার কাছ থেকে অর্থ আদায়ের জন্য আবু সাঈদ অপহরণ না হওয়া সত্ত্বেও অপহরণের নাটক সাজায়।

আবেদনে বলা হয়, আসামিরা সোনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করে ১০ লাখ টাকা দিলে মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার ব্যবস্থা করার প্রতিশ্রুতি দেয়। সোনিয়া বিষয়টি তার আত্মীয়-স্বজন এবং তার এলাকার বিহঙ্গ পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাসির উদ্দিন খোকনকে জানান। নাসির উদ্দিনের মাধ্যমে ২০১৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ৫ লাখ ৫ হাজার টাকা আসামিদের দেন। শিশুটিকে (এজহার অনুযায়ী অপহরণের পর হত্যাকাণ্ডের শিকার) নিয়ে এলে আরও ২ লাখ টাকা দেবেন বলেও জানান।

“তখন আসামিরা আবু সাঈদকে সঙ্গে নিয়ে নাসির উদ্দিনের  বাসায় যান। আসামিদের বসিয়ে রেখে পল্লবী থানায় জিডি করা হয়। পরে আসামিদের আটক করে পল্লবী থানা হতে হারাজীবাগ থানায় হস্তান্তর করা হয়।”

কেন সোনিয়াকে এই ঘটনায় ফাঁসানো হয়েছিল- এই প্রশ্নে সোনিয়া তার সাবেক স্বামী মিরাজ হোসেনকে দায়ী করেন।

তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ২০১৪ সালে মিরাজকে বিয়ে করার পর তার আরেকটি বিয়ের কথা জানতে পেরে তালাক দেন। এতে মিরাজ ক্ষুব্ধ হয়ে ডিবি পুলিশ ও আজমসহ অন্যদের দিয়ে তার বিরুদ্ধে অপহরণ ও খুনের নাটক সাজায়।

এই নারী বলেন, “এ মামলায় আমিসহ অন্যরাও দীর্ঘ প্রায় তিন বছর কারাভোগ করেছি। আমি এবং আমার ভাই ও অন্য স্বজনদের ডিবি অফিসে নিয়ে নির্মম নির্যাতন করা হয়েছে। আমরা তাদের শিখিয়ে দেওয়া স্বীকারোক্তি আদালতে দিতে বাধ্য হয়েছি।”

সোনিয়া এখন সাবেক স্বামী মিরাজসহ শিশুটির পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন, ওই মামলায় চারজনকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে রিমান্ডে নিয়েছে হাজারীবাগ থানা পুলিশ।

সোনিয়ার আইনজীবী ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, ভুয়া অভিযোগে অভিযোগপত্র দেওয়ায় ডিবির এসআই রুহুল আমিনের শাস্তি দাবি করে বলেন, “এ পুলিশ কর্মকর্তার দুষ্কর্মের তদন্ত হওয়া উচিৎ। তিনি আসামিদের কয়েক সপ্তাহ বিনা বিচারে আটকে রেখে পিটিয়ে দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দিতে বাধ্য করেছিলেন।”

আগের মামলাটির যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য নির্ধারিত দিনে আদালতে সর্বশেষ অগ্রগতি তুলে ধরবেন জানিয়ে ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, “আমি বলব, ‘খুন হওয়া’ সেই শিশুকে পাওয়া গেছে। এছাড়া যারা নির্দোষ, তাদের এভাবে অত্যাচারেরও বিচার চাইব।”