বাংলাদেশে আসছে অর্ধেক শক্তির ফণী

ভারতের ওড়িশা উপকূলে উঠে আসার পর বৃষ্টি ঝরিয়ে ফণী দুর্বল হয়েছে অনেকটা, ‘অতি প্রবল’ থেকে পরিণত হয়েছে ‘প্রবল’ ঘূর্ণিঝড়ে। পশ্চিমবঙ্গ পেরিয়ে আসার পথে আরও দুর্বল হয়ে এই ঘূর্ণিঝড় শনিবার ভোরের দিকে বাংলাদেশে পৌঁছাতে পারে বলে দেশের আবহাওয়া অফিসের ধারণা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 May 2019, 07:29 PM
Updated : 25 Dec 2019, 01:17 PM

আবহাওয়ার বুলেটিন এবং আমাদের সংবাদকর্মীদের পাঠানো তথ্য থেকে এক নজরের জেনে নিন ঘূর্ণিঝড়ের সর্বশেষ খবর।

# উপকূল অতিক্রম: ভারতের স্থানীয় সময় শুক্রবার সকাল ৮টার দিকে ঘূর্ণিঝড় ফণী তীর্থ নগরী পুরীর ২৫ কিলোমিটার দক্ষিণ দক্ষিণপশ্চিমে গোপালপুর আর চাঁদবালির মাঝামাঝি এলাকা দিয়ে ওড়িশা উপকূল অতিক্রম করতে শুরু করে। প্রায় ৩০০ কিলোমিটার ব্যাসের ঘূর্ণিঝড় ফণীর চোখ পুরোপুরি উপকূলে উঠে আসতে সময় লাগে পুরো দুই ঘণ্টা।

# শক্তি: উপকূলে আঘাত হানার সময় বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৭৫ থেকে ১৮৫ কিলোমিটার, যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ১৯৫ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এরপর বৃষ্টি ঝরিয়ে ক্রমশ দুর্বল হতে থাকবে ফণী। বাংলাদেশ সময় রাত ১২টার পর বাতাসের গতিবেগ নেমে আসে ৯০ থেকে ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে।

# অবস্থান: ওড়িশা উপকূল অতিক্রম করার পর উত্তর-উত্তরপূর্বে পশ্চিমবঙ্গের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল ফণী। বাংলাদেশ সময় রাত ১২টায় অবস্থান করছিল কলকাতা থেকে প্রায় দেড়শ কিলোমিটার দূরে।

 

# কখন কীভাবে বাংলাদেশে: আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, আরও উত্তর-উত্তর পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে শনিবার ভোর নাগাদ ফণী বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পৌঁছাতে পারে।

তবে ভারতীয় আবহাওয়াবিদদের হিসাবে, ফণী বাংলাদেশের প্রবেশ করতে পারে শনিবার সন্ধ্যার দিকে। তখন বাতাসের গতিবেগ থাকতে পারে ঘণ্টায় ৬০ থেকে ৭০ কিলোমিটার, যা ৮০ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে। অর্থাৎ, তখন ফণী থাকবে ঘূর্ণিঝড়ের পর্যায়ে।

জয়েন্ট টাইফুন ওয়ার্নিং সেন্টার এবং ওয়েদার ব্লগ উইন্ডির সিমুলেশন বলছে, ফণীর কেন্দ্র বা চোখ বাংলাদেশের সীমানায় প্রবেশ করবে মেহেরপুর-রাজশাহী অঞ্চল দিয়ে। এরপর রংপুর অঞ্চলের ওপর দিয়ে পার হতে হতে আরও দুর্বল হয়ে ফণী পরিণত হবে স্থল নিম্নচাপে।

# সংকেত: ঘূর্ণিঝড়ের কারণে বাংলাদেশের মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরকে ৭ নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা জেলা এবং সংলগ্ন দ্বীপ ও চরগুলো ৭ নম্বর বিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে।

চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরকে ৬ নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলেছে আবহাওয়া অফিস। চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর এবং নিকটবর্তী দ্বীপ ও চরগুলো ৬ নম্বর বিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে।

আর কক্সবাজার সমুদ্র বন্দরকে আগের মতই ৪ নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।

 

# সতর্কতা:

>> আবহাওয়া অফিস বলছে, ঘূর্ণিঝড় ও অমাবস্যার প্রভাবে উপকূলীয় জেলা চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর, বরগুনা, ভোলা, পটুয়াখালী, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা এবং অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরাঞ্চল স্বাভাবিকের চেয়ে ২ থেকে ৪ ফুট বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে।

>> ফণীর প্রভাবে ভারতের অন্ধ্র ও ওড়িশা উপকূলে প্রবল বৃষ্টি হয়েছে, সেই সঙ্গে ঘূর্ণিবাতাসের তাণ্ডব। বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে ঝড়ের অগ্রবর্তী অংশের প্রভাব পড়েছে সকালের দিকেই। রাজধানী ঢাকাসহ কোথাও কোথাও বৃষ্টিও হয়েছে।

>> আবহাওয়া অফিস বলছে, আগামী ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, রংপুর,খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা/হাওয়াসহ বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ হতে পারে। সেই সঙ্গে কোথাও কোথাও মাঝারী ধরনের ভারী থেকে অতিভারী বর্ষণ হতে পারে।

>> গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের সব অঞ্চলেই বৃষ্টি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি- ৬১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে রাজারহাটে।

>> বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড় ফণীর প্রভাবে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, উত্তরাঞ্চল এবং তৎসংলগ্ন ভারতীয় অঞ্চলে আগামী ৭২ ঘণ্টায় ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিপাত হতে পারে। এর প্রভাবে ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, সুরমা, কুশিয়ারা, কংস, যাদুকাটা, তিস্তা নদীর পানির পৃষ্ঠ আগামী ৪৮ ঘণ্টায় দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে। কোথাও কোথাও বিপদসীমা অতিক্রম করে আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।

>> সাগর উত্তাল থাকায় বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকা, ট্রলার এবং সমুদ্রগামী জাহাজকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলেছে আবহাওয়া অফিস।

# ক্ষয়ক্ষতি:

>> ওড়িশায় ঘূর্ণিবাতাসের তাণ্ডবের মধ্যে গাছ ও ইট পড়ে এবং আশ্রয়কেন্দ্রে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। দেড় শতাধিক মানুষ এই ঝড়ে আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে রয়টার্স।

>> ঘূর্ণিঝড়ে ওড়িশায় শত শত গাছ উপড়ে গেছে। বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে পড়ায় রাজ্যের বেশির ভাগ অংশ বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

>> বাংলাদেশে ঝড় পৌঁছানোর আগেই সকালে বাগেরহাটে দমকা হাওয়ায় গাছের ডাল ভেঙে পড়ে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে।

>> এই বিরূপ আবহাওয়ার মধ্যে কিশোরগঞ্জের তিন উপজেলায় বজ্রপাতে ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে।

>> ফণীর প্রভাবে শক্তিশালী জোয়ারে বাঁধ ভেঙে উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালী ও বাগেরহাটে অন্তত ২৮টি গ্রাম প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। 

# বাংলাদেশে প্রস্তুতি

>> দেশের ১৯ জেলার ১৪৭টি উপজেলার ১৩ হাজার ৫০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা উপকূলীয় এলাকা হিসেবে চিহ্নিত; সেখানে প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষের বসবাস।

>> এই ১৯ জেলায় ৪ হাজার ৭১টি আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত সরিয়ে নেওয়া হয়েছে সাড়ে ১২ লাখ মানুষকে। ৫৬ হাজার স্বেচ্ছাসেবী এসব এলাকায় কাজ করছেন।  

>> ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার বাসিন্দাদের সতর্ক করতে বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই সাগর তীরের এলাকাগুলোতে মাইকিং করা হচ্ছে। মজুদ করা হয়েছে শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানি।

>> ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকিতে থাকা এলাকার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাপ্তাহিক ছুটি এবং অন্যান্য ছুটি বাতিল করে তাদেরকে কর্মস্থলে উপস্থিত থাকতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

>> সম্ভাব্য জরুরি স্বাস্থ্য পরিস্থিতি মোকাবেলায় সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোর সব চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তার ছুটি বাতিল করা হয়েছে। প্রতিটি জেলায় প্রস্তুত রাখা হয়েছে মেডিকেল টিম; খোলা হয়েছে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ।

# প্রভাব:

>> বিপদ সংকেত আসার পর বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গরে অবস্থানরত বড় জাহাজগুলোতে পণ্য ওঠানামার কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে।

>> বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা থেকে সারা দেশে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ রেখেছে বিআইডব্লিউটিএ।

>> এইচএসসি ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালেয়ের শনিবারের সব পরীক্ষা ফণীর কারণে পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষা শুক্রবার নির্ধারিত সময়েই হয়েছে।

>> আবহাওয়ার মধ্যে ঢাকায় বঙ্গমাতা অনূর্ধ্ব-১৯ ইন্টারন্যাশনাল গোল্ড কাপের ফাইনাল ম্যাচ মাঠে গড়াতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত আয়োজকরা ফাইনালে ওঠা দুই দল বাংলাদেশ ও লাওসকে যৌথভাবে চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করেছে।

>> ঘূর্ণিঝড় ফণীর আগমণের আগে এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে তাপদাহে পুড়তে হয়েছে ঢাকাবাসীকে। প্রায় ২০ দিন পর ফণীর বৃষ্টি জনজীবনে একভাবে স্বস্ত্বি নিয়ে এসেছে।  

# ফণী:

>> ভারত মহাসাগরে সুমাত্রার পশ্চিমে বিষুবরেখার কাছাকাছি এলাকায় লঘুচাপ গত ২৬ এপ্রিল নিম্নচাপে পরিণত হয়। এরপর তা পশ্চিম দিকে অগ্রসর হতে হতে দুই দিনের মাথায় পরিণত হয় মৌসুমের প্রথম ঘূর্ণিঝড়ে।

>> এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সাগর তীরের আট দেশের আবহাওয়া দপ্তর ও বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্যানেলের তালিকা থেকে ক্রম অনুসারে ওই ঝড়ের নাম ঠিক হয় ফণী। এর অর্থ সাপ, নামটি প্রস্তাব করেছিল বাংলাদেশ।

>> অস্থির গতিপথ ধরে অত্যন্ত ধীর গতিতে এগোতে থাকা এ ঘূর্ণিঝড় দ্রুত শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে। ২৯ এপ্রিল ফণী পরিণত হয় প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে। এরপরদিনই ভারতীয় আবহাওয়াবিদরা একে চিহ্নিত করেন অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় হিসেবে।  

>> ১৯৯৯ সালের ওড়িশার পারাদ্বীপে সুপার সাইক্লোনের পর ঘূর্ণিঝড় ফণীই বাতাসের শক্তির দিক দিয়ে সবচেয়ে বিপদজনক ঝড় ছিল। তিন দশক আগে ওড়িশায় ওই সাইক্লোনে প্রাণ গিয়েছিল প্রায় ১০ হাজার মানুষের।