বৃহস্পতিবার দেশের ২২ হাজার ৯৬১টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও দাখিল মাদ্রাসায় ছিল এই চিত্র। স্টুডেন্টস কেবিনেট নির্বাচনে ভোট দেন এসব প্রতিষ্ঠানের লক্ষাধিক ভোটার।
এই নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনার, প্রিজাইডিং কর্মকর্তা, পোলিং অফিসারসহ শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বেও ছিলেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষক, পরিচালনা পর্ষদ ও অভিভাবকরা ছিলেন তাদের সহযোগিতায়।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২০১০ সাল থেকে স্টুডেন্টস ক্যাবিনেট গঠন করা হলেও মাধ্যমিক স্তরে ২০১৫ সাল থেকে কিশোর শিক্ষার্থীদের মন্ত্রিসভা গঠনে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেছেন, শিশুকাল থেকে গণতন্ত্রের চর্চা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া, অন্যের মতামতের প্রতি সহিষ্ণুতা ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছাড়াও ক্রীড়া, সংস্কৃতি ও সহশিক্ষা কার্যক্রমে তাদের সম্পৃক্ত করাতে এই নির্বাচন হচ্ছে।
স্টুডেন্টস ক্যাবিনেট নির্বাচনে এক লাখ ৮৩ হাজার ৬৮৮টি পদের জন্য ৩ লাখ ২৪ হাজার ৮৩৭ জন শিক্ষার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। মোট ভোটার ছিল ১ কোটি ১৪ লাখ ৯৫ হাজার ৬১৮ জন শিক্ষার্থী।
বিদ্যালয়ে শিক্ষা ও পরিবেশের মানোন্নয়ন, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক উন্নয়ন, সহশিক্ষা কার্যক্রম ত্বরান্বিত করা খুদেদের স্কুল সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের ছিল নানা প্রতিশ্রুতি।
প্রত্যেক শ্রেণি থেকে একজন করে পাঁচটি শ্রেণি (ষষ্ঠ-দশম) থেকে পাঁচজন এবং পরবর্তী সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া তিন শ্রেণির তিনজনকে নিয়ে এক বছরের জন্য আট সদস্যের মন্ত্রিসভা গঠিত হয় এই নির্বাচন থেকে।
এই কেবিনেটের কর্মপরিধিতে থাকবে পরিবেশ সংরক্ষণ, পুস্তক ও শিখন সামগ্রী, স্বাস্থ্য, ক্রীড়া, সংস্কৃতি ও সহপাঠ কার্যক্রম, পানিসম্পদ, বৃক্ষরোপন ও বাগান তৈরি, দিবস পালন ও অনুষ্ঠান সম্পাদন, অভ্যর্থনা, আপ্যায়ন ও আইসিটি।
নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরবর্তী সাত দিনের মধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সভাপতিত্বে প্রথম বৈঠকে বসবে কিশোর শিক্ষার্থীদের মন্ত্রিসভা।
এই বৈঠকে ‘কেবিনেট প্রধান’ নিজেদের মধ্যে কর্মবণ্টন, সহযোগী সদস্য মনোনয়ন এবং সারা বছরের কর্মপরিকল্পনা করবেন।
স্টুডেন্টস কেবিনেটকে মাসে কমপক্ষে একটি সভা করতে হবে। প্রতি ছয় মাস পর সব শিক্ষার্থীর উপস্থিতিতে ক্যাবিনেটের সাধারণ সভা হবে।
রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে প্রভাতী আর দিবা শাখার ৮ জন করে ১৬ জন ক্যাবিনেট সদস্য হওয়ার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ২৭ জন শিক্ষার্থী। দিবা শাখায় ৩০৭ জন আর প্রভাতী শাখায় ৭৪৬ জন মিলিয়ে মোট ভোটার ছিল এক হাজার ৫৩ জন।
এ স্কুলের একটি বুথে গিয়ে দেখা যায়, ভোটাররা লাইন ধরে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করছেন। কারও কোনো অভিযোগ নেই।
প্রভাতী শাখার প্রিজাইডিং অফিসার জান্নাতুল মাওয়া জানান, সকাল থেকে কোনো অভিযোগ আসেনি তাদের কাছে।
“যাদের সমস্যা ছিল, তাদের আমরা বুঝিয়ে দিয়েছি। সুষ্ঠু ও নির্বিঘ্নে ভোটগ্রহণ হয়েছে, কোনো ধরনের অনিয়ম হয়নি।”
জীবনে প্রথম ভোট দিয়ে এসে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী নাজিফা ফাইরুজ বলেন, “খুব ভালো লাগছে, জীবনে প্রথম ভোট দিলাম। এখন থেকে প্র্যাকটিস হচ্ছে আমাদের। আমরা ভালো প্রতিনিধি বাছাইয়ের মাধ্যমে ভবিষ্যতে জাতীয় নির্বাচনে সৎ ও যোগ্য প্রতিনিধি বেছে নিতে পারব।”
নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী সানজিদা আফ্রাদ মৌমিতা বলেন, “আমি জিততে পারলে শিক্ষার্থীদের যত অভিযোগ আর দাবি আছে তা পূরণের চেষ্টা করব।”
“স্টুডেন্টরা ক্লাস শেষ করে কোচিং করত। পানি বয়ে আনতে ওদের অনেক কষ্ট হত। আমরা টিচারদের কাছে বিষয়টা তুলে ধরলে জায়গায় জায়গায় পানির পাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এতে কাউকে আর পানি নিয়ে আসতে হয় না। অনেকের সুবিধা হয়েছে।”
এবার নির্বাচিত হলে স্কুলের লাইব্রেরিতে বই বাড়ানো, কোচিংয়ের সময় কমানো, ল্যাবে নিয়মিত অনুশীলন যাতে হয় সেজন্য কাজ করার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।
স্কুলের বাইরে সন্তানের জন্য অপেক্ষারত অভিভাবক ষষ্ঠ শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর মা আইরন আলী মনে করেন, এ ধরনের নির্বাচনের ফলে শিক্ষার্থীরা দেশের প্রতি দায়িত্বটা বুঝে নিচ্ছে এখন থেকে।
“ওরা এখন থেকেই শিখে নিচ্ছে। ওদেরকে যদি ভবিষ্যতে সুযোগ দেওয়া হয় তাহলে ওরা সততার সাথে দেশের জন্য কাজ করবে। অনেক সময় এমন অনেক ব্যাপার থাকে যেখানে আমরা কথা বলতে পারি না। এক্ষেত্রে ওরা কাজ করতে পারবে। ওদের স্কুল ওরা ভালো বুঝে যে, কী করলে ভালো হয়।”
তিনি বলেন, “কোনো ধরনের অনিয়ম হয়নি এ নির্বাচনে। নিরাপত্তা কর্মীরা অনেক তৎপর ছিল। অনেক ভালো লাগছে এতো বড় দায়িত্ব পেয়েছি, তা সঠিকভাবে পালনের চেষ্টা করেছি।”
সিদ্ধেশ্বরী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. সাহাব উদ্দিন মোল্লা বলেন, “এই কোমলমতি শিক্ষার্থীরা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, বিদ্যালয়ের প্রতি মমত্ববোধ রপ্ত করতে পারছে।
“এই শিক্ষা্থীদের ১০ বছর বয়স থেকে এই শিক্ষাটা দিলে তাদের ভবিষ্যতে কোনো সমস্যা হবে না। পড়াশুনা যেমন ছোটবেলা থেকে শুরু হয়েছে ঠিক তেমনি এই চর্চাটা শুরু হলে সত্যিকারের নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে।”
মতিঝিল কলোনি উচ্চ বিদ্যালয়ের ভোটার অঙ্কুর হাওলাদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ নির্বাচন থেকে কীভাবে শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, কীভাবে অনুপ্রেরণা দিতে হবে তা যেমন শিখছি, তেমনিভাবে শিখছি গণতান্ত্রিক মনোভাবও।”
এই বিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাচন কমিশনার দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী মো. সাগর বলেন, “শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সহযোগিতায় সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে নির্বাচন। লেখাপড়ার মানোন্নয়ন, পরিবেশ পরিচ্ছন্নতা ইস্যুতে আমরা কাজ করব একসাথে। স্কুলের এই নির্বাচনের মাধ্যমেই আমরা বুঝতে পারি, সমাজ ও দেশের জন্য অনেক কিছু করতে পারি।”
মতিঝিল কলোনি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক সাঈফুল ইসলাম বলেন, “প্রধান নির্বাচন কমিশনার, রিটার্নিং অফিসার, পোলিং এজেন্ট থেকে শুরু করে এই নির্বাচনের সব কিছু ওরা নিজেরাই করেছে। আমরা শুধু নেপথ্যে ছিলাম। ক্যাবিনেটে ৮ জন নির্বাচিত হবে। তারা স্কুলের সার্বিক উন্নয়ন ও শৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকবে।”
প্রথমবারের মতো স্কুল নির্বাচনে ভোট দিতে এসে মতিঝিল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী ফাতিহা তাবাসসুম সারাহ জানান, প্রথমে একটু ‘ভয়’ লাগছিল তার।
“আমার অনুভূতিটা একটু অন্যরকম। প্রথমবার ভোট দিচ্ছিলাম। নতুন তো, তাই একটু ভয় ভয় লেগেছিল। পরে ঠিক হয়ে গেছে।”
দশম শ্রেণির প্রার্থী মেহেনাজ তাবাসসুম বলেন, “স্কুলে অনেক সমস্যা রয়েছে। আমি নির্বাচিত হলে, সবাইকে নিয়ে সেসব সমস্যা সমাধান করব।”
অষ্টম শ্রেণি থেকে নির্বাচিত হওয়া প্রতিনিধি ফেরদৌস বিনতে আলম লামিয়া বলেন, “দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেল। স্কুলে যেসব সমস্যা হয়েছে, সেগুলোর দ্রুত সমাধানে কাজ করব।”
এই বিদ্যালয়ে টানা তিন বছর ধরে সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে রেকর্ড গড়েছেন সপ্তম শ্রেণির প্রতিনিধি মারিয়া নূর।
তিনি বলেন, “লেখাপড়া থেকে শুরু করে সার্বিক মানোন্নয়নের জন্য যা যা করা দরকার, আমি তা করব।”
দশম শ্রেণি থেকে নির্বাচিত হওয়া তাহিরা সানজিদা বলেন, “অনেক সময় শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের ঘনিষ্ঠ হতে পারে না। এছাড়া নানা বিষয়ে কিছু না কিছু অসঙ্গতি তো রয়ে গেছে। সমস্যাগুলো নিজের সমস্যা হিসেবে ভেবে স্কুলের শিক্ষার্থীদের সব ইচ্ছা পূরণ করতে আমি চেষ্টা করব।”
প্রধান শিক্ষক নাজমুন নাহার শাহীন বলেন, “নেতৃত্বের বিকাশের এই তো শুরু হল। ওরা দেখিয়েছে, ওরা সুযোগ পেলে চমৎকার করে বলতে পারে, করে দেখাতে পারে। সারা দেশের স্কুলগুলোতে এ নির্বাচনের মাধ্যমে নেতৃত্বের গুণাবলী আরো বিকশিত হবে।”