রোহিঙ্গাভারে ‘মারাত্মক’ ঝুঁকিতে কক্সবাজারের পরিবেশ

এগার লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিতে গিয়ে পরিবেশগতভাবে ‘মারাত্মক’ ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে কক্সবাজার।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Sept 2018, 03:11 PM
Updated : 18 Sept 2018, 03:13 PM

জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি- ইউএনডিপির এক সমীক্ষায় শরণার্থী সঙ্কটের ছয়টি সরাসরি, সাতটি প্রতিবেশগত প্রভাব চিহ্নিত করে এসব ঝুঁকি নিরসনের মাধ্যমে কক্সবাজারের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফিরিয়ে আনতে ১৯টি সুপারিশ করা হয়েছে।

মঙ্গলবার রাজধানীর একটি হোটেলে ওই সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।

ইউএনডিপির সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কক্সবাজারের কুতুপালং ও বালুখালীর শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে রোহিঙ্গাদের রান্নার কাজে প্রতি মাসে ৬৮০০ টন জ্বলানি কাঠের প্রয়োজন হয়, যার মূল উৎস সেখানকার বনাঞ্চল। সেখানকার পরিবারপিছু বসতঘর নির্মাণের জন্য প্রয়োজন হয়েছে ৬০টি করে বাঁশ। ক্যাম্পগুলোতে বসানো হয়েছে কয়েক হাজার গভীর নলকূপ, যার প্রভাবে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর কমার পাশাপাশি ভূমিধসের ঝুঁকিও তৈরি হয়েছে।

ওই এলাকার ১৫০২ হেক্টর প্রাকৃতিক বনভূমির মধ্যে ৭৯৩ হেক্টরই রোহিঙ্গাদের দখলে চলে গেছে বলে সমীক্ষায় বলা হয়েছে। এছাড়া টেকনাফ, উখিয়া ও হিমছড়ির ১২০০ থেকে ১৬০০ হেক্টর এলাকার গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। 

সমীক্ষা প্রতিবেদনে আরো যেসব পরিবেশ ও প্রতিবেশগত প্রভাবের কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে- অতিরিক্ত চাহিদার কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাওয়া, বাড়তি ব্যবহার এবং দূষণের কারণে ভূ-উপরিস্থ পানির সংরক্ষণ সীমিত হওয়া, কঠিন এবং তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা, বসতি স্থাপনে পাহাড় কাটা এবং ভূমিক্ষয়, রান্নার কারণে বায়ুদূষণ, প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্যের নষ্ট ও মানুষ-প্রকৃতির দ্বন্দ্ব এবং জলে প্রতিবেশগত ব্যাঘাত সৃষ্টি। 

উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের ছবুল্লাকাটা এলাকার পাহাড়ের গাছ কেটে ঘর তৈরি করছে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান

এসব সঙ্কট নিরসনে ইউএনডিপি শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে বিকল্প জ্বালানির ব্যবস্থা করা, ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিবেশ পুনরায় ফিরিয়ে আনা এবং উন্নত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলাসহ বেশ কিছু সুপারিশ করেছে।   

প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ পরিবেশ রক্ষায় ইউএনডিপিসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।

মন্ত্রী বলেন, “আমি যে বিষয়গুলো নিয়ে শঙ্কিত, তার প্রথমটি হল- এটি এমন একটি সঙ্কট আগামী কয়েক বছরে যার সমাধান হবে বলে মনে করছেন না সবাই। দ্বিতীয়ত, রোহিঙ্গারা যদি চলেও যায়, সেক্ষেত্রে পরিবেশের কী হবে? স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে কেউ কি অর্থ দেবে?

“আমি তা মনে করি না। কারণ বিশ্বে এখন অনেক সমস্যা রয়েছে, সেসবের জন্যও প্রচুর অর্থের প্রয়োজন।”

অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে ইউএনডিপির কান্ট্রি ডিরেক্টর সুদীপ্ত মুখার্জি সঙ্কটের ব্যাপকতা তুলে ধরে বলেন, ওই এলাকায় প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর মারাত্মক চাপ তৈরি হচ্ছে, যার প্রভাবে প্রাকৃতিক বন পাহাড় উজার হওয়ার পাশাপাশি পানির সঙ্কট বাড়িয়ে দিচ্ছে।

রোহিঙ্গা শরণার্থীরা উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের ছবুল্লাকাটা এলাকার পাহাড়ের গাছ কাটছে ঘর তৈরির জন্য। ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান

“এই পরিস্থিতিতে কক্সবাজারের পরিবেশ ও প্রতিবেশগত স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশ সরকারের কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে জরুরি সহায়তা দরকার।

“পরিস্থিতির আরও অবনতি ঠেকাতে এবং স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনতে যেসব পদক্ষেপ চিহ্নিত করা হয়েছে সেগুলোকে আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি, কারণ এটি উন্নয়নকর্মীদের দ্রুত এবং টেকসই কার্যক্রম গ্রহণ ও অর্থায়নে সহায়তা করবে।”

জাতিসংঘ এরই মধ্যে বিকল্প জ্বালানির ব্যবস্থা করা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং বৃক্ষরোপনের কার্যক্রম শুরু করলেও এ খাতে অর্থায়ন এখনও অপ্রতুল।

এজন্য ‘টেকসই সমাধান এবং দীর্ঘমেয়াদী কর্মসূচি’ প্রয়োজন বলে ইউএনডিপির বিবৃতিতে বলা হয়েছে।

২০১৭ সালের অগাস্টে রোহিঙ্গাদের স্রোত শুরুর পর থেকে কক্সবাজারের উখিয়া এবং টেকনাফ এলাকায় তাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দিতে ৪৩০০ একর পাহাড় এবং বন কেটে ধ্বংস করা হয়েছে, যা সেখানকার অন্তত তিনটি প্রতিবেশগত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার জীববৈচিত্রকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে।

এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া না হলে জীববৈচিত্র্য স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরানো কঠিন হবে বলে ইউএনডিপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।