ভবিষ্যত বলে দেবে কী সম্ভব কী সম্ভব না: রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে রেড ক্রস প্রধান

বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঢল আসার একবছর পরও সংকটের সমাধান না হওয়ার প্রেক্ষাপটে ‘মধ্যবর্তী’ পরিকল্পনা নিতে সব পক্ষকে একসঙ্গে বসার আহ্বান জানিয়েছে আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটি (আইসিআরসি)।

নুরুল ইসলাম হাসিববিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 August 2018, 06:37 PM
Updated : 25 August 2018, 03:21 AM

ওই সংকটের বর্ষপূর্তিতে বিশেষ এক সাক্ষাৎকারে রেড ক্রসের বাংলাদেশ দলের প্রধান ইখতিয়ার আসলানভ এ আহ্বান জানান।

আসলানভ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভবিষ্যত বলে দেবে, কী সম্ভব আর কী সম্ভব না। আজই আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি না যে প্রত্যাবাসন হবে না।”

সপ্তাহে প্রায় ২ হাজার জন রোহিঙ্গাকে ফেরত নেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের চুক্তির প্রসঙ্গ টেনে নিজের অন্তর্বর্তীকালীন পরিকল্পনার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন তিনি।

“দুই দেশের মধ্যে ১৬ জানুয়ারির ওই পরিকল্পনা অনুযায়ী এখন প্রত্যাবাসন শুরু হলেও তা বাস্তবায়নে আরও সাত বছর লাগবে।”

তবে সেটাই এখনো শুরু না হওয়ায় রাষ্ট্রহীন প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গার ঘরে ফেরার সম্ভাবনা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।  

১৯৮২ সাল থেকে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে অস্বীকার করার পর থেকে এই সংকট চলছে। সদ্যপ্রয়াত সাবেক জাতিসংঘ মহাসচিব কোফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত কমিশন বলেছে, সমস্যার মূল কারণ নিহিত মিয়ানমারে। কমিশন তাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়ারও সুপারিশ করেছে।

ওই কমিশন প্রতিবেদন দেওয়ার পরপরই গতবছর ২৫ অগাস্ট রাখাইনে শুরু হওয়া ব্যাপক সহিংসতা শুরু হয়, যাকে ‘জাতিগত নিধন’ বলছে জাতিসংঘ। হত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের মুখে সাত লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজারে আশ্রয় নিয়েছে।

মিয়ানমার প্রশ্নে বিভক্ত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ পরে প্রথমবারের মতো তাদের দুর্দশার কথা শুনতে বাংলাদেশে প্রতিনিধি দল পাঠায়।

মিয়ানমার হেগভিত্তিক আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সদস্য না হলেও দেশটিকে নৃশংতার অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি করা এখতিয়ার ওই আদালতের রয়েছে বলে বাংলাদেশ এক চিঠিতে জানিয়েছে।

তবে মিয়ানমার বাংলাদেশকে দুষছে। স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি সম্প্রতি দেরির জন্য বাংলাদেশকে দায়ী করেছে।

তারপরও আন্তর্জাতিক মহল রোহিঙ্গাদের ফেরার জন্য অনুকূল ও নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করতে অব্যাহতভাবে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছে।

শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের প্রস্তুতি দেখতে ১১ অগাস্ট পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী রাখাইন রাজ্য সফর করেছেন।

*বছর কাটলো দ্রুত*

রাখাইন রাজ্যে প্রবেশাধিকার পাওয়া নিরপেক্ষ সংগঠন রেডক্রস কক্সবাজারে ৯৫ হাজার ৭২ জন রোহিঙ্গাকে খাবারসহ বিভিন্ন সামগ্রী দিয়ে সহায়তা করেছে। তাদের মধ্যে ৪২ হাজার ৭৭০ জন মাসিক রেশন পাচ্ছে।

শরণার্থী ঢলে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় মানুষরাও জীবনযাপনে সহায়তা এবং ক্ষুদ্র অর্থনৈতিক নানা উদ্যোগ থেকে সুবিধা পাচ্ছে। অগাস্টের প্রথম সপ্তাহ থেকে ৭৭ হাজার ৫২ জন রোগী মোবাইল স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে এবং ৪৫ হাজার ৯৮৫ জন পানি, পয়নিষ্কাশন ও আবাসন সুবিধা পাচ্ছে।

রেডক্রস বাংলাদেশ প্রধান বলেন, “আমাদের সবার জন্যই এটা ছিল ব্যস্ত বছর- শুধু বাংলাদেশ সরকার নয়, মানবিক সাহায্য সংস্থাগুলোর জন্যও।”

২৫ অগাস্টের শরণার্থী ঢলের প্রথম খবরের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “একবছর দ্রুত চলে গেছে এই অর্থে যে, আমরা সব সময়ই চেষ্টা করছি এবং যে মাত্রার সংকট তার পেছনেই পড়ে রয়েছি।”

আসলানভ বলেন, “শরণার্থীর সংখ্যা মূলত বেড়েছে অগাস্ট থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত। এর মধ্যে আমরা চেষ্টা করেছি জরুরি সহায়তাগুলো জোগাড় করতে। এরপর থেকে দ্রুত ধেয়ে আসা বর্ষাকালের জন্য প্রস্তুতি নিতে সকলেই ছুটছে।

“এখন আমরা পৌঁছেছি বছরের শেষে। কত দ্রুত বছর গড়িয়ে গেল তা দেখাই যাচ্ছে। আমরা যে রকম ব্যস্ত ছিলাম সেরকম ব্যস্তই আছি।”     

পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় শুধু মানবিক প্রয়োজন পূরণের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানোর আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “মানুষ এখন অনেকটাই ‘স্থিতিশীল’। অন্যান্য জরুরি পরিস্থিতির মতোই তারা তাৎক্ষণিক ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠেছে। তারা এখন শিবিরের জীবনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে এবং এটা ভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ সামনে নিয়ে এসেছে।”

এরপর কী?

কক্সবাজার ও রাখাইন রাজ্যে আইসিআরসি প্রেসিডেন্টের সফরের প্রসঙ্গ তুলে ধরে আসলানভ বলেন, দুপক্ষ থেকেই জরুরি পরিস্থিতিতে সাড়া দেওয়া বিলম্বিত হতে পারে না।

তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে এমনকি সীমান্তের ওপারে রাখাইন রাজ্যের মানুষরাও মানবিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীল।

“মানবিক সাহায্যের বিষয়টি সব সময়ই প্রথম ও জরুরি সাড়া পাওয়ার দাবি রাখে। কিন্তু তারপর টেকসই এক পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে।”

মিয়ানমারের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, সেখানে সামগ্রিক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পাশাপাশি ফেরত যাওয়ার রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও জরুরি।

“তাই এর জন্য প্রয়োজন সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া এবং অবশ্যই প্রত্যাবসনের জন্য আলোচনাও।”

বাংলাদেশের জন্য মানবিক সহায়তা চালিয়ে যাওয়া ‘উপযুক্ত প্রক্রিয়া’ হবে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, “দাতা ও সরকারের জায়গা থেকে এটা টেকসই পদ্ধতি হবে না। এটা বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের উপরও চাপ তৈরি করছে।”

এভাবে শুধুই মানবিক সহায়তার উপর নির্ভরশীল হয়ে রোহিঙ্গারা উৎপাদন ক্ষমতা হারিয়ে নির্ভরশীল হয়ে পড়লে ফিরে গিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা শুরু করা তাদের জন্য আরও কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করেন তিনি।

“কিন্তু যেটা আমাদের দরকার তা হলো- সরকার ও মানবিক সাহায্য সংস্থাগুলোকে একসঙ্গে বসতে হবে। এমন একটা দীর্ঘমেয়াদী পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে, যেখানে প্রত্যাবাসনও বাধাগ্রস্ত হবে না এবং তার জন্য আলোচনাও বন্ধ হবে না।

“পাশাপাশি এসব মানুষ যাতে সম্পূর্ণভাবে সাহায্যের উপর নির্ভরশীল না হয়। কারণ তা বাংলাদেশের জন্য টেকসই হবে না।

শরণার্থী সংকটের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা থাকলেও সব সংকটের জন্য একক কোনো সমাধান নেই বলে মন্তব্য করেন রেডক্রস প্রধান।

“তবে এসব মানুষকে আস্তে আস্তে এবং নিয়ন্ত্রিতভাবে উৎপাদনশীল কাজে যুক্ত করা গেলে আজকের পরিস্থিতির চেয়ে ভালো ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা সম্ভব।

“আমার কথা যদি বলেন, আমি বলবো না যে আমাদের সবার কাছে সমাধান আছে। আমরা সবাই আশা করি এবং বিশ্বাস করতে চাই যে আজ হোক কাল হোক একদিন শুরু হবে। কত শিগগির সেটা হবে তা বলাটা কঠিন।”