রোহিঙ্গাদের শরণার্থী জীবনের শেষ কবে?

মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে চুক্তি হওয়ার পর পেরিয়ে গেছে নয় মাস, কিন্তু নিজের দেশে নাগরিকত্বের অধিকারবঞ্চিত, নিপীড়িত, বাস্তুহারা সোয়া সাত লাখ মানুষ এখনও জানে না- কবে তাদের দেশে ফেরার সুযোগ হবে, আদৌ কখনও হবে কি না।

সাজিয়া আফরিনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 August 2018, 03:42 PM
Updated : 24 August 2018, 04:38 PM

রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের গ্রামে গ্রামে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর যে দমন অভিযানের ফলে নাফ নদীর দুই তীরে ভয়ঙ্কর এই মানবিক সঙ্কটের সৃষ্টি হয়েছিল, শনিবার তার এক বছর পূর্ণ হচ্ছে।    

বাংলাদেশ সরকার এখনও আশার কথা বলছে, মিয়ানমারও বলছে তারা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে প্রস্তুত; কিন্তু কবে নাগাদ প্রত্যাবাসন শুরু হতে পারে তার কোনো সম্ভাব্য সময় কেউ বলতে পারছে না।

বাংলাদেশের শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার আবুল কালাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের যেসব প্রস্তুতি নেওয়ার কথা, যেসব শর্ত তাদের পূরণ করার কথা- তা তারা এখনও শেষ করেনি। ফলে প্রত্যাবাসনও পিছিয়ে যাচ্ছে।

“যে কারণে এই সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে, সেগুলোর সমাধান না হওয়া পর্যন্ত তো আমরা তাদের জোর করে ফেরত পাঠাতে পারি না।”

চুক্তি, পাল্টাপাল্টি অভিযোগ

রাখাইনে কয়েকশ বছর ধরে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বসবাসের ইতিহাস থাকলেও ১৯৮২ সালে আইন করে তাদের নাগরকিত্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়। বৌদ্ধপ্রধান মগদের সঙ্গে সংঘাত আর সেনাবাহিনীর সঙ্গে দমন-পীড়নে গত চার দশকে প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয় বাংলাদেশে।   

সাম্প্রতিক সঙ্কটের সূচনা হয় ২০১৭ সালের ২৫ অগাস্ট। সেই রাতে রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর বেশ কিছু স্থাপনায় ‘বিদ্রোহীদের’ হামলার পর রোহিঙ্গাদের গ্রামে গ্রামে শুরু হয় অভিযান। সেই সঙ্গে শুরু হয় বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে রোহিঙ্গাদের ঢল। তাদের কথায় পাওয়া যায় নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ, জ্বালাও-পোড়াওয়ের ভয়াবহ বিবরণ।

বিশ্বজুড়ে সমালোচনার মুখে মিয়ানমারের নোবেলজয়ী নেত্রী অং সান সু চির সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে সম্মত হয়। গত বছরের ২৩ নভম্বের বাংলাদেশের সঙ্গে একটি সম্মতিপত্রে সই করে মিয়ানমার।

এর ভিত্তিতে দুই দেশের যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হয় এবং ১৬ জানুয়ারি ওই গ্রুপের প্রথম বৈঠকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিভিন্ন বিষয় ঠিক করে ‘ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট’ স্বাক্ষরিত হয়।   

প্রত্যাবাসনের বিষয়ে সম্মত হওয়ার সময় থেকে দুই বছরের মধ্যে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর লক্ষ্য ঠিক করা হয় সেখানে। প্রতি সপ্তাহে দেড় হাজার রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে রাজি হয় মিয়ানমার। 

চুক্তিতে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর জন্য সীমান্তে পাঁচটি ট্রানজিট ক্যাম্প খুলবে বাংলাদেশ। সেখান থেকে তাদের নিয়ে প্রাথমিকভাবে রাখা হবে মিয়ানমারের দুটি ক্যাম্পে।

পরে সাময়িকভাবে তাদের থাকার ব্যবস্থা হবে হ্লা পো কুংয়ের অস্থায়ী ক্যাম্পে। পাশাপাশি ফিরে যাওয়া রোহিঙ্গাদের ভিটেমাটিতে দ্রুততার সঙ্গে বাড়িঘর পুনর্নির্মাণের ব্যবস্থা নেবে মিয়ানমার।

এই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে গত ১৩ এপ্রিল সুইজারল্যান্ডের জেনিভায় বাংলাদেশের সঙ্গে সমঝোতা স্মারকে সই করে ইউএনএইচসিআর। পরে মিয়ানমারও ইউএনএইচসিআর ও ইউএনডিপির সঙ্গে একই ধরনের চুক্তি করতে সম্মত হওয়ার কথা জানায়।

সমঝোতা আর চুক্তির মাঝে বাংলাদশের পক্ষ থেকে প্রথম ধাপের প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমার সরকারকে আট হাজারের মত রোহিঙ্গার একটি তালিকা দেওয়া হলেও এ পর্যন্ত কেউ ওই চুক্তির আওতায় রাখাইনে ফিরতে পারেননি।

এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি বলনে, রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা করলেও বাস্তবে মিয়ানমার কোনো কাজ করছে না।

অন্যদিকে মিয়ানমার এ বিষয়টি বরাবরই ঠেলে দেয় বাংলাদেশের দিকে। গত নভেম্বরে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর সু চির দপ্তরের মহাপরিচালক জ তাই বলেন, “আমরা শুরু করতে চাই। কিন্তু অন্য পক্ষ তো এখনো সাড়া দিচ্ছে না। ফলে দেরি হচ্ছে।”

সর্বশেষ গত ২১ অগাস্ট সিঙ্গাপুরে এক বক্তৃতায় মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চিও একই সুরে কথা বলেন।

মিয়ানমার শরণার্থীদের নিতে প্রস্তুত এবং তাদের পুনর্বাসনের জায়গাও ঠিক করে ফেলা হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, “তাদের ফেরত পাঠানোর কাজটা বাংলাদেশের। আমরা কেবল তাদের স্বাগত জানাতে পারি। আমার মনে হয় বাংলাদেশ কত দ্রুত প্রত্যাবাসন শেষ করতে চায় সে সিদ্ধান্ত তাদেরই নিতে হবে।”

ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টা?

মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের বক্তব্যের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসন বিষয়ক কমিশনার আবুল কালাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন অবশ্যই আমাদের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে না, তাদের (মিয়ানমার সরকারের) প্রস্তুতির উপর নির্ভর করে।”  

তিনি বলেন, রাখাইনে ফেরার পর রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা কি হবে, তাদের জীবিকার ব্যবস্থা কীভাবে হবে, অন্যান্য অধিকারের বিষয়েও এখনো কোনো সুরাহা হয়নি।

“এ ব্যাপারগুলো তো মিয়ানমারেরই করার কথা। এরা তো তাদেরই নাগরিক। তাদের দেশেরই লোক। এ সমস্যাগুলোর কারণেই তো সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে।”

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল গত ১১ অগাস্ট মিয়ানমারে গিয়ে সেখানকার পরিস্থিতি এবং তাদের প্রত্যাবাসন প্রস্তুতি দেখে আসেন। আবুল কালাম ওই দলেও ছিলেন।

তিনি বলেন, খুব দ্রুত প্রত্যাবাসন শুরু করার মত প্রস্তুতি মিয়ানমারে তিনি দেখতে পাননি। 

“আমরা খুব সামান্য প্রস্তুতিই দেখেছি। আমাদের যেসব জায়গায় তারা নিয়ে গেছে সেসব জায়গাতেই গিয়েছি আমরা। তেমন কোনো প্রস্তুতিই নেয়নি। একটা ট্রানজিট ক্যাম্প করেছে, আর কয়েকটা ছোটখাট জায়গা তৈরি করেছে তাদের ইন্ডিজেনাস পিপলদের জন্য; এটুকুই। অনুকূল পরিবেশ এখনো তারা তৈরি করেনি।” 

অং সান সু চির বক্তব্যের বিষয়ে প্রশ্ন করলে আবুল কালাম বলেন, “উনার বক্তব্য খুবই দুর্ভাগ্যজনক। এটা খুবই হতাশাজনক যে তার মত একজন নেত্রী আমাদের উপর দোষ চাপাচ্ছেন। তাদের ব্যর্থতা বা প্রস্তুতির অভাবকে চেপে যাওয়ার জন্য এটা তিনি করে থাকতে পারেন।”

প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশের প্রস্তুতি জানতে চাইলে আবুল কালাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, কিছু কাজ শেষ হয়েছে এবং কিছু এখনো চলমান। বাংলাদেশের দুটি প্রত্যাবাসন কেন্দ্র তৈরি করার কথা, একটি পুরোপুরি তৈরি হয়ে গেছে, আরেকটির কাজ প্রায় শেষের দিকে।

“পরিবারভিত্তিক তালিকা তৈরির কাজ আমরা পুরোপুরি শেষ করতে পারিনি, এটা চলছে। কিন্তু আসল ব্যাপারটি হচ্ছে যে প্রত্যাবাসন হতে হবে স্বেচ্ছামূলক, নিরাপদ। সেই কাজগুলো মিয়ানমারের বিষয়।”

এক প্রশ্নের জবাবে প্রত্যাবাসন কমিশনার জানান, চুক্তি অনুযায়ী প্রথম কথা ছিল যারা প্রত্যাবাসিত হবে তাদের নিজেদের গ্রামে বা তাদের নিজেদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হবে। যদি তা কোনো কারণে সম্ভব না হয়, তাহলে অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য তাদের পছন্দসই নিকটবর্তী কোনো স্থানে নেওয়া হবে।

“এগুলো তো করতে হবে। এখানে আরও বিষয় আছে, এটা তো শুধু বাড়ির বিষয় না, তাদের নিরাপত্তা তাদের চলাফেরার অধিকার নিশ্চিত করা হয়নি এখনো। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের একটা ইস্যুও আছে, যদিও সেটা আরও বৃহত্তর ইস্যু। যেগুলা খুব মৌলিক ইস্যু ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য, যেমন বাসস্থান, জীবিকা, নিরাপত্তা সেগুলোর কোনো নিশ্চয়তা এখনো পাওয়া যায়নি।”

রোহিঙ্গারা যা চায়

নাগরকিত্বের অধিকার থেকে বঞ্চিত রোহিঙ্গাদের  মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং ক্ষমতাসীন দলের অনেকে বর্ণনা করেন ‘বাঙালি সন্ত্রাসী’ ও ‘অবৈধ অভিবাসী’ হিসেবে। দেশটির স্টেট কাউন্সিলর নোবেলজয়ী সু চিও কখনো রোহিঙ্গা শব্দটি মুখে আনেন না।

এই টানাপোড়েনের মধ্যে গত কয়েক দশকে লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসতে হয়েছে। অনেকে আছেন যারা একবার ফিরে গিয়ে আবারও বাংলাদেশে আসতে বাধ্য হয়েছেন। তাই এবার ফেরার আগে সব নিজেদের নিরাপত্তা আর অধিকারের বিষয়ে নিশ্চিত হতে চান তারা।

নাগরিকত্ব, নির্যাতনের বিচার, জমি-সম্পত্তি ফেরত পাওয়া, মৌলিক চাহিদা ও সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মত বিষয়গুলো শর্ত হিসেবে ঘুরে ফিরে এসেছে কক্সবাজারে আশ্রয় নিয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের কথায়।

মিয়ানমারের বুড়িচং থেকে গতবছর সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছিলেন সেখানকার একটি মসজিদের মুয়াজ্জিন শাফিকুর শফি। সঙ্গে ছিল দুই স্ত্রী ও সাত সন্তান। তার ২৪ বছর বয়সী বড় ছেলেকে মিয়ানমারের সেনারা গুলি করে হত্যা করে, তিনটি ঘর আগুনে জ্বালিয়ে দেয়।

অনেক নিকটাত্মীয়কেও খুন হতে দেখেছেন শফি। কক্সবাজারের ময়নারঘোনা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এই অধিবাসী এখনো তার জন্মভূমিতে ফিরে যেতে চান।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “সরকারি নাম (নাগরিকত্ব) চাই আমরা। সরকারি নাম না থাকলে কোনো অত্যাচারের বিচার পাওয়া যায় না। আমার একটা পুকুর আছে, ওই পুকুর ফেরত চাই। আমার পরিবার নিয়ে আবার নিজের বাড়িতে নিরাপদে থাকতে চাই।”

বাবা, এক ভাই, দুই বড় বোন সবাইকে মিয়ানমারে হারিয়ে মংডু থেকে গতবছর ২৮ অগাস্ট সীমান্ত পেরিয়ে একা বাংলাদেশে চলে এসেছিলেন নুরান্তিস বেগম। পালিয়ে আসার পথে তার ডান পা ভেঙে যায়; পরে পচন ধরলে তা কেটে ফেলতে হয়। ময়নারঘোনা ক্যাম্পে অন্য একটি পরিবারের সঙ্গে এখন থাকছেন তিনি।

নুরান্তিস বলেন, তার বাবা মিয়ানমারে মাছের ঘেরে কাজ করতেন। সেখানে জায়গা জমি, একটি বাড়ি এবং ভাইয়ের একটি দোকানও ছিল। এখন ক্যাম্পে ঘরের ভেতর বসে থাকতে তার দম বন্ধ লাগে, বাড়ির কথা মনে পড়ে। কিন্তু মিয়ানমারে ফেরার ভরসাও তিনি পান না।

“আমিতো হাঁটতে পারি না। বার্মা গেলে আবার ওইরকম হলে আমি তো পালাতেও পারব না। আমার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, ওইখানে মেয়েদের ওরা মানুষই মনে করে না। মান ইজ্জত, জীবন কোনটারই দাম নাই। পরিবারের সবাইকে আমি আর ফেরত পাব না, বিচার তো পেতে পারি। রোহিঙ্গা নাম (নাগরিকত্ব) দিলে আমি কালই চলে যেতে রাজি।”

শরণার্থী ক্যাম্পে থাকা অনেকেই আশ্রয় দেওয়া এবং নানাভাবে সহযোগিতা করার জন্য বাংলাদেশের মানুষকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তারা বলছেন, রাখাইনের নির্যাতনের তুলনায় এখানে তারা ভালো আছেন, কিছুটা শান্তিতে ঘুমাতে পারছেন। কিন্তু নিজের বাড়িঘরের মায়া তাদের টানে।  

আম্বিয়া খাতুনের ছেলে বারো বছর বয়সী মো. ফারুখ এগারো নম্বর ক্যাম্পের একটি স্কুলে তার রোহিঙ্গা শিক্ষকের কাছ থেকে জেনেছে নাগরিকত্ব কী এবং কেন দরকার।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে সে বলে, “আমার বাবাকে মেরে ফেলা হয়েছে, আমার নতুন হওয়া ভাই হারিয়ে গেছে। আমার আম্মা অনেক কেঁদেছে, আমরাও কেঁদেছি। আমি রোহিঙ্গা নাম চাই, তাহলে বিচার পাব। আমাদের আর মারতে পারবে না।”