অদেখা বাবার ছবিতেই ‘কান্না থামে’ রায়নার

গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার রাতে নিহত পুলিশ কর্মকর্তা রবিউল করিমের ছবিই হয়ে উঠেছে তাকে না দেখা মেয়ের কাছে ‘বাবার উপস্থিতি’।

শফিকুল ইসলাম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 July 2018, 03:41 AM
Updated : 1 July 2018, 11:39 AM

দুই বছর আগে নজিরবিহীন ওই হামলার মাসখানেক পর জন্ম হয় কামরুন্নাহার রায়নার। তার ভাই সাজিদুল করিম সামির বয়স এখন আট বছর। এই শিশুও পুলিশের ইউনিফর্ম পরা রবিউলের ওই ছবিতে খুঁজে ফেরে বাবাকে।

রবিউলের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীর আগের দিন শনিবার ধামরাইয়ে তাদের বাসায় কথা হয় রবিউলের স্ত্রী উম্মে সালমার সঙ্গে।

তিনি জানান, বড় ছেলে সামি বাবার মৃত্যুর পর থেকে বড় বেশি চুপচাপ আর গম্ভীর হয়ে গেছে। অভিযোগ, অনুযোগ আর আবদার ছিল যার কাছে, সেই বাবা না থাকায় অনেক শান্ত হয়ে গেছে সে।

আর মেয়ে রায়নাকে নিয়ে সালমা বলেন, “বাবার স্পর্শ না পেলেও পিতৃস্নেহ বঞ্চিত পৃথিবীতে পুলিশের পোশাক পরা বাবার ছবিটিই রায়নার জন্য সব কিছু। তার কাছে এই ছবিটিই তার আব্বু।

“কোনো কারণে কান্না শুরু হলে কিছুতেই যখন তাকে থামানো যায় না তখন একমাত্র বাবার এই ছবিই পারে রায়নার কান্না থামাতে।”

২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে ঢাকার কূটনীতিকপাড়া গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালিয়ে ১৭ বিদেশিসহ ২০ জনকে হত্যা করে জঙ্গিরা। হামলার পরপর জঙ্গিদের ঠেকাতে গিয়ে নিহত হন গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল এবং বনানী থানার ওসি সালাউদ্দিন খান।

সালমা বলেন, পুলিশের চাকরির কারণে পরিবারকে খুব বেশি সময় দিতে পারতেন না রবিউল।

“ব্যস্ততার মাঝে তিনি যেটুকু সময় দিয়েছেন তাই আমাদের চলার পথের পাথেয়। মহৎ হৃদয়ের এই মানুষটির আদর্শ, দেশপ্রেম, মানুষের প্রতি ভালোবাসা আর পরোপকারী চিন্তা-চেতনাই এখন আমাদের অনুপ্রেরণা।”

রবিউলের মৃত্যুর এক বছর পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তার চাকরি পান তার স্ত্রী।

সালমা জানান, অফিস-বাসা আর সন্তানদের নিয়ে দিন কেটে যায় তার। স্বামীকে হারিয়ে প্রথমে ভেঙে পড়লেও এখন স্বপ্ন দেখছেন দুই সন্তানকে নিয়ে। তাদেরকে বাবার আদর্শেই গড়ে তুলতে চান তিনি।

কর্মক্ষেত্রে যাতায়াতের সুবিধায় বর্তমানে ধামরাইয়ের কালামপুরের দক্ষিণ বেপাসাই এলাকায় বাবার বাড়িতেই থাকছেন সালমা। ছেলে সামি দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ছে স্থানীয় বেপাসাই মডেল স্কুলে।

রবিউলের ছোট ভাই শামসুজ্জামান শামস ভাতিজা-ভাতিজিকে দেখভাল করেন। ভাইয়ের মৃত্যুর পরে তাদের মা করিমুন্নেসার অসুস্থতার কথা জানালেন শামস।

হামলায় আহত গোয়েন্দা পুলিশের এসি রবিউল করিমকে সহকর্মীরা নিয়ে যান হাসপাতালে। ওই রাতেই মৃত্যু হয় তার।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বড় ছেলের মৃত্যুর পর থেকেই মানসিক ও শারীরিকভাবে ভেঙে পড়েছেন মা। মেরুদণ্ড আর হাড়ের সমস্যায় ভুগছেন তিনি।”

এলাকাবাসীর উন্নয়নে রবিউল করিম যেসব উদ্যোগ নিয়েছিলেন তাও এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন শামস।

তিনি বলেন, “মানুষ সাধারণত নিজেকে নিয়ে ভাবতে পছন্দ করে। কিন্তু ভাইয়া সব সময় তার চারপাশের মানুষকে নিয়ে ভাবতেন। কেউ তার কাছে কোনো সহযোগিতা চাইলে তিনি তার সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে তার জন্য চেষ্টা করতেন।

“এই মমত্ববোধ থেকেই নিজের গ্রাম মানিকগঞ্জের কাটিগ্রামে গড়ে তুলেছিলেন সুবিধাবঞ্চিত ও প্রতিবন্ধী শিশুদের স্কুল ব্লুমস।”

শামস জানান, বর্তমানে এই স্কুলে ৪০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। স্কুলের সার্বিক দিক তিনিই দেখাশোনা করেন।

স্কুল পরিচালনায় আর্থিক সংকটে পড়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এটি কোনো রকমে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। তবে সরকারি-বেসরকারি কোনো সংস্থার সহযোগিতা পেলে ভাইয়ার অপূর্ণ স্বপ্নকে আমরা আরও দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব।”

শামস জানান, ‘নজরুল বিদ্যাসিঁড়ি’ নামে একটি স্কুলও গড়ে তুলেছিলেন রবিউল করিম। সেটি এখন পরিচালনা করছেন মিজানুর রহমান নামে তার একজন বন্ধু।