‘আমাগো জীবনে ঈদ আহে না’

ভাগ্যান্বেষণের জন্য বহু বছর আগে গাঁয়ের কাদামাটি ধুয়ে, মফস্বলের পথ মাড়িয়ে রাজধানীর বুকে আশ্রয় খুঁজে নিয়েছিলেন তারা।

জয়ন্ত সাহাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 June 2018, 10:43 AM
Updated : 16 June 2018, 10:43 AM

কঠিন নাগরিক জীবনে টিকে থাকার এবং নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার নির্মম লড়াইয়ের চাপে তাদের আনন্দ-উৎসবের রঙ ফিকে হয়েছে অনেক আগেই।

এদের কেউ নিরাপত্তাকর্মী, কেউ হকার, কেউ চায়ের দোকানদার, কেউ মৌসুমী ফল ফেরি করে বেড়ান, কেউবা ইট ভাঙেন।  আবার কেউ নগরের বুকে ইমারত গড়েন রক্ত-ঘামে।

ঈদুল ফিতরে রাজধানীর কর্মজীবীদের বড় একটি অংশ যখন নাড়ির টানে বাড়ি ছুটেছে, তখন শ্রমজীবী মানুষের একটি অংশ রয়ে গেছে রাজধানীতে; জীবনের নির্মম বাস্তবতায় বিবর্ণ পাণ্ডুর হয়ে গেছে ওদের ঈদ আনন্দ।

এমনই কজন শ্রমিকের সঙ্গে কথা হয় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের। রাজধানীতে কেমন করে ঈদ উদযাপন করেন, আপনজনদের মুখগুলো কেমন করেই বা ভুলে থাকেন- সেই গল্পটি শেয়ার করেছেন বেশ কজন শ্রমজীবী মানুষ।

বছর দুয়েক ধরে রাজধানীতে ইট ভাঙার কাজ করছেন রোকেয়া বেগম; জোগালি  হিসেবেও কাজ করেছেন আগে।

জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে কথা হচ্ছিল তার সঙ্গে। তোপখানা রোডে সড়ক উন্নয়নের কাজে রয়েছেন তিনি বেশ কদিন। ঈদুল ফিতরের দিন ছিল তার ছুটি।

কথায় কথায় তিনি জানান, বছরপাঁচেক আগে ভালোবেসে ঘর বেঁধেছিলেন রোকেয়া। তার দুবছর যেতে কোলজুড়ে এসেছিল ফুটফুটে সন্তান। কিন্তু জীবনের নানা টানাপড়েনে দুজনের পথ আলাদা হয়ে গেলেও মেয়ে মরিয়ম তার সঙ্গে রয়েছে।

ঈদে মেয়েকে নতুন জামা কিনে দেওয়ার সামর্থ্য নেই রোকেয়ার। তার আশা, মেয়ের জন্য যদি একটু ভালো খাবার জুটে!

“দেহেন আমার ভাগ্য ! আজকে আমারে হাত পাততে হইতাসে! ঈদের জামাত শেষে নামাজিরা দয়া কইরা যা দেবে, তা দিয়া আজকে একটু ভালো খাবার কিনমু। আসলে দু-চারদিন ধরে কাজ বন্ধ তো! টাকাও জমাইতে পারি নাই।

“আমাগো জীবনে ঈদ আহে না ভাই”-বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন রোকেয়া বেগম।  

তোপখানা রোডে ফারইস্ট ইসলামী ব্যাংকের নিরাপত্তারক্ষীর দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন বগুড়ার শেরপুরের মিলন জাহান।

তিনি জানান, ঈদে ছুটি মেলেনি। বোনাসের টাকা পুরোটাই পাঠিয়ে দিয়েছেন বাড়িতে।

“বাড়িতে সবাই পথ চাইয়া আছিল। কিন্তু বাড়িতে যাইতে তো পারব না। অফিস ছুটি দেই নাই। কী আর করব? বাড়ির সকলের জন্য কেনাকাটাও করতে পারি নাই। বোনাসের টাকা পাঠায়া দিছি। বলছি,.. নিজের পছন্দমতো কিছু যেন সকলে কিনা নেয়।”

ঢাকার যাত্রাবাড়িতে একটি মেসে থাকেন মিলন। সেই মেসে তার মতো আরো অনেক কর্মজীবীর মিলেনি ঈদের ছুটি। শনিবার সন্ধ্যার পর ঘরে ফিরে তারা সবাই নিজেদের মধ্যে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করে নেবেন। গল্প-আড্ডা- গানের পর নিজেরাই রান্না করে নেবেন তাদের পছন্দসই খাবার।

হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার সিংহ গ্রামের বাসিন্দা মো. আজিজুল ইসলাম প্রায় ১০ বছর ধরে ঢাকায় পুতুল আর শিশুদের খেলনাসামগ্রী ফেরি করেন।

গেলবার ঈদুল আযহায় বাড়ি যেতে পারলেও এবার আর বাড়ি যেতে পারেননি।  চার মাস বয়সী মেয়ে নূহা আক্তারের জন্য একটি নতুন পোশাক কিনতে পারেননি বলে তার ‘অপরাধী মন’ বাড়ি যেতে দেয়নি তাকে।

“টাকাপয়সা তো ম্যানেজ করলাম না, কেমনে যাইতাম? নূহার লাগিয়া তো কিছু কিনলাম তো। মুখ তারে কেমনে দেখাই।”

আজিজুলের স্ত্রী সকাল থেকে ফোন করে যাচ্ছেন, আজিজুল সেই ফোন রিসিভ করার ‘সাহস পাচ্ছেন না’।

চাঁদপুরের শাহরাস্তি থানার আলীপুর গ্রামের বাসিন্দা মোহাম্মদ আলীও যেতে পারবেন না গ্রামে। ৬৫ বছর বয়সী এই আইসক্রিম বিক্রেতার সঙ্গে কথা হয় সেগুনবাগিচা এলাকায়।

তিনি বলেন, “আলীপুরে আমার আব্বা-আম্মার কবর আছে; প্রতিবার ঈদে যাই। কিন্তু এবার টাকা-পয়সা খুব একটা নাই। মনটা বড় টানছে। ধার-দেনা করব দেখি। বাড়ি গেলে একটা খরচাও আছে।”

আরেক পুতুল বিক্রেতা সত্তরোর্ধ্ব রুহুল আমিন ঈদুল ফিতরের দ্বিতীয় দিন যাবেন গ্রামের বাড়ি। বরিশালের উজিরপুর উপজেলার পঞ্চগ্রামে আছে বাবার কবর, গ্রামে থাকেন মা-ও।

“ঈদের প্রথম দিন বাড়ি যেতে পারি নাই। কালকে যাব। আমার আম্মা অপেক্ষায় থাকেন। মনে আছে, ছোটবেলায় তারে খুব জ্বালাইতাম। এখন তার বয়স হইসে। কিন্তু  আম্মা তো আম্মাই। এই শরীর নিয়াও আম্মা সেমাই রান্না করব। তার হাতের সেমাই খাইতে যামু।”

পত্রিকার হকার আমিনুর রহমান তোতার সঙ্গে কথা হয় রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাব এলাকায়।  বরিশালের উজিরপুরে তার গ্রামের বাড়িতে রয়েছে স্ত্রী ও দুই সন্তান

তোতা বলেন, “মোবাশ্বের আর মুনতাসীর- আমার দুইটা ছেলে। একটার বয়স ৯, একটার ৪। ছোট ছেলেটা ফোনে খালি আব্বা আব্বা করে। মোবাশ্বের বলছে, তার জন্য নতুন একটা জামা নিতে। তার জন্য জামাও কিনছি। কিন্তু বাচ্চাদের মায়ের জন্য তো শাড়ি কিনতে পারি নাই।  বাড়িতে আরো লোক আছে। সবার জন্য কিছু একটা না নিলে ব্যাপারটা কেমন হয় না!  লজ্জ্বায় বাড়ি যেতে পারছি না।”

মহাখালীর আমতলী মোড়ে কথা হয় রিকশাচালক আবুল হোসেন, মোতাহের মিয়া, সালাউদ্দিনের সঙ্গে। তিন চালকই তাদের পরিবার নিয়ে থাকেন ঢাকাতেই।

আবুল হোসেন বলেন, “পরিবার নিয়ে ঢাকায় চলে আসছি কিছু দিন আগে। বাড়ি যাওয়া আসলে একটা ঝামেলা। বউ একটা গার্মেন্টেসে ঢুকছে। মোটামুটি চলে যায়। বিকালে বউরে নিয়ে একটু বের হমু।”

মোতাহের, সালাউদ্দিন আবুলের কথায় টিপ্পনী কাটেন।

তারা জানান, রাতে বস্তিতে গান-নাচের ছোট্ট একটি আসর আছে। আবুল জানান, মোতাহেরের গানের গলা ভালো। রাতের আসরে সে গান গাইবে।

রোকসানা আক্তার কাজ করেন মেরুল বাড্ডার তোবা গার্মেন্টসে, তার বাড়ি নরসিংদীর বেলাবোতে।

রোকসানা বলেন, “মা-বাপ কেউ নাই, তাই আর বাড়ি যাই না। ঢাকাতে যাগো লগে কাজ করি, তারাই এখন আত্মীয়। দুই চাইরজন  আছে, হেরা বাড়িত যায় নাই। হেগো লগেই ঈদে ঘোরোঘোরি করমু একটু।”

রোকসানাদের মেসে ঈদুল ফিতরের আমেজ লেগেছে। দুপুরে জম্পেশ খাওয়া দাওয়ার পর সন্ধ্যায় তারা দলবেঁধে সিনেমা দেখবেন।

শ্রমজীবীদের অনেকে ঈদের পরদিন বাড়ি যাবেন। এদের মধ্যে রয়েছেন বায়তুল মোকাররম এলাকার টুপি বিক্রেতা মো. বিল্লাল হোসেন।

“ঈদের দিন একটু বেচাকেনা ভালো হয়। তাই চিন্তা করলাম, ঈদের পরের দিন বাড়ি যামু। বাড়িতে ৩টা ছেলে আছে। নাতিপুতিও আছে। নাতিপুতিগুলো যা বান্দর ! ওরা এইটা সেইটা চাইতাসে। তাদের জন্য খেলনা কিনতে হইছে।”