আদালতের আদেশে আটকে গেল গাজীপুরের ভোট

ভোটের তারিখের মাত্র নয় দিন আগে সীমানা জটিলতা নিয়ে এক রিট আবেদনে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন তিন মাসের জন্য স্থগিত করে দিয়েছে হাই কোর্ট।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 May 2018, 09:19 AM
Updated : 6 May 2018, 04:20 PM

আগামী ১৫ মে গাজীপুরের সঙ্গে খুলনা সিটি করপোরেশনেও নির্বাচনের তফসিল দিয়েছিল নির্বাচন কমিশন; এখন গাজীপুরেরটি আটকে গেল।

গাজীপুর সিটি করপোরেশনে সাভারের শিমুলিয়া ইউনিয়নের ছয়টি মৌজা অন্তর্ভুক্তির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগের নেতা এ বি এম আজহারুল ইসলাম সুরুজের এক রিট আবেদনে আদালতের এই স্থগিতাদেশ আসে।

বিএনপি অভিযোগ করেছে, পরাজয় আঁচ করে সরকারই ষড়যন্ত্র করে এই নির্বাচনটি আটকে দিয়েছে। তা নাকচ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলেছে, আদালতের এই সিদ্ধান্তে সরকারের কোনো হাত নেই।

হাই কোর্টের বিচারপতি নাঈমা হায়দার এবং বিচারপতি জাফর আহমেদের বেঞ্চের রোববার দেওয়া এই স্থগিতাদেশের বিরুদ্ধে আপিল হবে কি না, সে বিষয়ে ইসি সুনির্দিষ্ট করে কিছু জানায়নি।

আদালতের আদেশ গণমাধ্যমে দেখার পর নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার সাংবাদিকদের বলেছেন, তারা গাজীপুরে নির্বাচনের সব কার্যক্রম বন্ধ রাখতে রিটার্নিং কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিয়েছেন।

গাজীপুর সিটি করপোরেশন গঠিত হওয়ার পর এটি দ্বিতীয় নির্বাচন; ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম নির্বাচনে বিএনপি নেতা এম এ মান্নান মেয়র হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের আজমত উল্লাহ খানকে হারিয়ে।

তবে এবার বিএনপি প্রার্থী বদল করে মনোনয়ন দেয় টঙ্গী পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান হাসানউদ্দিন সরকারকে; ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও প্রার্থী বদলে আনে জাহাঙ্গীর আলমকে।

দুই পক্ষের প্রচার আর বিধি লঙ্ঘনের পাল্টাপাল্টি অভিযোগের মধ্যে ইসির ভোটের প্রস্তুতি নিয়ে চলার মধ্যে আদালতের স্থগিতাদেশ এল।

মামলার ইতিবৃত্ত

গাজীপুর সিটি করপোরেশনে সাভারের শিমুলিয়া ইউনিয়নের ছয়টি মৌজা অন্তর্ভুক্ত করে ২০১৩ সালে ১৬ জানুয়ারি স্থানীয় সরকার বিভাগের গেজেট, চলতি বছরের ৪ মার্চ স্থানীয় সরকার বিভাগের জারি করা প্রজ্ঞাপন ও নির্বাচনের জন্য গত ৩১ মার্চ ঘোষিত তফসিল চ্যালেঞ্জ করে রোববার শিমুলিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজহারুল ইসলাম সুরুজ রিট আবেদনটি করেন।

প্রাথমিক শুনানি নিয়েই হাই কোর্ট বেঞ্চ ভোট তিন মাসের জন্য নির্বাচন স্থগিত করে দেয়।

আদালতে রিট আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী বিএম ইলিয়াস কচি। তার সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী সৈয়দ মো. রেজাউর রহমান রেজা।

রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোখলেছুর রহমান; নির্বাচন কমিশনের পক্ষে শুনানি করেন তৌহিদুল ইসলাম।

ইলিয়াস কচি সাংবাদিকদের বলেন, ঢাকা জেলার সাভারের শিমুলিয়া ইউনিয়নের যে ছয়টি মৌজা গাজীপুর সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি ঢাকা জেলা প্রশাসনকে অবহিত করা হয়নি। তাছাড়া অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে প্রশাসনিক নিয়মও মানা হয়নি।

“তাছাড়া ছয়টি মৌজার স্থানীয়রা দ্বৈত নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হবেন এবং তাদেরকে দুই জায়গায় কর পরিশোধ করতে হবে। এসব বিষয় উল্লেখ করে ২০১৩ সালের গেজেট ও ভোটের তারিখ ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশনের দেওয়া প্রজ্ঞাপন ও তফসিল চ্যালেঞ্জ করে রিট আবেদনটি করা হয়। যেটির প্রাথমিক শুনানি নিয়ে নির্বাচন স্থগিতের পাশাপাশি রুল জারি করেছে আদালত।”

শিমুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের ছয়টি মৌজা গাজীপুর সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্তির গেজেট এবং সম্প্রতি গাজীপুর সিটি করপোরশেন নির্বাচনের প্রজ্ঞাপন ও তফসিল কেন আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে রুলে।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সচিব, ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (সিটি করপোরেশন-২), ঢাকা জেলা প্রশাসক, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ নয়জনকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। 

আদালতের আদেশের পর ইসির আইনজীবী তৌহিদুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, “এই আবেদনকারী এর আগে একই বিষয়ে রিট করেছিলেন, সে রিটের প্রেক্ষিতে আদালত স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে আদেশ দিয়েছিলেন বিষয়টি নিষ্পত্তি করার জন্য। সরকার সেটি নিষ্পত্তি করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। ফলে আমরা মনে করি রিটটি গ্রহণযোগ্য নয়।

“তাছাড়া, রিট আবেদনে গাজীপুর সিটি করপোরেশেনের নির্বাচন স্থগিত চাওয়া হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে সীমানা নির্ধারণের গেজেট প্রকাশ করে স্থানীয় সরকার বিভাগ নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছে। নির্বাচন কমিশন সে অনুযায়ী প্রজ্ঞাপন জারি ও তফসিল ঘোষণা করেছে। ফলে এর দায় নির্বাচন কমিশনের না।”

রিট আবেদন থেকে জানা যায়, ২০১২ সালের ২৪ জানুয়ারি গাজীপুর সিটি করপোরেশন গঠনের প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। প্রজ্ঞাপনে গাজীপুর ও টঙ্গী পৌর এলাকাসহ সম্প্রসারিত পৌর এলাকা একীভূত করা হয়।

পরে ২০১৩ সালের ১৬ জানুয়ারি স্থানীয় সরকার বিভাগ একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। যেখানে ঢাকা জেলাধীন সাভার উপজেলার শিমুলিয়া ইউনিয়নের ডোমনা, দক্ষিণ বাড়ৈবাড়ী, পশ্চিম পানিশাইল, দক্ষিণ পানিশাইল, শিবরামপুর ও ডোমনাগ মৌজাকে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের আওতাভুক্ত করা হয়।

তখন এ বিষয়ে আপত্তি তোলেন শিমুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আজহারুল ইসলাম সুরুজ। কিন্তু স্থানীয় সরকার বিভাগ সেই আপত্তি আমলে না নেওয়ায় ২০১৫ সালে হাই কোর্টে একটি রিট আবেদন করেন আজহারুল ইসলাম। আদালত আবেদনকারীর আপত্তি নিষ্পত্তি করার আদেশ দেয়।

কিন্তু বিষয়টি নিষ্পত্তি না করেই ২০১৬ সালে শিমুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে এ ছয়টি মৌজা শিমুলিয়ার মধ্যেই ছিল। নির্বাচনে আজহারুল ইসলাম চেয়ারম্যান হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হন।

এদিকে গত ৪ মার্চ স্থানীয় সরকার বিভাগ ছয়টি মৌজাকে গাজীপুর সিটি করপোরেশনে রেখে আরেকটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। ১৫ মে ভোটের দিন নির্ধারণ করে নির্বাচন কমিশন গত ৩১ মার্চ গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে।

এই নির্বাচন সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন, তফসিল ও ২০১৩ সালের সীমানা নির্ধারণ সংক্রান্ত গেজেট চ্যালেঞ্জ করেই রোববার রিট আবেদনটি করা হয়।

পাল্টাপাল্টি প্রতিক্রিয়া

আদালতের আদেশ শোনার সঙ্গে সঙ্গে গাজীপুরে ভোটের প্রচারে থাকা বিএনপি নেতারা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান। পরে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানান।

ফখরুল বলেন, “সরকার দেখেছে যে, এই নির্বাচনে একেবারে তাদের ভরাডুবি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তারা নিশ্চিত পরাজয় জেনে তারা তাদের লোক দিয়ে মামলা করিয়ে এবং কারসাজি করে গাজীপুরের নির্বাচনটিকে স্থগিত করিয়েছে।”

রিট আবেদনকারী আজহারুল সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগের শ্রম ও জনশক্তি বিষয়ক সম্পাদক বলেও জানান তিনি।

 

ধানের শীষের মেয়র প্রার্থী হাসান সরকার টঙ্গীতে তার বাড়িতে সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, “হঠাৎ করে উচ্চ আদালতের রায় গাজীপুরবাসীকে স্তম্ভিত করে দিয়েছে।”

“জনগণ যাতে স্বাধীনভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে, তার জন্য আইনি লড়াই, মাঠের লড়াই, রাজনীতির লড়াই জনগণের পক্ষে করে যাব,” বলেন তিনি।

আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক হাছান মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেছেন, “আদালত স্বাধীন। আদালত রায় দিয়েছে। এব্যাপারে সরকারের কিছু করার নেই।”

বিএনপি নেতাদের অভিযোগের প্রেক্ষাপটে তিনি বলেন, “আমরা এই নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে প্রচণ্ড আশাবাদী ছিলাম।”

ইসির বক্তব্য

আদালতের আদেশের পর ইসির আইনজীবী তৌহিদুল ইসলামের কাছে সাংবাদিকরা জানতে চেয়েছিলেন, হা্ি কোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে কি না?

তিনি বলেন, “আদালতের আদেশটি কমিশনকে জানানো হয়েছে। এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।’

এদিকে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, আদেশের কপি পাওয়ার পর এর বিরুদ্ধে আপিল করা হবে কি না, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।

ইসি এখন কী করবে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বিকালে সাংবাদিকদের বলেন, “কী কারণে এই নির্বাচন বন্ধ হয়েছে, সেটি স্থানীয় সরকার বিভাগের ভুল, নাকি কমিশনের ভুল- সেসব এখনও জানতে না পারলেও আদালতের নির্দেশনার প্রতি সম্মান রেখে নির্বাচনের সকল কার্যক্রম বন্ধ রাখতে রিটার্নিং কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”

ইসি সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোখলেছুর রহমান জানান, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং কমিশন সচিব খুলনায় রয়েছেন। তারা ঢাকায় ফিরলে কমিশনের বৈঠকে বসবে। সেখানেই পরবর্তী করণীয় ঠিক হবে।