এতিমখানা দুর্নীতি: খালেদার রায় ৮ ফেব্রুয়ারি

বিদেশ থেকে জিয়া এতিমখানা ট্রাস্টের নামে আসা দুই কোটি ১০ লাখ টাকা আত্মসাতের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সাজা হবে কি না- সেই রায় জানা যাবে ৮ ফেব্রুয়ারি।

আদালত প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 Jan 2018, 09:45 AM
Updated : 7 Feb 2018, 05:25 PM

দশ বছর আগে দুদকের দায়ের করা এ মামলায় দুই পক্ষের যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে বৃহস্পতিবার ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ মো. আখতারুজ্জামান রায়ের এই দিন ঠিক করে দেন। 

বিচারক যখন রায়ের দিন ঠিক করে দিচ্ছেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও তখন বিচারকক্ষে উপস্থিত। অভিযোগ প্রমাণিত হলে এ মামলায় তার সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে।   

সাবেক স্বৈরশাসক এইচ এম এরশাদের পর খালেদা জিয়া হলেন বাংলাদেশের দ্বিতীয় সরকারপ্রধান, যার বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতি মামলার রায় হতে যাচ্ছে। দুর্নীতির দায়ে এরশাদকে জেলও খাটতে হয়েছিল। 

এতিমখানা দুর্নীতি মামলায় খালেদার বড় ছেলে তারেক রহমানও আসামি। মুদ্রা পাচারের দায়ে সাত বছর কারাদণ্ডের রায় মাথায় নিয়ে পালিয়ে আছেন দেশের বাইরে। এ মামলাতেও তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। 

মামলার ছয় আসামির মধ্যে খালেদা জিয়া জামিনে রয়েছেন; মাগুরার সাবেক সাংসদ কাজী সালিমুল হক কামাল ও ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ রয়েছেন কারাগারে।

আর তারেক ছাড়াও সাবেক মুখ্য সচিব ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান মামলার শুরু থেকেই পলাতক।

খালেদা জিয়ার প্রধান আইনজীবী আবদুর রেজাক খান বলেন, “এটি একটি অসার মামলা। খালেদা জিয়ার খালাস পাবেন বলে আমরা বিশ্বাস করি।”

অন্যদিকে দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, “আমরা অভিযোগ আদালতে প্রমাণ করেছি। আমাদের বিশ্বাস, ছয় আসামিই সর্বোচ্চ সাজা পাবে।”

আলোচিত এ মামলায় দুদক ও আসামিপক্ষ মোট ১৬ কার্যদিবস যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেছে। মোট ২৩৬ কার্যদিবস শুনানির পর মামলাটি রায়ের পর্যায়ে এল।

শেষ দিনের যুক্তিতর্ক

যুক্তি তর্ক উপস্থাপনের শেষ দিনে খালেদা জিয়া পুরান ঢাকার বকশীবাজারে কারা অধিদপ্তরের মাঠে স্থাপিত পঞ্চম বিশেষ জজ আদালতের বিশেষ এজলাসে আসেন বেলা ১১টা ৩৮ মিনিটে। তার আগেই ১১টা ৭মিনিটে বিচারক আখতারুজ্জামন এজলাসে এসে মামলার কার্যক্রম শুরু করেন।

এদিন মাগুরার সাবেক সাংসদ কামাল ও ব্যবসায়ী শরফুদ্দিনের পক্ষে তাদের আইনজীবীরা যুক্তি দেন।

শুরুতে আইনজীবী আহসান উল্লাহ বলেন, শরফুদ্দিন ট্রাস্ট্রের কাছে জমি বিক্রি করেছেন, আর সলিমুল হক কামাল ব্যাংকে টাকা রেখেছেন মাত্র। অভিযোগের সঙ্গে তাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।

দুপুরের পর আইনজীবী মিজানুর রহমানও দুই আসামির পক্ষে এক ঘণ্টার বেশি যুক্তি উপস্থাপন করে তাদের খালাস দাবি করেন।

আসামিপক্ষের বক্তব্যের পর দুদকের পক্ষে মোশারফ হোসেন কাজল যুক্তি খণ্ডনে বলেন, “আমরা ৩২ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য এবং তথ্যপ্রমাণ দিয়ে সকল আসামির বিরুদ্ধে মামলা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি।”

অন্যদিকে খালেদার আইনজীবী রেজাক খান বলেন, “এ মামলা সারহীন। রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। আসামিপক্ষের অধিকাংশ যুক্তিও খণ্ডন করতে পারেনি।”

উভয় পক্ষের বক্তব্য শেষে বিচারক এতিমখানা দুর্নীতি মামলার রায়ের জন্য ৮ ফেব্রুয়ারি দিন ঠিক করে দেন।

মামলা বৃত্তান্ত

জিয়া এতিমখানা ট্রাস্টে এতিমদের জন্য বিদেশ থেকে আসা অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় এই মামলা করে দুদক।

তদন্ত শেষে ২০০৯ সালের ৫ অগাস্ট আদালতে অভিযোগপত্র দেন দুর্নীতি দমন কমিশনের সহকারী পরিচালক হারুনুর রশিদ।

অভিযোগে বলা হয়, এতিমদের জন্য বিদেশ থেকে আসা ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা আত্মসাৎ করেছেন এ মামলার আসামিরা।

মামলা হওয়ার পাঁচ বছর পর ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ খালেদাসহ ছয় আসামির বিরুদ্ধে ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৪০৯ এবং দুদক আইনের ৫(২) ধারায় অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করেন।

দণ্ডবিধির ৪০৯: যে ব্যক্তি তাহার সরকারি কর্মচারীজনিত ক্ষমতার বা একজন ব্যাংকার, বণিক, আড়তদার, দালাল, অ্যাটর্নি বা প্রতিভূ হিসাবে তাহার ব্যবসায় ব্যাপদেশে যে কোনো প্রকারে কোনো সম্পত্তি বা কোনো সম্পত্তির উপর আধিপত্যের ভারপ্রাপ্ত হইয়া সম্পত্তি সম্পর্কে অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ করেন, সেই ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে বা দশ বৎসর পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত হইবে এবং তদুপরি অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবে।

দুদক আইনের ৫(২):  কোনো সরকারি কর্মচারী অপরাধমূলক অসদাচরণ করিলে বা করার উদ্যোগ গ্রহণ করিলে তিনি সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের যোগ্য হইবেন। অপরাধমূলক অসদাচরণ সংশ্লিষ্ট অর্থিক সম্পদ অথবা সম্পত্তি রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত হইবে।

রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য ও জেরা শেষে খালেদা জিয়া এ মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থন করে ছয় দিন বক্তব্য দেন।

পরে ১৯ ডিসেম্বর জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় যুক্তি উপস্থাপন শুরু হলে প্রথম দিন দুদকের পক্ষে মোশাররফ হোসেন কাজল যুক্তি উপস্থাপন করেন।

এরপর দশ কার্যদিবসে খালেদা জিয়ার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এজে মোহাম্মাদ আলী, সাবেক অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল আব্দুর রেজাক খান, সাবেক স্পিকার ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার ও অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন।

দীর্ঘ এই বিচার প্রক্রিয়ায় মামলা থেকে রেহাই পেতে খালেদা জিয়া উচ্চ আদালতে গেছেন বার বার। তার অনাস্থার কারণে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তিনবার এ মামলার বিচারক বদল হয়েছে। শুনানিতে হাজির না হওয়ায় তিনবার তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি হয়েছে।

এসব কারণে দুদক ও আওয়ামী লীগ নেতারা খালেদা জিয়া ও তার আইনজীবীদের বিরুদ্ধে  মামলা বিলম্বিত করারও অভিযোগ করেছে বহুবার।

অন্যদিকে বিএনপি অভিযোগ করে আসছে, ক্ষমতাসীনরা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে এই মামলাকে এ পর্যন্ত নিয়ে এসেছে।

দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বৃহস্পতিবারও বলেছেন, তাদের চেয়ারপারসনকে সাজা দেওয়ার বিষয়টি সরকার আগেই ঠিক করে রেখেছে।

আর খালেদা জিয়া আত্মপক্ষ সমর্থনে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেছেন, রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে তাকে ‘সরাতে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করার নীলনকশা’ বাস্তবায়ন করছে ক্ষমতাসীনরা।

এ আদালতে ন্যায়বিচার পাবেন কি না- তা নিয়েও তিনি আত্মপক্ষ সমর্থনে সংশয় প্রকাশ করেন।

দাতব্য ট্রাস্ট দুর্নীতি

বকশীবাজারের একই আদালতে খালেদা জিয়াসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলারও বিচার চলছে।

বৃহস্পতিবার এতিমখানা দুর্নীতি মামলার রায়ের দিন ঠিক করে দেওয়ার পাশাপাশি দাতব্য ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার যুক্তিতর্কের জন্য ৩০ ও ৩১ জানুয়ারি এবং ১ ফেব্রুয়ারি দিন ঠিক করে দেন বিচারক আখতারুজ্জামান।