বিশ্ব ব্যাংকের পদ্মা ‘দুর্নীতি’ তদন্তকারীর বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ

পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র তদন্ত পর্যবেক্ষণে বিশ্ব ব্যাংকের হয়ে বাংলাদেশে আসা প্রতিনিধি দলের প্রধান লুই গাব্রিয়েল মোরেনো ওকাম্পোর বিরুদ্ধে দুর্নীতিসহ অনেক অভিযোগ উঠেছে।

আজিজ হাসানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Oct 2017, 05:35 PM
Updated : 4 Oct 2017, 05:44 PM

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) প্রসিকিউটর থাকাকালে অফশোর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং করস্বর্গ (ট্যাক্স হেভেনস) নামে পরিচিত দেশ ও এলাকায় তার কোম্পানি থাকার তথ্য উঠে এসেছে ফাঁস হওয়া নথিতে।

পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে বিশ্ব ব্যাংক অর্থায়ন স্থগিত করলে তার তদন্ত শুরু করে দুদক। ওই তদন্ত পর্যবেক্ষণে ২০১২ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন ওকাম্পো নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিশ্ব ব্যাংকের পর্যবেক্ষক প্যানেল।

আইসিসির প্রসিকিউটরের দায়িত্ব পালন করে আসা ওকাম্পো নেতৃত্বাধীন ওই পর্যবেক্ষক দলের পরামর্শে দুদকের করা মামলায় সে সময় জেল খাটতে হয়েছিল সচিব মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়াকে।

পরে কানাডার একটি আদালত পদ্মা প্রকল্পে বিশ্ব ব্যাংকের আনা দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ খারিজও করে দিয়েছে, যদিও বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিনের টানাপড়েনে এই প্রকল্পে সংস্থাটির অর্থায়ন আর হয়নি।

কূটনৈতিক তারবার্তা এবং সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারি কর্মকর্তাদের ভাষ্য সম্বলিত ৪০ হাজার নথি এসেছে ফরাসি অনলাইন জার্নাল মিডিয়াপার্টের হাতে।

ওই সব নথি পর্যালোচনার ভিত্তিতে ইউরোপিয়ান ইনভেস্টিগেটিভ কোলাবোরেশনস (ইআইসি) বলছে, আইসিসির দায়িত্ব ছাড়ার পর সন্দেহভাজন যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের পক্ষে কাজ করে আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন ওকাম্পো।

বিশ্ব ব্যাংকের হয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তদন্ত পর্যবেক্ষণে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে ঢাকা আসে ওকাম্পো নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের দলটি

৬৫ বছর বয়সী আর্জেন্টাইন আইনজীবী ওকাম্পো প্রথম আন্তর্জাতিক মহলের নজরে আসেন তার দেশের সামরিক জান্তা সরকারের সদস্যদের বিচারের মুখোমুখি করতে ভূমিকা রেখে। ২০০৩ সালে নেদারল্যান্ডসভিত্তিক আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রথম প্রসিকিউটর হন তিনি, এই দায়িত্বে ছিলেন নয় বছর।

দায়িত্বে থাকাকালে তার প্রধান তিনটি লক্ষ্য ছিল গণহত্যার জন্য উগান্ডার গেরিলা নেতা জোসেফ কনি ও সুদানের প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশির এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে বিচারের মুখোমুখি করা।

লিবিয়ায় গৃহযুদ্ধের এক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন বাহিনীর বিমান হামলার মুখে রাজধানী ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া গাদ্দাফি নিজের দেশের মানুষের হাতে খুন হন, ২০১১ সালে। চরম নিষ্ঠুরতা ও শিশুদের যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য আলোচিত কনি এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। কয়েক বছরের গৃহযুদ্ধে ব্যাপক প্রাণহানির পর এখনও সুদানের ক্ষমতায় ওমর আল-বশির।

রোমানিয়াভিত্তিক একটি ওয়েবসাইট বলছে, আইসিসির দায়িত্ব ছাড়ার পর প্রচুর অর্থ বানাচ্ছেন ওকাম্পো।

নিউইয়র্কভিত্তিক ল ফার্ম গেটনিক অ্যান্ড গেটনিকে পরামর্শক, হার্ভার্ডের লেকচারার হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি ভাইয়ের সঙ্গে মোরেনো ওকাম্পো নামে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন তিনি। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই গাদ্দাফি পরবর্তী লিবিয়ায় যুদ্ধাপরাধের জন্য দায়ী লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মির (এলএনএ) অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ধনকুবের হাসান তাতানাকিকে আইনি সহায়তা দিতে চুক্তি করেন ওকাম্পো।

গাদ্দাফি ও তার ছেলে সাইফের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা ওকাম্পো গাদ্দাফি অনুসারী হিসেবে তাতানাকির সঙ্গে এই চুক্তি করেন ২০১৫ সালে। তিন বছর সেবা পেতে তিন মিলিয়ন ডলারের পাশাপাশি দৈনিক মজুরি হিসেবে তাকে পাঁচ হাজার ডলার দিতে চুক্তিবদ্ধ হন তাতানাকি।

২০১৫ সালের ১২ মে ওকাম্পো তার পক্ষে কাজ শুরু করার ছয় দিনে মাথায় আইসিসির চিফ প্রসিকিউটর ফাতোস বেনসোডা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মির বেসামরিকদের হত্যা-নির্যাতন ও তাদের হাতে আটকদের নির্যাতন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

ওই সশস্ত্র গোষ্ঠী ও তাতানাকিকে যাতে আইসিসির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে না হয় সেজন্য ওকাম্পো পথ বাতলে দিতে চেয়েছিলেন বলে তার একটি ইমেইলে উঠে এসেছে।

২০১২ সালের ২১ এপ্রিল লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলিতে সংবাদ সম্মেলনে ওকাম্পো: ছবি-রয়টার্স

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জার্মান পত্রিকা ডের স্পেইগেলকে ওকাম্পো বলেছেন, হাসান তাতানাকির সঙ্গে কাজ করা ‘ভালো’ হবে বলে ভেবেছিলেন তিনি।

“তিনি আমাকে বলেছিলেন, তিনি লিবিয়ায় শান্তি ফেরাতে চেষ্টা করছেন।”    

লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মির নেতা জেনারেল খলিফা হাফতারকে পৃষ্ঠপোষকতার বিষয়ে তাতানাকিকে সতর্ক করেছিলেন বলে দাবি করেন তিনি।

অফশোর কোম্পানি

ওকাম্পো আইসিসির দায়িত্ব ছাড়ার দুই মাস পর তার ডাচ ব্যাংক এবিএন আমর ‘র অ্যাকাউন্টে ৫০ হাজার ডলার আসে সুইজারল্যান্ডের একটি অ্যাকাউন্ট থেকে। টেইন বে করপোরেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে ওই অর্থ পাঠানো অব্যাহত থাকে।

টেইন বে করপোরেশন নিবন্ধন রয়েছে পানামায়, এই অফশোর হেভেনে কোম্পানিগুলোর মালিকদের নাম গোপন থাকে। ওকাম্পো ও তার স্ত্রী ওই কোম্পানির মালিক বলে ফাঁস হওয়া নথিতে বেরিয়ে এসেছে।

করস্বর্গ হিসেবে পরিচিত ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসে ইয়েমানা ট্রেডিং নামে ওকাম্পোর এবং আরেক করস্বর্গ বেলাইজে লুসিয়া এন্টারপ্রাইজেস নামে তার স্ত্রীর একটি কোম্পানি থাকার তথ্যও উঠে এসেছে।

দক্ষিণ আমেরিকায় অফশোর হেভেন হিসেবে বিবেচিত উরুগুয়েতে মোরেনো ওকাম্পো কনসাল্টিংয়ের প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্ট মার্কেটস নিয়েও বিতর্ক রয়েছে।

আইসিসির দায়িত্বে থাকাকালে অফশোর কোম্পানি নিয়ে প্রশ্নের জবাবে ওকাম্পো ডের স্পেইগেলকে বলেন, “অফসোর কোম্পানি অবৈধ নয়। সেগুলোর মাধ্যমে আপনি অবৈধ কর্মকাণ্ড চালাতে পারেন। কিন্তু সেগুলো অবৈধ নয়।”

নিজের দেশ আর্জেন্টিনায় ব্যক্তির ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নিরাপদ নয় দাবি করে তিনি বলেন, “বৈধ ও অবৈধ উভয় কারণেই আপনার অফশোর কোম্পানি থাকতে পারে।

“অর্থ বা ঘুষ নেওয়ার জন্য আপনি একজন দুর্নীতিপরায়ন ব্যক্তি হতে পারেন। আবার একজন সৎ আইনজীবী হিসেবে আপনি বাইরে অর্থ রাখতে পারেন।”