সেক্ষেত্রে বিচারকের অসদাচরণ হয়েছে কি-না, তাও খতিয়ে দেখার অবকাশ আছে বলে আইনমন্ত্রী মনে করছেন।
রোববার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) আয়োজনে মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন তিনি।
আইনমন্ত্রী বলেন, রায়ের ওই বক্তব্যে যে “ইতিহাস বিকৃতি হয়েছে- এর মধ্যে কোন সন্দেহ নাই।”
এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “আপনারা জানেন, আমাদের স্বাধীনতা কিন্তু রাতারাতি আসে নাই। স্বাধীনতার ঘোষণাটাও রাতারাতি হয় নাই। একটা রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণের রায়ে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন।
প্রশ্নকারী সাংবাদিককে উদ্দেশ্য করে আনিসুল হক বলেন, “অসদাচারণের কোনো সংজ্ঞা এখন পর্যন্ত নাই। সে ক্ষেত্রে এটা খতিয়ে দেখতে হবে, এটা অসদাচরণ কি-না। বা অন্য কিছু হয়েছে কি-না, সেটা খতিয়ে দেখার কিন্তু অবকাশ আছে।”
উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নিতে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের যে পরিবর্তন ষোড়শ সংশোধনীতে আনা হয়েছিল, তা ‘অবৈধ’ ঘোষণার রায় গত ১ অগাস্ট প্রকাশ করে সুপ্রিম কোর্ট।
ওই রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা দেশের রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি, সুশাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সমালোচনা করেন।
ওই রায় প্রকাশের পর থেকেই বাদ-প্রতিবাদ চলছে। রায়ে সংক্ষুব্ধ হয়ে সরকারি দল আওয়ামী লীগ প্রধান বিচারপতির কড়া সমালোচনা করে আসছেন।
এমনকি অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও আদালতের ওই পর্যবেক্ষণকে ‘বাপের নাম ভুলিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
৭৯৯ পৃষ্ঠার ওই রায়ের ৫৪তম পৃষ্ঠায় প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার পর্যবেক্ষণের অংশে বলা হয়েছে, “কোনো জাতি বা রাষ্ট্র একজন ব্যক্তিকে নিয়ে বা একজন ব্যক্তির মাধ্যমে সৃষ্টি হয় না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নের কথা বলে গেছেন, আমরা যদি সত্যিই তা বাস্তবায়ন করতে চাই, আমাদের অবশ্যই আমিত্ববোধের ওই আত্মঘাতী উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর আসক্তি থেকে মুক্ত থাকতে হবে যে, কেবল একজন ব্যক্তি বা একজন মানুষই সব করেছে।”
বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনো বিচারকের অসদাচরণের ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়ার কর্তৃত্ব কার হাতে- এমন প্রশ্নে আইনমন্ত্রী বলেন, “এর অথরিটি এখন মহামান্য রাষ্ট্রপতি। তার কারণ হচ্ছে, সুপ্রিম সুডিশিয়াল কাউন্সিল সম্পর্কে যদি (সংবিধানে) কোনো বক্তব্য না থাকে, আর ষোড়শ সংশোধনীও যদি না থাকে, তাহলে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ছাড়া আর গতি নাই।”
“একটা দৃষ্টান্ত হচ্ছে অষ্টম সংশোধনী মামলা। আদালত কিন্তু কোনো আইন প্রণয়ন করতে পারে না। আদালত আইনের ব্যাখ্যা দিতে পারে। যতটুকু ‘সংবিধানের লঙ্ঘন’ বলেছেন, এতটুকু উনাদের এখতিয়ারে আছে, রায় দিয়েছেন। কিন্তু যেটা বহাল করতে বলেছেন, সেটা বলতে পারেন কি-না, তা সম্পর্কে সন্দেহ আছে।”
এক্সপাঞ্জ কীভাবে?
ওই রায় প্রকাশের দশ দিনের মাথায় গত বৃহস্পতিবার সরকারের প্রতিক্রিয়া জানাতে এসে প্রধান বিচারপতির ‘অগ্রহণযোগ্য’ বক্তব্য এক্সপাঞ্জ করার উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেছিলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
সরকার কীভাবে তা করতে চায় সে বিষয়ে মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে মন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আদালতের মাধ্যমেই তা করা হবে।
“সুপ্রিম কোর্ট রুল বলে, রিভিউয়ের মাধ্যমে এর জন্য আবেদন করতে হয়। আমরা এখনো সিদ্ধান্তে আসিনি। এটা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছি।”
রিভিউ করার বিষয়ে এক প্রশ্নে আনিসুল হক বলেন, “এটা কিন্তু ৭৯৯ পাতার একটা রায়। রিভিউ করতে গেলেও পড়ে জায়গাগুলো চিহ্নিত করতে হবে। আজ-কাল-পরশুর মধ্যে হয়ে যাবে- সেটা আমি বলব না। ভীষণভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। ওখানে আপত্তিকর, অপ্রীতিকর ও অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তা আছে, সেইগুলো এক্সপাঞ্জ করার কথা আমি বলেছি। সে বিষয়ে কাজ চলছে ।”
‘বড় স্বার্থে আলোচনা’
ওই রায় নিয়ে ক্ষমতাসীনদের সমালোচনার মধ্যেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের শনিবার রাতে প্রধান বিচারপতির বাসায় যান এবং রায় নিয়ে আলোচনা করেন।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে আইনমন্ত্রী বলেন, “রাতে হয়েছে বলে সাক্ষাতের বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানি না। তবে এটা সত্যি যে, বিচার, আইন ও শাসন বিভাগ- এই তিনটা হচ্ছে রাষ্ট্রের স্তম্ভ। এক্ষেত্রে আমাদের মধ্যে কিন্তু আলাপ আলোচনা চলতে পারে। যতক্ষণ পর্যন্ত দেশের উন্নতির জন্য, বড় ধরনের স্বার্থে আমরা আলাপ আলোচনা সব সময়েই চালিয়ে যাব।”
আনিসুল হক বলেন, “আমরা কিন্তু কোনো ক্ষমতার প্রতিযোগিতায় নামি নাই। আমাদের পথ চলতে গিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে। সেটা দেশের স্বার্থে নিরসন করা প্রয়োজন হবে; শেখ হাসিনার সরকার তা করবেই। তার কারণ হচ্ছে, শেখ হাসিনা জনগণের ভাল চান। দেশের ভাল চান। তাই আলাপ আলোচনার দ্বার সব সময় খোলা থাকবে।”
সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন পর্যায় থেকে যেভাবে রায়ের সমালোচনা করা হচ্ছে, তাতে আদালত অবমাননা হয় কি-না, এমন প্রশ্ন রাখেন সাংবাদিকরা।
জবাব দিতে গিয়ে পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাস বিকৃতি নিয়ে সংবাদপত্রে প্রতিবেদন প্রকাশের প্রসঙ্গ টানেন মন্ত্রী।
“এখন রায়ের মধ্যে যদি অপ্রাসঙ্গিকভাবে কেউ ইতিহাস সম্পর্কে কিছু বলতে গিয়ে আসল ইতিহাসের বাইরে গিয়ে কিছু বলে, তাহলে এটা যারা করেছেন, তাদেরকে ধরিয়ে দেওয়ার অধিকারটুকু কী আমার নাই?”
আনিসুল হক বলেন, ওই রায়ে এমন এক জায়গায় ‘আঘাত করা হয়েছে’, যা অনেকেরই ‘হৃদয়ে লেগেছে’।
তথ্য-প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী বলেন, এমন কোন আইন সরকার করবে না, যা ‘সাংবাদিক বান্ধব নয়’। কিন্তু অপরাধকে অপরাধ হিসেবেই গণ্য করতে হবে।
“আপনারা অপেক্ষা করেন। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের ১৯ ও ২০ ধারা আপনাদের সামনে যখন আসবে, কোনো আপত্তি থাকলে বলতে পারেন। আমার বিশ্বাস আপনাদের সামনে এলে আপনারা সেটা গ্রহণ করতে পারবেন।”