আশকোনা হজ ক্যাম্পের কাছে যে জায়গায় র্যাবের নতুন সদর দপ্তরের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে, সেখানেই শুক্রবার জুমার নামাজের ঠিক আগে এ ঘটনা ঘটে।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে দুটি জঙ্গি আস্তানায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের পরদিন আশকোনার এ ঘটনাকে জঙ্গি হামলা বলেই মনে করছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক ও র্যাবের পরিচালক (গণমাধ্যম) মুফতি মাহমুদ খান।
র্যাবের ভাষ্য, প্রাচীর ডিঙিয়ে অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যাক্তিকে ফোর্সেস ব্যারাকের সীমানায় ঢুকতে দেখে র্যাব সদস্যরা তাকে ‘চ্যালেঞ্জ’ করেন। পালানোর চেষ্টার সময় তার শরীরে রাখা বোমা বিস্ফোরিত হয়।
এ ঘটনায় আহত হয়েছেন দুই র্যাব সদস্য; তাদের ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
‘আত্মঘাতী’ বিস্ফোরণের পরপরই দেশের সব বিমানবন্দর, নৌবন্দর ও কারাগারে জারি করা হয়েছে সতর্কতা।
গতবছর জুলাই মাসে গুলশান ও শোলাকিয়ায় হামলার পর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক অভিযানের মধ্যে বেশ কিছুদিন পরিস্থিতি শান্ত থাকলেও মার্চের ৬ তারিখ থেকে ১১ দিনে চারটি ঘটনায় জঙ্গিরা নতুন করে তাদের তৎপরতার জানান দিল।
আইএস-এর মুখপত্র আমাক নিউজ এজেন্সিতে এই ‘হামলার’ খবর এলেও এবার সরাসরি দায় স্বীকারের কোনো বার্তা তারা দেয়নি।
আর বাংলাদেশে আইএস এর ‘অস্তিত্ব নেই’ দাবি করে আসা পুলিশ কর্মকর্তারাও আগের অবস্থান ধরে রেখেছেন।
যেভাবে ঘটনা
আশকোনার ওই কম্পাউন্ডের ভেতরে র্যাব হেড কোয়ার্টারের ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয় মাস তিনেক আগে। ঢোকা বা বের হওয়ার জন্য উত্তর পাশে রয়েছে একটিমাত্র গেইট। বাইরে সাইন বোর্ডে লেখা রয়েছে ‘ফোর্সেস ব্যারাক, র্যাব ফোর্সেস সদর দপ্তর’।
নির্মাণ কাজের সুবিধার জন্য কম্পাউন্ডের ভেতরে ইট বিছিয়ে একটি রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। এক পাশে স্তূপ করে রাখা হয়েছে কিছু ইট। বেশ কয়েকটি গাড়িও দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। অন্য পাশেই টিনশেড ব্যারাক।
র্যাব হেড কোয়ার্টারের লিগ্যাল ও মিডিয়া উইং এবং যোগাযোগ বিভাগের ব্যাচেলর কিছু সদস্য ছাড়াও নির্মাণকর্মী ও তদারককারীরা ওই ব্যারাকে থাকেন। পাশেই একটি জায়গায় তারা গোসল করা বা কাপড় ধোয়ার কাজ সারেন। বিস্ফোরণের ঘটনাটি সেখানেই ঘটেছে বলে এক ব্রিফিংয়ে জানান মুফতি মাহমুদ খান।
তিনি বলেন, “আনুমানিক বেলা ১টার দিকে নামাজের আগে আগে ডানপাশের বাউন্ডারি, যা গ্রিল ও ওয়াল দিয়ে নির্মিত, সেটি টপকে একজন অপরিচিত লোক ঢোকে। র্যাব সদস্যরা তাকে দেখে চ্যালেঞ্জ করলে সে এস্কেপ করতে চায় এবং সাথে সাথে এক্সপ্লোশন ঘটে। এতে তার সাথে যে বোমা ছিল তা বিস্ফোরিত হয়ে তার মৃত্যু হয়।”
সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন দুই র্যাব সদস্য আশঙ্কামুক্ত বলে মুফতি মাহমুদ জানান।
ছুটির দিনের দুপুরে ওই বিস্ফোরণের খবরে র্যাব ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আশকোনায় ছুটে যান। ক্যাম্পের বাইরে ভিড় করে উৎসুক জনতা।
র্যাবের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার গাড়ি চালক জানান, হজ ক্যাম্পের মসজিদে জুমার নামাজের আগে খুতবা চলার সময় হঠাৎ বিকট বিস্ফোরণের শব্দ শোনেন তারা। ব্যারাকের ফাঁকা জায়গায় রাখা গাড়ির ক্ষতি হল কিনা দেখতে তিনি মসজিদ থেকে বেরিয়ে আসেন। এরপর ব্যারাকে গিয়ে ক্ষতবিক্ষত লাশ পড়ে থাকতে দেখেন।
ফোর্সেস ব্যারাকের উল্টো পাশে দাদু স্টোর নামে একটি চায়ের দোকান চালান বশির আহমেদ। তিনি জানান, জুমার নামাজের আগ মুহূর্তে মানুষ যখন মসজিদে ঢুকছিল, তখনই হঠাৎ বিকট শব্দ হয়।
“প্রথমে মনে করছি বিদ্যুতের ট্রান্সফর্মার গ্যাছে। কিন্তু বিদ্যুত তো গেল না। তারপর ব্যারাকের মাঠে দেখি হালকা ধোঁয়া। দৌড়ায়া ব্যারাকের গেইটে গিয়া দেখি, একটি লোক পইড়া আছে।”
পুলিশ মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক ও র্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমদও বিকালে ঘটনাস্থলে আসেন। তবে সাংবাদিকদের সঙ্গে সেখানে কথা বলেননি তারা।
ঘটনাস্থলের আশপাশে আরও বিস্ফোরক আছে কি না, তা খুঁজে দেখেন র্যাবের বোমা বিশেষজ্ঞ দলের সদস্যরা। তবে নতুন কিছু সেখানে পাওয়া যায়নি।
‘জঙ্গিরাই ঘটিয়েছে’
আশকোনার ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পর আইএস-এর মুখপত্র আমাক নিউজ এজেন্সিতে ওই হামলার খবর আসার কথা জানায় সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে পুলিশ মহাপরিদর্শক শহীদুল হক সন্ধ্যায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আইএসের মিডিয়ায় খবর আসা বা দায় স্বীকারের কোনো তথ্য তার ‘জানা নেই’।
“বিষয়টি তদন্তাধীন। তবে প্রাথমিক ধারণা, ঘটনাটি জঙ্গিরাই ঘটিয়েছে।”
এর আগে ঘটনার পরপরই আশকোনার ব্যারাকে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে র্যাব পরিচালক (গণমাধ্যম) মুফতি মাহমুদ খান বলেন, “এখুনি নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে যেভাবে হামলা হয়েছে, তাতে ধারণা করা যায় যে সে (হামলাকারী) জঙ্গিগোষ্ঠীর।”
২০১৫ সালের শুরু থেকে ২০১৬ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত একের পর এক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী লেখক, ব্লগার, প্রকাশকরা। তল্লাশি চৌকিতে হামলা চালিয়ে পুলিশ হত্যা এবং চট্টগ্রামের নৌ বাহিনীর মসজিদে আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণের ঘটনাও সে সময় ঘটেছে।
গতবছর জুলাই মাসের প্রথম দিন গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে নজিরবিহীন জঙ্গি হামলায় নিহত হন ১৭ বিদেশিসহ ২২ জন। এক সপ্তাহের মাথায় শোলাকিয়ায় ঈদের দিন আবারও জঙ্গি হামলা হয়।
কিন্তু মার্চ মাসের শুরু থেকে পর পর চারটি ঘটনায় জঙ্গিদের নতুন করে শক্তি সঞ্চয় ও সংগঠিত হওয়ার ইংগিত আসে।
৬ মার্চ: হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি হান্নান ও তার সহযোগীদের আদালত থেকে কাশিমপুর কারাগারে ফিরিয়ে নেওয়ার পথে প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে তাদের ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা হয়।
৭ মার্চ: কুমিল্লায় একটি বাসে তল্লাশির সময় পুলিশের দিকে বোমা ছোড়ার পর ধরা পড়ে ‘নব্য জেএমবির’ দুই জঙ্গি। তাদের মধ্যে একজনকে সঙ্গে নিয়ে ওই রাতে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে অস্ত্র ও বোমা উদ্ধার করে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট।
১৫ মার্চ: সীতাকুণ্ড পৌর এলাকার আমিরাবাদের এক বাড়ি থেকে বিস্ফোরকসহ এক জঙ্গি দম্পতিকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রেমতলা এলাকায় আরেক বাড়িতে অভিযানে যায় পুলিশ।
১৬ মার্চ: দীর্ঘ ১৯ ঘণ্টা ঘেরাও করে রাখার পর প্রেমতলার ওই বাড়িতে শুরু হয় ‘অপারেশন অ্যাসল্ট সিক্সটিন’। আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ও গুলিতে এক নারীসহ চার জঙ্গি নিহত হন। এছাড়া ভেতরে বোমায় বিক্ষত এক শিশুর লাশ পাওয়া যায়।
পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, সীতাকুণ্ডের ঘটনার প্রেক্ষাপটে বৃহস্পতিবার দুপুরেই সর্তকতা ও তথ্য সংগ্রহের বিষয়ে নির্দেশনা দিয়ে বিভিন্ন রেঞ্জের ডিআইজি, র্যাব, এসবি, সিআইডি, পিবিআইসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর প্রধানদের দুটি চিঠি পাঠানো হয়।
এর মধ্যে একটি চিঠিতে মসজিদ, মন্দির, গীর্জাসহ বিভিন্ন উপসনালয়, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসহ স্পর্শকাতর জায়গায় নজরদারি ও সতর্কতা বাড়ানোর নির্দেশনা এবং অন্যটিতে জঙ্গিদের ব্যাপারে মাঠ পর্যায়ের তথ্য সংগ্রহ করে পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠানোর বিষয়ে বলা হয়।
কিন্তু এরপর ২৪ ঘণ্টা পার না হতেই র্যাবের ব্যারাকে আত্মঘাতী বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।
কয়েক মাস পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে শান্ত থাকায় সতর্কতায় ঘাটতি তৈরি হয়েছিল কি না জানতে চাইলে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটে অতিরিক্ত উপ-কমিশনার ছানোয়ার হোসেন বলেন, তেমন কিছু তিনি মনে করছেন না।
“আমরা আমাদের মত কাজ করি। কিন্তু জঙ্গিরাও তাদের মত চেষ্টা করে অবস্থান বা উপস্থিতির জানান দিতে। আজ তারই একটি বহিঃপ্রকাশ দেখা গেল।
“আমাদের অভিযানে যদি তাদের ১০ হাতের আটটি কাটা পড়ে, তারপরও দুই হাত থাকে। ওই দুই হাত আবার বাড়তে চেষ্টা করে। তবে আমাদের অনবরত চেষ্টায় হুমকির লেভেলটা কমতে থাকে।”
এইভাবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চেষ্টায় জঙ্গিদের আর ‘অবস্থান জানান দেওয়ার অবস্থা থাকবে না’ বলে আশা এই পুলিশ কর্মকর্তার।
র্যাবের মুফতি মাহমুদ খানও মনে করেন, এখানে কারও কোনো ‘ঘাটতি নেই’।
“সবাই কাজ করছে। র্যাব ও অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে অনেক জঙ্গি ধরা পড়েছে, অভিযানে মারাও গেছে।থ্রেট লেভেল কমানোই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ।”