ফ্লাইওভারের নিচে ‘মৃত্যুফাঁদ’

বিরতিহীন চলছে বাস, ট্রাক, প্রাইভেটকারসহ নানা ধরনের যানবাহন; পথচারীরা অপেক্ষায় কখন একটু ফাঁক মিলবে ওপারে যাওয়ার। উপায় না পেয়ে কেউ কেউ হুটোপুটি করে এঁকেবেঁকে চলন্ত গাড়ির সামনে বা পেছন দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছেন।

ওবায়দুর মাসুমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 July 2016, 03:34 AM
Updated : 10 July 2016, 11:13 AM

রাজধানীর যাত্রাবাড়ী-সায়েদাবাদের প্রধান সড়কসহ এলাকাটির উপর দিয়ে যাওয়া মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের নিচের প্রতিদিনকার চিত্র যেন এমন।

রাস্তা পারাপারের পরিকল্পিত ব্যবস্থা না থাকায় এমন পরিস্থিতি হয়েছে নগরীর এই এলাকার। সমস্যা সমাধানে ‘ভেবে দেখার’ আশ্বাসও দিয়েছেন প্রয়াত মেয়র হানিফের ছেলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাইদ খোকন।

চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি জেলার মানুষ যাত্রাবাড়ী ও সায়েদাবাদ এলাকা হয়ে রাজধানীতে প্রবেশ করে। যাত্রাবাড়ী, দনিয়া, শ্যামপুর, ডেমরাসহ রাজধানীর পূর্বাংশের লোকজন সড়কটি দিয়ে নগরীর অন্যান্য এলাকায় যাতায়াত করে। সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে যাতায়াতের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ এ সড়ক ব্যবহার করতে হয়।

পুলিশের হিসাবে গত আড়াই বছরে ওই ফ্লাইওভারের নিচে সড়কে দুর্ঘটনায় মারা গেছে অর্ধশতাধিক মানুষ।

সরেজমিনে দেখা গেছে, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, কাপ্তানবাজার, দোলাইরপাড়, কাজলা এবং দনিয়া এলাকায় রাস্তা পার হওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। সড়কে নেই জেব্রাক্রসিং-সঙ্কেত বাতিসহ রাস্তা পার হওয়ার অন্য কোনো সাংকেতিক নির্দেশনা। ব্যস্ততম চৌরাস্তা হলেও ঈদের আগের ব্যস্ততম সময়েও যাত্রাবাড়ীতে পথচারী পার করতে ট্রাফিক পুলিশের কোনো তৎপরতা চোখে পড়েনি। একই অবস্থা দেখা যায় সায়েদাবাদের জনপথ চৌরাস্তায়ও।

আড়াই বছরে ৫২ পথচারীর মৃত্যু

মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের বেশিরভাগ অংশ ওয়ারী ও যাত্রাবাড়ী থানা এলাকায়। দুই থানার সড়ক দুর্ঘটনা সংক্রান্ত মামলার নথি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত ফ্লাইওভারের নিচের সড়কের গুলিস্তান থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী, ডেমরা সড়কের কাজলা, মাওয়া সড়কের দোলাইরপাড় প্রান্ত এবং ফ্লাইওভারের গোলাপবাগ অংশে ৫২ জন পথচারী মারা গেছেন। সবচেয়ে বেশি ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা এলাকায়। ১০ জন মারা গেছেন সায়েদাবাদ এলাকায়।

তবে সেখানে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত পথচারীর প্রকৃত সংখ্যা বেশি বলে জানান যাত্রাবাড়ী থানার ওসি মো. আনিসুর রহমান।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “যে পরিমাণ দুর্ঘটনা ঘটে থানায় মামলা হয় তার চেয়ে কম। নিহতের আত্মীয়রা থানার অনুমতি নিয়ে লাশ দাফন করে ফেলে। অনেক সময় আমরা দুর্ঘটনার কথা জানতেও পারি না। ঘটনাস্থল থেকেই মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয়।”

‘এখন প্রাণটা হাতে নিয়ে পার হই’

ফ্লাইওভারের নিচে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে জানিয়ে সেখানকার ফুটপাতের দোকানি আবু সাঈদ বলেন, “গত মাসে আমার চোখের সামনেই বাপ আর পোলার অ্যাকসিডিন হইল। পোলার মাথার উপর দিয়া চাক্কা চইলা গেল। বাপেও ব্যাথা পাইছিল।”

ফ্লাইওভার চালু হলেও সড়কে পথচারী পারপারের ব্যবস্থা না থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করে উত্তর যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা আবদুল আজিজ বলেন, ‘জনগণের কষ্ট দেখার কেউ নেই। এখানে ফ্লাইওভার করে আমাদের কী লাভ হল। আগে আমরা ওভারব্রিজে পার হতাম, এখন প্রাণটা হাতে নিয়ে পার হই।’

শেখদি এলাকার বাসিন্দা কলেজছাত্র ওয়াসিউল আকরামও জানালেন প্রতিদিন আতঙ্ক নিয়ে সড়ক পার হওয়ার কথা।

“চালকরা সামনে দেখে চালায় না। সবসময় একটা আতঙ্কের মধ্যে রাস্তা পার হতে হয়। এইমাত্র একটা গাড়ি আমার মাত্র দুই ইঞ্চি দূর দিয়ে গেল। আরেকটু হলেই গেছিলাম,” বলেন বিএএফ শাহীন কলেজের এই শিক্ষার্থী।

বিবিরবাগিচার বাসিন্দা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অপূর্ব বিশ্বাসও মনে করেন, চালকদের বেপরোয়া গতির কারণেই এ এলাকায় বেশি দুর্ঘটনা ঘটে।

“এখানে গাড়ি খুব দ্রুত চলে। কাউকে কেয়ার করে না,” বলেন তিনি।

যাত্রাবাড়ী স্কুল রোডের বাসিন্দা দেলোয়ার হোসাইন ট্রাফিক পুলিশের ভূমিকার সমালোচনা করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ এলাকায় প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু পথচারীদের রাস্তা পারাপারে পুলিশ সহায়তা করে না।”

বয়স্ক, নারী ও শিশুরা এ এলাকায় চলাচলে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়ে বলে জানান কাজলার ড. মাহবুবুর রহমান কলেজের প্রভাষক কামাল হোসেন।

“আমি নিজেও কয়েকবার বড় বিপদ থেকে বেঁচে গেছি,” বলেন তিনি।

উধাও ফুটওভারব্রিজ-আন্ডারপাস, বেহাল ফুটপাত

মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার নির্মাণের সময় যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তার বহুমুখী ফুটওভারব্রিজটি ভেঙে ফেলা হয়; সায়েদাবাদ জনপথ মোড়ের আন্ডারপাসটি বন্ধ করে দেওয়া হয় ফ্লাইওভার চালুর পর।

আর ফ্লাইওভারের জন্য নিচের সড়ক ও ফুটপাতের যেসব এলাকায় খোঁড়াখুঁড়ি করা হয় সেসব জায়গায় হয়নি পরিকল্পিত সংস্কার। ফলে অনেক জায়গায় ফুটপাতের অবস্থা বেহাল। এছাড়া সড়কে দেওয়া হয়নি জেব্রাক্রসিং; ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় দেওয়া হয়নি গতিরোধকও।

সরেজমিন আরও দেখা গেছে, যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা থেকে ফ্লাইওভারের টোলপ্লাজা হয়ে কুতুবখালী পর্যন্ত রাস্তা পার হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ অংশে সড়কের দুই পাশে নেই ফুটপাতও। যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা থেকে দোলাইরপার পর্যন্ত যে সরু ফুটপাত তা দোকানপাট ও গ্যারেজের দখলে।

যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা থেকে যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল স্কুল, সায়েদাবাদ জনপথ মোড় থেকে সায়েদাবাদ রেলক্রসিং, রেলক্রসিং থেকে টিকাটুলী মোড় পর্যন্ত এলাকায়ও পথচারীর রাস্তা পার হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট কোনো জায়গা রাখা হয়নি। টিকাটুলী থেকে জয়কালী মন্দির, জয়কালী মন্দির থেকে কাপ্তানবাজারের টোলপ্লাজা পর্যন্তও নেই পথচারীদের রাস্তা পার হওয়ার ব্যবস্থা।

ফ্লাইওভারের নিচের এসব অংশে দুই স্তরে উঁচু বিভাজক দিয়ে চার ভাগ করা হয়েছে সড়ক। কেউ কেউ সেগুলো ডিঙিয়ে রাস্তা পার হন।

এলাকাটিতে পথচারীদের রাস্তা পার হওয়ার ‘নির্দিষ্ট ব্যবস্থা’ না থাকায় যানবাহন নিয়ন্ত্রণও কঠিন হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের ডেমরা বিভাগের সহকারী কমিশনার গোবিন্দ চন্দ্র পাল। আন্ডারপাস করা হলে অবস্থার উন্নতি হবে বলে মনে করেন তিনি।

“কোনো ব্যবস্থা না থাকায় এলোমেলোভাবে সবাই চলাফেরা করে। চলন্ত গাড়ির সামনে দিয়েও দৌঁড় দেয় কেউ কেউ। এসব নিয়ন্ত্রণ খুব কঠিন,” বলেন গোবিন্দ চন্দ্র পাল।

দায় নেবে কে?

বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক মনে করেন, যে কোনো নগরীর সড়কসহ সব ধরনের অবকাঠামোর নকশা পথচারীবান্ধব হওয়া উচিত। হানিফ ফ্লাইওভারের বেলায় তার কোনো প্রতিফলন নেই।

“পথচারী পারাপারের দিক বিবেচনায় এই ফ্লাইওভার অবৈজ্ঞানিক ও অনিরাপদভাবে তৈরি করা হয়েছে। কোনো স্থাপনা তৈরি করতে গিয়ে পথচারী পারাপারের সুযোগ কমিয়ে ফেলা হয়েছে, এমন নজির পৃথিবীর কোথাও নেই। এটা সম্পূর্ণ অনৈতিক,” বলেন তিনি।

সমস্যা সমাধানে আন্ডারপাস ও প্রশস্ত ফুটপাত তৈরি এবং আধুনিক ট্রাফিক সিগন্যাল বসানোর পরামর্শ দেন বুয়েটের এই অধ্যাপক।

তবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন জানান, ফ্লাইওভারে নকশার কারণে পথচারী পারাপারের জন্য প্রয়োজনীয় স্থাপনা তৈরির সুযোগ সীমিত।

পথচারীদের চলাচল সহজ করতে কী করা যায়- তা ভেবে দেখার আশ্বাস দিয়ে ঢাকা দক্ষিণের নগরপিতা বলেন, “ফ্লাইওভারের নিচের সড়কের সংস্কার কাজ চলছে। আগে রাস্তার কাজ শেষ হোক, তারপর রাস্তা পারাপারের জন্য কিছু করা যায় কি না- ভেবে দেখব।”