রাজাকাররা বাবাকে নির্যাতন করেছিল: রাষ্ট্রপতি হামিদ

ছেলে মুজিব বাহিনীর সাব সেক্টর কমান্ডার, তাই একাত্তরে কিশোরগঞ্জের হাজি মো. তায়েব উদ্দিনকে রাজাকার বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল; স্বাধীন দেশের মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেওয়ার সুযোগ তার হয়নি।

সাজিদুল হকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Dec 2015, 08:49 AM
Updated : 15 Dec 2015, 08:50 AM

মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয়ের ৪৪তম বার্ষিকীর প্রাক্কালে আগুনঝরা সেইসব দিনের কথা স্মরণ করেছেন বাংলাদেশের আজকের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।     

ছেলে যুদ্ধে যাওয়ার পর আরও অনেকের মতো ভারতে আশ্রয় নিতে হয়েছিল তায়েব উদ্দিনকে। তিনি দেশে ফেরেন বিজয়ের আগের মাসে, ১৯৭১ সালের নভেম্বরে।

“হি ওয়াজ টর্চার্ড বাই রাজাকারস। নভেম্বরেই বাড়িতে ফিরে মারা গেছেন,” বলেন হামিদ।  

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে এক একান্ত আলাপচারিতায় রাষ্ট্রপতি হামিদ বলেছেন তার ছাত্র রাজনীতি থেকে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার দিনগুলোর কথা। রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে সংযুক্ত অন্য তিনটি সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন এ সময়।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে প্রথম পরিচয় এবং ভারতে মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের অনেক ঘটনা যেমন এই আলোচনায় এসেছে, তেমনি এসেছে স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতি নিয়ে কষ্টের কথা, তরুণ প্রজন্মের কাছে একজন মুক্তিযোদ্ধার প্রত্যাশার কথা।

১৯৭০ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত হওয়ার পর স্বাধীন বাংলাদেশে যতবার নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, প্রতিবারই বিজয়ী হয়েছেন আবদুল হামিদ। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে দুই বার জাতীয় সংসদের স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল আবদুল হামিদ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। তারপর থেকে বঙ্গভবনের বাসিন্দা হলেও ভাটি অঞ্চল তাকে এখনো টানে;

১৯৬২ সালের ৩১ ডিসেম্বর তখনকার ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি মুসলিম লীগ নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরী (সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বাবা) কিশোরগঞ্জে গেলে তার সভা ভণ্ডুল করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন আবদুল হামিদ।

৭২ বছর বয়সী হামিদ মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের আগরতলায় রিক্রুটিং ক্যাম্পে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন। তখনকার সুনামগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ জেলা নিয়ে গঠিত বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ) বা মুজিব বাহিনীর সাব সেক্টর কমান্ডার ছিলেন তিনি।

মুক্তিযুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতি হিসাবে ২০১৩ সালে আবদুল হামিদকে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করে সরকার।

মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার অনুপ্রেরণা কীভাবে পেলেন? কোনো নির্দিষ্ট ঘটনা ছিল?

এটা হলো, সাধারণ যে মানুষ তাদের জন্য এ প্রশ্নটা প্রযোজ্য। কারণ হলো- মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে, যাওয়ার ব্যাপারটা তাদের জন্য ছিল। যারা সাধারণ মানুষ রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল না। আমি যেহেতু তখন ছাত্রনেতা ছিলাম, পরে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছি, প্রেক্ষাপটটা আমার জানা। আমি স্কুলে যখন পড়ি তখন থেকে ছাত্রলীগ করি, ১৯৫৯ সালে। ১৯৬১ সালে মেট্রিক পাস করে কলেজে ভর্তি হই, আইয়ুববিরোধী আন্দোলন করি। ১৯৬২ তে শিক্ষা আন্দোলন করি। আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলাম, নেতৃত্বে ছিলাম।

পরে ১৯৬৬ সালে যখন বঙ্গবন্ধু ছয় দফা দিলেন; বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা দিছে যে, সেখানে স্বাধীনতার ঘোষণার কথা বলে নাই। কিন্তু ছয় দফাটা এমনই একটা অবস্থা ছিল... ছয় দফা প্রস্তাবটা মেনে নেওয়া মানে... স্বায়ত্বশাসনের কথা যদিও বলা আছে, অনেকাংশে এটা স্বাধীনতার মতো হয়ে যেত।

আমরা বক্তৃতা যখন দিছি, ছয় দফা মেনে নিতে হবে, না হলে পাকিস্তানের সঙ্গে কথা নেই… না হলে একদফায় যেতে হবে। এ ধরনের কথা আমরা ছাত্ররা বলছি, আওয়ামী লীগ তখন বলে নাই। আমরা ছাত্ররা বরং একধাপ আগায়া বলছি, ছয় দফা না মানলে একদফা হয়ে যাবে। এক দফাতো বুঝেনই, স্বাধীনতা। এটা কিন্তু ৬৬ সাল থেকেই আমরা ছাত্রজনসভায় বলছি।

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের ঘটনা…

উনার সঙ্গে প্রথম পরিচয়টা ১৯৬৪ সালে। ছাত্র রাজনীতি করি। ঢাকায় বা স্থানীয় আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক ছিলে না। ছাত্র আমরা আলাদা, ছাত্রই। তবে আওয়ামী লীগের কোনো জনসভা হলে সেখানে আমরা যাইতাম। আমাদের বললে আমরা মাইক মাইরা দিতাম। তারা অনেক সময় নিতে চাইতেন না, তবুও এ ধরনের কাজে আমাদের নিতেন। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ, পূর্বপাকিস্তান ছাত্রলীগের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ; কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সঙ্গে না। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেতো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু ১৯৬৪ সালে বঙ্গবন্ধু যখন কিশোরগঞ্জে গেল আওয়ামী লীগের একটা জনসভা করার জন্য, তখন আমরা স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ প্রকাশ করলাম। আমরা বললাম, আমরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে চাই। তারা বলল, না ছাত্রদের দেওয়া যাবে না। সিনেমা হলের মধ্যে ওই মিটিং হয়েছিল।

এখনকার অবস্থাতো তখন ছিল না। যখন আওয়ামী লীগের মুরুব্বিরা বলছে, তোমরা আসতে পারবে না… তখন এইটাই সিদ্ধান্ত। এখন হলে তো হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ত। তখন আমরা ঢুকি নাই। তবে এর প্রতিবাদে দুই-আড়াইশ ছাত্র নিয়ে বাইরে অবস্থান নিলাম। বঙ্গবন্ধু যখন বের হয়ে আসল... যেহেতু আমি কিশোরগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি। আমি আগায়া গিয়া সালাম দিয়া বললাম, এই ব্যাপার, আমি এই। বললাম, আমরাতো আপনার বক্তব্য শুনতে চাইলাম, যাইবার দিল না… হল অনেকটা খালি রইল। উনি তখন আমার পিঠ চাপড়ায়া বলল, ‘আরে- তোমাদের নিয়েই আমার সব। তোমাদেরই সবকিছু করতে হবে। কাজ করে যাও।’ এ ধরনের ইনসপিরেশন দিয়া অনেক কথা বললেন। 

এই হলো উনার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। দাঁড়িয়ে থেকেই ১৫-২০ মিনিট আলাপ করছি। তখন ছাত্ররা সব পিছনেই ছিলে। সবারই, সামনে যারা ছিল, মাথায় হাত দিছে। খুব আপন করে নিছে। ওই সাক্ষাতে আমরা সবাই খুব ইম্প্রেসড হয়েছিলাম। ছাত্রলীগ যে করি, উনার আদর্শ নিয়ে যে রাজনীতি করি, এর একটা আত্মতৃপ্তি পেলাম। এই উনার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা।

মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতির কথা বলছিলেন...

১৯৭০ এর নির্বাচনে যখন নির্বাচিত হলাম, তারপর খুব সম্ভব তেশরা জানুয়ারি (১৯৭১), সকল এমপিএ ও এমএনএ, মানে প্রাদেশিক পরিষদ আর জাতীয় পরিষদের সকল সদস্যের শপথ হলো ঢাকার রেসকোর্স ময়াদানে। মানে ছয় দফার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করব না। জনগণের কথা এইসব...। চলে গেলাম কিশোরগঞ্জ। অধিবেশন ডাকল মার্চের ৩ তারিখ। অধিবেশন ডাকছে যখন, ঢাকা আসছি, ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি মেম্বারের কার্ড নিলাম। বর্তমান যে প্রধানমন্ত্রীর অফিস- সেইটা পার্লামেন্ট ছিল, সেখান থেকে কার্ড নিলাম। এমএনএ হোস্টেলে সিট নিছি। তিন-চারদিন ছিলাম। এর মধ্যে... আমি তখন বায়তুল মোকাররমের এদিকে কী যেন কেনা-কাটা করতে আসছিলাম… ইয়াহিয়া খান ভাষণ দিল দুপুর ১টার দিকে। বলল- ৩ তারিখ অধিবেশন বন্ধ। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কিছু কথা বলল। পাকিস্তান থেকেও কিন্তু এমএনএ মেম্বার আসছিল, টু অ্যাটেন্ড দ্যা পার্লামেন্ট; ১০-১২ জন এসে পড়ছিল।

ঠিক ২টা কি ৩টা মনে নাই, এক তারিখ... হোটেল পূর্বাণীতে বঙ্গবন্ধু এমএনএদের ডাকল। প্রেস কনফারেন্স। এর মধ্যে সারা ঢাকা শহরে লাঠি-সোঁটা, যার যা হাতে ছিল, মিছিল বের হয়ে গেল। মানুষ বের হয়ে পড়ল। সেখানে গেলাম। কথাবার্তা বলল। ইনডিভিজুয়ালি অনেককে অনেক কথা বলল। আমি যখন সামনে পড়লাম, আমারে বলল- ‘এই হামিদ এদিকে আস। তুমি আজকেই চলে যাও কিশোরগঞ্জ। আন্দোলন করতে হবে।’ আমি বললাম, আজকে তো ট্রেন… । বললেন, ‘না আজকেই যেতে হবে। চেষ্টা করো। কালকে যেতে গেলে অসুবিধা হতে পারে। আজকেই চলে যাও।’

...পরে ১৭ মার্চ কিশোরগঞ্জের রথখোলা মাঠে এক জনসভায় পাকিস্তানের পতাকা নামায়া বাংলাদেশের পতাকা তুললাম।

৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ কীভাবে শুনলেন?

ওই সময় বঙ্গবন্ধু বলছিল, যারা আশপাশে থাকে তারাই যেন যায়। দূর থেকে আসা-যাওয়ার সমস্য হতে পারে বলে উনি এ কথা বলেছিলেন। আমি ওইদিন ঢাকায় আসি নাই। ওয়েট করছিলাম, রেডিওতে সরাসরি শুনব। কিন্তু রেডিওতে দেয় নাই। সন্ধ্যার পরে কলকাতা থেকে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বিবিসি থেকে আমরা শুনলাম কী বলেছে। ফলোয়িং ডে’তে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ পূর্ব পাকিস্তান রেডিও পুরোটাই বাজাইছে। ওই বক্তৃতায় কিন্তু বঙ্গবন্ধু বলছে, ‘এখন থেকে আমার কথাই মানতে হবে।’

স্বাধীনতার ঘোষণা কীভাবে...

আমি যেহেতু এমএনএ ছিলাম। ২৫ তারিখের পরে আমি কিন্তু...আই রিসিভড আ টেলিগ্রাম। বঙ্গবন্ধু টেলিগ্রাম পাঠাইছে। আমরা স্বাধীনতা ঘোষণা করলাম। আমরা, একটা বাঙালি বেঁচে থাকতে লড়াই ছাড়ব না। এ লড়াইয়ে জিততে হবে। এ ধরনের কথা-বার্তা মোটামুটি বাংলাতে একটা মেসেজ পাঠাইছিল। ওইটা আমার কাছে ছিল অনেকদিন। এখন খুঁজলে পাব কিনা জানি না। এমএনএরা পেয়েছিল।

মেসেজটা পেয়েছিলেন কবে?

২৫ তারিখের মেসেজ আমি ২৬ তারিখ পেয়েছিলাম। এটা পাবার পর ... যুদ্ধ সম্পর্কেতো অভিজ্ঞতা ছিলো না। দা-লাঠি-রামদা-তলোয়ার বানাইতে কামাররে অর্ডার দিলাম। ৫০-৬০টা রামদা, তলোয়ার বানাইছি। আর মলোটোভ ককটেল যেটা আছে না… বোতলের ভিতরে পেট্রোল ভরে সুতলি দিয়ে মুখ বন্ধ করে দিছি। এইগুলা পাঁচ-সাতশ বানাইছি। ভাবছি পাক আর্মি আসলে বিল্ডিংয়ের উপর থেকে আক্রমণ করব।

এর মধ্যে একজন ক্যাপ্টেন ছিল, জাহাঙ্গীর। সে কিশোরগঞ্জ আসলো। সে থাকতে থাকতে আসলো সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলো যে, তখন মেজর ছিল। মেজর শফিউল্লাহ।

ব্যাংক লুটের একটা ঘটনা ছিল বোধহয়...

এপ্রিলের ৬-৭ তারিখে বলল... কিশোরগঞ্জে যে একটা ব্যাংক আছে… ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান। কিশোরগঞ্জে একটা, বাজিতপুরে একটা আর ভৈরব বাজারে একটা ব্রাঞ্চ ছিলে।  তিনটা ব্রাঞ্চে ১১ কোটি ৭৮ লাখ ৮৬ হাজার টাকা। বড় বড় নোট নিয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাইতে বলল। বলল- সেখানে লিবারেটেড জোন থাকবে। এখানে পতন হলেও ওখানে স্বাধীনতা রাখতে পারব। বলল ওখানে টাকার দরকার আছে, নিয়ে যেতে হবে। আমরা নাও করতে পারতেছি না, হ্যাঁও করতে পারতেছি না। কিছুটা সন্দেহ করতেছি, এইটা নিয়া না জানি আবার কোন লুটপাট হয়ে যায়।

তখন তারা বলল, এমপিএ-এমএনএ’র মধ্যে যে কোনো দুইজন যেতে হবে। কিন্তু কেউই রাজি না। তখন ওই আর্মির অফিসার বলল, ‘কী, আপনারা সাহস পাচ্ছেন না?’ এ ধরনের কথা বলল। পরে আমি প্রতিবাদ করে বললাম, না আমি যাব। আমরা যে ভয় পাই না, এটা প্রমাণ করার জন্য যেতে হবে। আমার সঙ্গে একটা ছেলে ছিলো সাগীর। মুক্তিযোদ্ধা, সেও সঙ্গে গেল। একটা টুটু বোর রাইফেল আর ব্যাগ নিয়া গেলাম। টাকা নিয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ব্যাংকে জমা দিলাম। পরে আর্মিরা তাদের পথে গেল, আমি আলাদা হয়ে গেলাম।

৮ এপ্রিল আমি জেলা পরিষদের ডাকবাংলোতে থাকলাম। এর মধ্যে একটা খবর পাইলাম। চিটাগং, কুমিল্লা, নোয়াখালীর কিছু এমএনএ- এমপিএ গেছে আগরতলা। আমি গেলাম। চিনি না কিছুই। পরে খুঁইজা বাইর করলাম। দেখলাম ৩৬ জন এমএনএ-এমপিএ উপস্থিত। এর মধ্যে পরিচিতদের মধ্যে খন্দকার মোশতাক ছিল (একুট হেসে), চিটাগংয়ের এম আর সিদ্দিকী ছিল, জহুর আহম্মদ চৌধুরী ছিল, মালেক উকিল তখনও আসে নাই। শুনছি তিনি আসবে। ওখানে বাংলাদেশের গভার্নমেন্ট কী ধরনের হবে সেটা আলাপ হলো। বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি করা হবে, উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। যেহেতু বঙ্গবন্ধু নাই, সে কারণে তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি। আর তাজউদ্দীন সাহেব প্রাইম মিনিস্টার। এই পর্যন্তই আলাপ হইছে। মিনিস্টার কে হবে, এগুলো ফারদার হয়তো ওরা কলকাতায় আলাপ করেছে। ওখানে এই পর্যন্তই আলাপ হইছে।  ১৪ তারিখ ব্যাক করলাম।

১৯ তারিখ সকালে শুনলাম আর্মি ভৈরব থেকে কিশোরগঞ্জ যাবে। হাঁটা ধরলাম জমির আইলের উপর দিয়ে। মিঠামইন যখন গেলাম, তখন বিকাল হয়ে গেছে। পৌঁছে শুনলাম আর্মি যশোদল আসছে। এটা কিশোরগঞ্জ থেকে ৩-৪ মাইল দূর। অর্থাৎ মিঠামইন থাকতেই কিশোরগঞ্জ ফল করছে। যেহেতু আমি বাড়িতে গেছি, লোকজন শঙ্কিত। এখানে না আর্মি আসে। এর মধ্যে ২৫ কী ২৬ তারিখ আমাদের গ্রামের বাড়িতে ফাইটার দিয়ে শেলিং করল।  তখন এলাকার ময়-মুরুব্বীরা বলল, বাবা তুমি থাকলে পাক আর্মি আইবোই। ইন্ডিয়া যাও গা। আমি বললাম আমিতো ইন্ডিয়া থেকে আসছি। দেশের কী হবে? ফাদারও বলল, এখানে থাকা ঠিক হবে না।

(হেসে উঠে) আমি আর বিদায় দেব কী, তারাই আমারে বিদায় দেয়। এর মধ্যে কিছু ছেলেপেলে খবর দিয়ে আনলাম। ৩১ তারিখ (এপ্রিল)... আমার সঙ্গে আরও সাতজন ছিল, ওই ছেলে সাগীরও ছিল। পয়লা মে আমার ইচ্ছা ছিল আগরতলা যাব। ভৈরব দিয়েতো সম্ভব হচ্ছে না। ভাবলাম আজমিরী দিয়া বানিয়াচং হয়ে হবিগঞ্জ দিয়ে চলে যাব আর কি। ১ তারিখ বানিয়াচংয়ের কাছে যাওয়ার পর শুনি পাক আর্মি আসতেছে। একটা গ্রামে থেকে পরের দিন আজমিরী গেলাম। পরের দিনে আরেক গ্রাম থেকে নৌকা নিয়া রওনা দিলাম। তিন দিন নৌকায়... গেলাম তাহিরপুর। তাহিরপুর থেকে হেঁটে টেকেরহাট গেলাম। পরে ৩৪ মাইল হেঁটে গেলাম বালাট (ভারত)।

এটা কত তারিখে

৭-৮ হবে। তারিখটা ঠিক এখন...

আপনিতো বিএলএফ (মুজিব বাহিনী) এর সাব-কমান্ডার ছিলেন।

এটা বলছি...ওখানে যখন গেলাম, সুনামগঞ্জের এমপিএরা ছিল। বিভিন্ন ধরনের বাসা-বাড়ি আছে যে তারা ম্যানেজ করছে। আমার গিয়ে থাকার জায়গা নেই। এক খাসিয়ার চায়ের দোকানে গিয়ে চা খাইলাম। সেখানে অর্ডার দিয়া রান্না করাইয়া খাইলাম। প্রথমদিন বাজারের মাচায় ছিলাম। দুই দিন পর ওই দোকানে গিয়ে বললাম, আমরা রাতে থাকব, তালা মাইরো না। তখন ওখানেই লুঙ্গি বিছায়া থাকলাম, মাটির উপর। আমিতো একটু লেট রাইজার। ওরা দোকান খুলে ঝাড়ু দিত আর আমারে বাড়ি দিত ‘এই বাঙ্গাল ওঠ’।

মে মাসের ১০-১৫ তারিখ পর্যন্ত শুধু শরণার্থী আসছে। মানে, মুক্তিযুদ্ধে যাবে এমন আরকি… আর যাবে যে তার কোনো ইয়ে নাই। তো আমি শিলং গেলাম। সেখানে গর্জিয়াস একটা বাংলো। সেখানে দেখলাম মীর শওকত আলী, সে তখন লেফটেন্যান্ট কর্নেল (৫ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার)।  আমি গিয়ে পরিচিত হলাম। যুদ্ধের কথা জিজ্ঞেস করলাম। তো কয়, আপনারা সিভিলিয়ান। যুদ্ধের বিষয় আমাদের। আমি বললাম, সিভিলিয়ান সহযোগিতা ছাড়া যুদ্ধ করবেন কেমনে? কী আলাপ করেন এইগুলা? মুক্তিযোদ্ধাদের কোথায় নেওয়া হচ্ছে, কী বিষয়, কিছুই জানি না। বলেন কী হচ্ছে।

... জোনাল একটা কমিটি ছিল। দেওয়ান ফরিদ গাজী সেটার চেয়ারম্যান। আর আমরা এমপিএ-এমএনএ যারাই যাই, তারা সদস্য। অনেকেই ছিল। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছিল। শিলংয়েই একটা মিটিং হলো। আলাপ-আলাচনা হলো।  সেখানে কথা হলো- একটা ইয়ুথ ক্যাম্প করতে হবে। আর একটা ইয়ুথ রিসিপশন ক্যাম্প করতে হবে। এই রিসিপশন ক্যাম্প করলাম মইলামে, এটা বালাটের অপর পাড়। এটা করার পর আবার অন্য উৎপাত শুরু হলো। বাঙালিরা যে এভাবে আসছে খাসিয়ারা সেটা সহজভাবে নিচ্ছে না। তারা মনে করছে আমরা বুঝি আর ফিরব না। এদিকে মুক্তিযোদ্ধা কিছু আসছে। তো প্রায় এক-দেড়শ ছেলে আসল। পরে তাদের ট্রেনিংয়ের জন্য ক্যাম্পে পাঠানো হলো। আমি ট্রাকে তুলে দিয়েছিলাম।

বালাট থেকে ১০ কিলোমিটার আপে একটা ক্যাম্প করা হলো। এর মধ্যে রাজ্জাক সাহেবের (প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাক) সঙ্গে আমার দেখা হলো। বিএলএফ নিয়ে আলাপ হলো।  দুটি ক্যাম্পের আমি চেয়ারম্যান ছিলাম। প্রথমে আমি নেত্রকোণা-সিলেট-হবিগঞ্জ এর সাব সেক্টরে ছিলাম। পরে এটারে ভাগ করে ময়মনসিংহ আর নেত্রকোণা একটা দিল। সুনামগঞ্জ-কিশোরগঞ্জ ছিল আরেকটা, এটার সাব-সেক্টর কমান্ডার ছিলাম আমি। বিএলএফ এর যারা ট্রেনিং নিত, আমার দায়িত্ব ছিল এদের ডাইরেক্ট ইনডাক্ট করা। আমর্স-অ্যামুনিশন যা আছে...। অন্য যারা মুক্তিযোদ্ধা ছিল তাদের আমি ট্রেইনিংয়ে পাঠাতাম, তাদের ইন্ডাকশনের দায়িত্ব আমার ছিল না। এটা সেক্টর কমান্ডাররা করত। আমাদের ছিলে ৫ নম্বর সেক্টর, দায়িত্বে মীর শওকত আলী।

আপনার ট্রেনিং...

আমার নিজের ট্রেনিং ছিল মাত্র দুই দিনের। আসামের গুয়াহাটির কাছে একটা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে গিয়ে দু্ই দিন শুধু পিস্তলে গুলি করা শিখাইছে। একমাস কোথাও গিয়ে ট্রেনিং করার অবস্থা আমার ছিল না। আই এম অরগানাইজার... না থাকলে শেষ হয়ে যাবে। আমার অস্ত্র ছিল .৩৮ বোরের একটা রিভলবার। যখন আমি বাংলাদেশের ভিতরে ইনডাক্ট করতাম, তখন ৫-৭ মাইল ভিতরে ঢুকেও করেছি।     

১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্ম-সমর্পণের সময় কোথায় ছিলেন, দেশে কবে ফিরলেন...

ইন্ডিয়া যখন রিকগনিশন দিল। তখন আমরা আশাবাদী হলাম, যে একটা এসপার-ওসপার হয়ে যাবে। বেশিদিন কন্টিনিউ করবে না। ১৬ ডিসেম্বর আত্ম-সমর্পণের খবর পেতে পেতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। ওয়্যার‌লেস ম্যাসেজ পেয়েছিলাম, বাট উই আর ইন কনফিউশান। সন্ধ্যায় খবর শোনার পর নিশ্চিত হলাম।

…অনেকে ফেরা শুর করেছ। কিন্তু আমার জন্য সমস্যা হলো- বালাটে ২-৩ লাখ শরণার্থী, মইলামে অন্তত ৭-৮ লাখ ছিল। সেখানে করুণ চিত্র ছিল। তাদের লুক-আফটার করতে হতো। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মইলামে শরণার্থী শিবিরে গিয়ে একটা জনসভা করলাম। বাট দে আর নট ইন্টারেস্টেড টু কাম ব্যাক বাংলাদেশ। ভাবছে কী হবে না হবে… শঙ্কিত ছিল। আশপাশের সব ক্যাম্পে গিয়েছি, তাদের বলেছি- আমি ফিরছি, তোমরাও চলো। আমার ওয়াইফও তখন অসুস্থ ছিল। আমার ফাদারও ওই যুদ্ধের মধ্যেই, নভেম্বরে দেশে ফিরছে। হি ওয়াজ টর্চার্ড বাই রাজাকারস। নভেম্বরেই বাড়িতে ফিরে মারা গেছে।  খোলা বোটে ঝড়-বৃষ্টিতে ভিজে ব্রংকোমোনিয়া হয়েছিল। সবাইকে দেশে পাঠিয়ে আমি ৮ তারিখ বা ৭ তারিখ... হ্যাঁ, ৭ তারিখ রওনা দিলাম। ১০ তারিখ এলাকায় পৌঁছালাম। বঙ্গবন্ধুও সেদিন দেশে ফিরেছিলেন।

দুটো বিষয়, পত্রিকায় যখন আজও কোনো মুক্তিযোদ্ধার মানবেতর জীবন-যাপনের খবর পান, আর ইতিহাস বিকৃতি- এ দুটো বিষয় আপনাকে কীভাবে নাড়া দেয়?

মুক্তিযোদ্ধার কথা যেটা বলছেন সেটার সংখ্যা খুব বেশি না। আছে একটা সংখ্যা। যারা নাকি খুবই মানবেতর জীবন-যাপন করছে। মুক্তিযোদ্ধাদের পাঁচ হাজার টাকা দিত, বর্তমান সরকার এখন আট হাজার করছে। খুব শিগগিরই এটা দশ হাজার করার পরিকল্পনা নিয়েছে। আর সুযোগ-সুবিধাতো দিচ্ছে। ছেলে-মেয়ে নাতিদের চাকরির একটা সুবিধা রাখছে। তবু আমি বলতে চাই, তাদের যে স্যাক্রিফাইস, তাদের পরিশ্রমেইতো দেশ স্বাধীন হয়েছে। তাদের প্রতি যতটুকু আরও সম্ভব, সরকারের সুদৃষ্টি রাখা উচিত বলে আমি মনে করি।

তরুণ প্রজন্মের কাছে আপনার প্রত্যাশা কী?

তাদের কাছে আমার প্রত্যাশা একটাই- স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস তারা জানুক। স্বাধীনতার ইতিহাসের বিকৃতি থেকে তারা মুক্ত হবে এবং তাদের মধ্যে আদর্শ-নীতি থাকতে হবে। ন্যায় থাকতে হবে। যারা ইতিহাস বিকৃতি করে, তাদের হাত থেকে মুক্ত থাকতে পারলে দেশের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল, নিঃসন্দেহে।

মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য স্বাধীনতা পদক পেয়েছেন। যখন জানতে পারলেন, কেমন লেগেছিল?

আসলে স্বীকৃতি একটা আনন্দের বিষয়।

(একটু নড়ে-চড়ে বসে ) একটা কথা বলতে পারি, শুরু থেকে রাজনীতি আর মুক্তিযুদ্ধের সময় একটা ঐকান্তিকতা, একাগ্রতা... যে কোনো মূল্যে দেশ স্বাধীন করতে হবে। এ ধরনের একটা প্রত্যয় ছিলে। শপথের মতো ছিল... করতেই হবে। বাঁচি-মরি, করতে হবে। না খেয়ে পথে ছিলাম, কিন্তু কোনো দিন মনের ভিতর দুর্বলতা আনি নাই। চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছাতেই হবে।

মহামান্য রাষ্ট্রপতি, সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।

আপনাদেরকেও ধন্যবাদ।