শিক্ষকতাই বড় প্রাপ্তি: অনুপম সেন

প্রায় অর্ধশতক শিক্ষকতায় নিয়োজিত সমাজবিজ্ঞানী অনুপম সেন জীবনের বাকি সময়টাও শিক্ষার আলো ছড়িয়ে যেতে চান।

মিন্টু চৌধুরী চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 August 2015, 01:44 PM
Updated : 5 August 2015, 05:05 PM

শিক্ষকতাকেই জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি মনে করেন খ্যাতিমান এই অধ্যাপক।

“আমি শিক্ষকই হতে চেয়েছি। প্রায় ৫০ বছরের শিক্ষকতাজীবনে ছাত্র-সহকর্মীদের কাছ থেকে যে ভালোবাসা পেয়েছি তার কোনো তুলনা নেই,” বলেছেন তিনি।

শিক্ষায় একুশে পদকজয়ী ড. অনুপম সেনের ৭৫তম জন্মদিন বুধবার।

এর দুদিন আগে চট্টগ্রাম নগরীর কাজীর দেউড়ির ভিআইপি টাওয়ারে নিজের বাসায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপচারিতায় জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের চাওয়া-পাওয়া এবং অনুভূতির নানা দিক তুলে ধরেন বরেণ্য এ শিক্ষাবিদ। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৩ সালে সমাজবিজ্ঞানে এমএ পাশ করার পরেই ১৯৬৫ সালে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বর্তমান বুয়েট)। পরের বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক এবং ১৯৬৯ সালের নভেম্বরে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন।

এ সময়ের মধ্যে তিনি বিভাগীয় প্রধান হওয়া ছাড়াও শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক, দুই দফা সভাপতি এবং সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।

২০০৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেওয়ার পরও পালন করছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন পরিচালিত প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব।

দীর্ঘদিনের শিক্ষকতা জীবনে অনেককে পড়িয়েছেন। দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উচ্চপদে প্রতিষ্ঠিত তার অনেক ছাত্র। 

এই শিক্ষক বলেন, “মানুষকে মানুষের মর্যাদা দেওয়ার মধ্যেই সার্বিক কল্যাণ নিহিত। শিক্ষকতা পেশার মধ্যেই তা সম্ভব।”

পঁচাত্তর বছরের জীবনের নানা পর্যায়ে চাওয়া-পাওয়ার অনেক হিসেব না মিললেও কোনো আফসোস নেই বলে জানান অধ্যাপক অনুপম সেন।

“দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে শিক্ষক-ছাত্র-সহকর্মী এবং বিভিন্ন সময়ে নানা মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি।  কোন কিছুর জন্য কখনও আমার আফসোস হয় না,” বলেন তিনি।

শিক্ষকতার বাইরে বই পড়া ও বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতেই বেশি পছন্দ  করেন অধ্যাপক অনুপম সেন।

“বইপড়ার মতো আনন্দ আমি আর কোথাও পাই না।”

শিক্ষকতা থেকে অবসর নেওয়ার পরেও পড়তে ও লিখতে চান বলে জানান তিনি।

“অনেক কিছু লেখা ও পড়ার বাকি আছে। সুতরাং লিখব বেশি, পড়ব কম,” বলেন তিনি।

তবে এখনকার তরুণরা লেখপড়া ‘কম’ করছেন বলে আফসোস প্রবীণ এই অধ্যাপকের।

“পরীক্ষার পড়ার বাইরে তারা অনলাইনের দিকে বেশি ঝুঁকছেন। এসবের পাশাপাশি তরুণদের বেশি বেশি পড়তে হবে,” বলেন তিনি।

একটি বঞ্চনাহীন, সুখী-সমৃদ্ধ দেশ গড়তে তরুণদের প্রতি দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান জানান অনুপম সেন।

১৯৪০ সালের ৫ অগাস্ট বন্দর নগরীর আইস ফ্যাক্টরি রোডে জন্ম নেওয়া অনুপম সেনের বাড়ি চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার ধলঘাট গ্রামে। বীরেন্দ্র লাল সেন ও স্নেহলতা সেনের ছেলে অনুপমের শিক্ষাজীবন শুরু হয় ধলঘাট ইংলিশ হাই স্কুলে (বর্তমান ধলঘাট হাই স্কুল)। এরপর তিনি কলকাতার সেন্ট ক্যাথিড্রাল মিশনারি স্কুলে পড়েন।

১৯৫৬ সালে চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল মডেল হাই স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করেন। ১৯৫৮ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে (সম্মান) ভর্তি হন।

সেখান থেকে ১৯৬৩ সালে এমএ পাশ করার দুই বছরের মাথায় শিক্ষকতায় যুক্ত হন।

১৯৭৩ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত তিনি কানাডার ম্যাকমাস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ও পিএইচডি করেন। তার গবেষণার বিষয় ছিল- ‘দি স্টেট ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন অ্যান্ড ক্লাস ফরমেশন ইন ইন্ডিয়া’।

তার এই গবেষণা প্রতিবেদনটি ১৯৮২ সালে বই আকারে প্রকাশিত হয়, যাতে উপমহাদেশে শিল্পায়নের প্রভাবে সমাজ কাঠামোর পরিবর্তনের চিত্র তুলে ধরা হয়। বিভিন্ন মহলে সমাদর পাওয়া এই বইটি ইউরোপ, আমেরিকা ও এশিয়ার অনেক দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে রেফারেন্স বই হিসেবে ব্যবহৃত হয়।   

২০১৪ সালে শিক্ষায় একুশে পদকজয়ী এ সমাজবিজ্ঞানীর এ পর্যন্ত ১৪টি বই প্রকাশিত হয়েছে। এগুলো হল- দি স্টেট ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন অ্যান্ড ক্লাস ফরমেশন ইন ইন্ডিয়া; পলিটিক্যাল এলিটস অব পাকিস্তান অ্যান্ড আদার সোসিওলজিক্যাল এসেস; বাংলাদেশ: রাষ্ট্র ও সমাজ (সামাজিক অর্থনীতির স্বরূপ); বাংলাদেশ ও বাঙালি রেনেসাঁস: স্বাধীনতা চিন্তা ও আত্ম অনুসন্ধান; বিলাসিত শব্দগুচ্ছ: প্রতীচী ও প্রাচ্যের কয়েকটি কালজয়ী কবিতার অনুবাদ; সমাজ, সংস্কৃতি, সাহিত্য: নানা কথার নানা ভাবনা নানা অর্ঘ্য; দি পলিটিক্যাল ইকোনমি অব বাংলাদেশ।

সোস্যাল ব্যাকগ্রাউন্ড অ্যান্ড সোস্যাল ক্যারেক্টার অব বাংলাদেশ ন্যাশনালিজম; আদিঅন্ত বাঙালি: বাঙালি সত্ত্বার ভূত ভবিষ্যৎ; কবি সমালোচক শশাংক মোহন সেন: বাংলা তুলনামূলক সমালোচনা সাহিত্যের নির্মাতা; সুন্দরের বিচার সভাতে (কবিতার বই); সাতটি বক্তৃতা (বিভিন্ন স্মারক বক্তৃতার সংলন); জীবনের পথে প্রান্তরে এবং বাংলাদেশ ভাবাদর্শগত ভিত্তি ও মুক্তির পথ।

অনুপম সেন শিক্ষকতার পাশাপাশি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ও বর্তমান বাংলাদেশকে, করেছেন গবেষণাও।

৭৫ বছরের জীবনে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে কোন আফসোস না থাকলেও স্বপ্নের সাম্যের বাংলাদেশ দেখতে না পারাটা হতাশার বলে জানান তিনি।

সমাজতন্ত্রের স্বাপ্নিক অধ্যাপক অনুপম সাম্যের বাংলাদেশ দেখে যেতে চান, যেখানে মানুষকে মানুষের মর্যাদা দেওয়া হবে এবং  মানবিক সত্ত্বায় উদ্ভাসিত হবে সমাজ।

আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর এই সদস্য মনে করেন যে স্বপ্ন নিয়ে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল সেই স্বপ্ন পূরণ থেকে এখনও অনেক দূরে বাংলাদেশ।

“বাংলাদেশে গত এক দশকে আয় বাড়লেও এই বৃদ্ধিতে কিছু সংখ্যক লোকের হাতে বিপুল পরিমাণ সম্পদ পুঞ্জিভূত হয়েছে। এখনও ২৪ শতাংশের মতো লোক দুবেলা ঠিকমতো খেতে পায় না।

“বঙ্গবন্ধু যে আদর্শ নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিলেন, সমাজতন্ত্রের আদর্শের কথা বলেছিলেন, সাম্যের বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন আমরা তার থেকে এখনও অনেক দূরে।”

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় অনুপম সেন ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে চট্টগ্রামে সব আন্দোলনেও সক্রিয় ছিলেন তিনি।

যুদ্ধের সময়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে অংশ নেন। স্বাধীন বাংলা বুদ্ধিজীবী সমিতিতেও সম্পৃক্ত ছিলেন।

স্বাধীনতার প্রায় সাড়ে চার দশকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি যুদ্ধাপরাধের বিচার বলে মনে করেন এই সমাজ বিজ্ঞানী।

“১৯৭১ থেকে এই সময়ে আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হল যুদ্ধাপরাধের বিচার। যে নিষ্ঠুর প্রক্রিয়ায় লাখ লাখ নিরীহ লোককে হত্যা করা হয়েছিল তার বিচার।”