আর্নেস্ট হেমিংওয়ে: জন্মবার্ষিকের স্মৃতিতর্পণ

মোস্তাক শরীফমোস্তাক শরীফ
Published : 21 July 2022, 06:18 AM
Updated : 21 July 2022, 06:18 AM


"মানুষ অনেক বেশি সাহস নিয়ে পৃথিবীতে এলে তাকে ভাঙতেই হয় পৃথিবীর। এজন্য মানুষটাকে খুন করে সে। পৃথিবী প্রত্যেককেই ভাঙে। ভাঙা জায়গায় শক্ত হয়ে যায় কেউ কেউ। যারা ভাঙে না, পৃথিবী তাদের খুন করে। খুব ভালো, খুব ভদ্র, খুব সাহসী- বাছবিছার না করে সবাইকেই খুন করে। খুন করবে তোমাকেও, তুমি এ তিনটির কিছু না হলেও। একবিন্দুও তাড়াহুড়ো করবে না।" (আ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস)

আর ঝড়ের স্বপ্ন দেখত না সে, মেয়েমানুষ, বড় কোনো ঘটনা, বড় মাছ, যুদ্ধ, প্রতিযোগিতা, শক্তি বা তার বউ-কিছুই না। কেবল নানা জায়গা আর সৈকতে ঘুরে বেড়ানো সিংহের স্বপ্ন দেখত। সন্ধ্যার অন্ধকারে বিড়ালশাবকের মতো খেলা করত তারা, ছেলেটাকে যেমন ভালোবাসে তেমন করে ভালোবাসত তাদেরও। (দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি)

ঊনিশ শতকের শেষ বছর। কাজী নজরুল ইসলাম ও জীবনানন্দ দাশ নামে দুই শিশুর জন্ম হলো বঙ্গভূমিতে, আর সেখান থেকে বহুদূরে মার্কিন মুল্লুকে জন্ম নিল আরেক শিশু। ডাক্তার বাবা আর সঙ্গীতজ্ঞ মা ছেলের নাম রাখলেন আর্নেস্ট মিলার হেমিংওয়ে। ভবিতব্য ঠিক করে রেখেছিল, দেশকালের গণ্ডি ছাড়িয়ে সাহিত্যের ইতিহাসে একদিন অমর হয়ে থাকবেন তিনজন। নজরুল-জীবনানন্দকে বাদ দিয়ে যেমন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচনা হতে পারে না, মার্কিন তথা ইংরেজি সাহিত্যের ভুবনে হেমিংওয়ের অধিষ্ঠানও তেমনই দৌর্দণ্ডপ্রতাপে। ১৮৯৯ সালের ২১ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় অঙ্গরাজ্যে, ওক পার্ক নামে ছোট্ট একটি শহরে জন্ম হেমিংওয়ের। ক্ল্যারেন্স আর গ্রেস হল হেমিংওয়ের ছয় সন্তানের মধ্যে জ্যেষ্ঠ। অল্প বয়সেই সাংবাদিকতা করতে গিয়ে হাতে তুলে নিয়েছিলেন কলম, কালক্রমে কেবল বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম সারথী হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত করেননি নিজেকে, তাঁর জীবন হয়ে উঠেছিল লোকগাঁথার অংশ। কী করেননি হেমিংওয়ে! যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে খবর সংগ্রহ করেছেন, আফ্রিকার জঙ্গলে বুনো প্রাণীর মুখোমুখি হয়েছেন, ইচ্ছেমতো মদ গিলেছেন, সম্পর্ক গড়েছেন ও ভেঙেছেন-আর কেবল লিখেছেন এবং লিখেই গেছেন। ঝঞ্জাক্ষুব্ধ, উত্থানপতনময়, অনিশ্চিত এক জীবন! অ্যানথ্রাক্স, ম্যালেরিয়া, নিউমোনিয়া, ত্বকের ক্যান্সার, হেপাটাইটিস, রক্তশূন্যতা, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, দু' দুটো বিমান দুর্ঘটনা, জখম হওয়া কিডনি, প্লীহা, যকৃত, মেরুদণ্ড আর খুলি নিয়ে বেঁচেছিলেন বাষট্টি বছর। ভর্তি হতে হয়েছিল মানসিক হাসপাতালে। সেখানে এমনভাবে বৈদ্যুতিক শক দেয়া হতো, নিজের নামও ভুলে যেতেন। ছত্রিশতম বৈদ্যুতিক শকটি গ্রহণের পরদিন, যখন 'মরিবার হলো তার সাধ', নির্বিকার চিত্তে শটগানের গুলিতে উড়িয়ে দিলেন নিজের খুলি। গল্পের চেয়েও বহুবর্ণিল আর কল্পনার চেয়েও অকল্পনীয় এমন চরিত্র বিশ্বসাহিত্যে খুব বেশি জন্ম নেয়নি, ভবিষ্যতেও নেবে বলে মনে হয় না।

রোমাঞ্চপ্রিয় হেমিংওয়ের রক্তে ছিল অভিযানের নেশা। বয়স যখন আঠারো, সৈনিক হিসেবে যোগ দিতে চেয়েছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে, কিন্তু দুর্বল দৃষ্টিশক্তির কারণে কাজ পেলেন অ্যাম্বুলেন্সচালক হিসেবে। যুদ্ধে দু'পায়ে মর্টার আর মেশিনগানের গুলি খান, বীরত্বের জন্য লাভ করেন পদক। ইতালির মিলানের এক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় প্রেমে পড়েন এক নার্সের, যে ঘটনা থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে লিখেন তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস 'আ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস'-এক অ্যাম্বুলেন্সচালক আর নার্সের প্রেমকাহিনী। স্পেনের গৃহযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-দুটোতেই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সংবাদ প্রেরণের কাজ করেন। হেমিংওয়ের মতো আর কোনো লেখকের যুদ্ধক্ষেত্রের এমন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই। যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তাঁর লেখালেখির পরিমাণও তাই প্রচুর। শিকার আর মাছ ধরা ছিল অন্যতম শখ। আফ্রিকায় প্রাণীশিকারে গিয়ে অনেক শ্বাসরুদ্ধকর, রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলেন। যে অনায়াস স্বাচ্ছন্দ্যে বন্দুক হাতে আফ্রিকার অরণ্যে সিংহ শিকার করেছেন, একই দক্ষতায় মারলিন আর টুনামাছের পেছন পেছন ঘুরে বেড়িয়েছেন আটলান্টিক মহাসাগরে। আরেক শখ ছিল মুষ্টিযুদ্ধ, ছোটবেলা থেকেই নিয়মিতভাবে চর্চা করতেন এ খেলা।

হেমিংওয়ের প্রথম উপন্যাস 'দ্য সান অলসো রাইজেস'-এর প্রকাশ ১৯২৬ সালে। ফ্রান্সের প্যারিস থেকে একদল ভবঘুরে মানুষের স্পেনের প্যামপ্লোনা শহরের ষাঁড়ের যুদ্ধ দেখতে যাওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে লেখা এই উপন্যাস। উপন্যাসটির আবেদন এমনই ছিল যে এটির সুবাদেই প্যামপ্লোনার এই ষাঁড়ের যুদ্ধ ছোট একটি আঞ্চলিক আয়োজন থেকে রূপ নেয় আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিসম্পন্ন বিশাল এক উৎসবে, যাতে লক্ষ লক্ষ মানুষ যোগ দিতে শুরু করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়টাতে লেখালেখিই হয়ে দাঁড়ায় হেমিংওয়ের মূল কাজ, যদিও একইসঙ্গে পশু ও মৎস্যশিকার, ষাঁড়ের যুদ্ধে অংশ নেয়া, মুষ্টিযুদ্ধসহ শখের যাবতীয় কাজও চালিয়ে যান পুরোদমে। সেই সঙ্গে চলে লাগামছাড়া মদ্যপান আর উদ্দাম জীবনযাপন। নারীসঙ্গের ব্যাপারেও ছিলেন বাছবিচারহীন। বিয়ে করেন চারবার, ছিলেন তিন পুত্রের জনক।


স্পেনের গৃহযুদ্ধে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা থেকে লেখা উপন্যাস 'ফর হুম দ্য বেল টোলস' (১৯৪০) ঔপন্যাসিক হিসেবে হেমিংওয়ের খ্যাতিকে প্রতিষ্ঠিত করে। যুদ্ধশেষে বাসস্থান হিসেবে বেছে নেন কিউবাকে, নিজেকে ডুবিয়ে রাখেন লেখালেখিতে। ১৯৫২ সালে প্রকাশিত উপন্যাস 'দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সী' হেমিংওয়ের জীবনের এক মাইলফলক। বিশাল এক মার্লিন মাছ ধরাকে কেন্দ্র করে নাছোড়বান্দা এক বুড়োর ক্লান্তিহীন প্রয়াসকে উপজীব্য করে লেখা ক্ষীণকলেবর এ উপন্যাস হেমিংওয়ের সাহিত্যিক খ্যাতির অন্যতম উৎস। এটির জন্য ১৯৫২ সালে পুলিৎজার ও ১৯৫৪ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন হেমিংওয়ে। তার আগে ১৯৫০ সালে প্রকাশিত হয় আরেক বহুল আলোচিত উপন্যাস 'অ্যাক্রস দ্য রিভার অ্যান্ড ইনটু দ্য ট্রিজ'। ১৯৬০ সালে কিউবা ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রের আইডাহো অঙ্গরাজ্যের কেচাম শহরে গড়েন আবাস। চেষ্টা করেন স্বাভাবিক জীবনযাপনের, কিন্তু নিজের বেয়াড়া, বোহেমিয়ান স্বভাবটাকে বাগ মানাতে পারেননি। একাধিকবার ভর্তি হতে হয় আরোগ্যসদনে। শেষবার আরোগ্যসদন থেকে বাড়ি ফেরার ঠিক দু'দিন পর আত্মহনন করেন শটগানের গুলিতে।

সব মিলিয়ে উপন্যাস ও উপন্যাসিকা লিখেছেন দশটি, লিখেছেন বেশ ক'টি নন-ফিকশন এবং বিপুলসংখ্যক ছোটগল্প। ছোটগল্পকার হিসেবে এমনই শক্তিমান ছিলেন, যদি একটিও উপন্যাস না লিখতেন, কেবল ছোটগল্পকার হিসেবেই সাহিত্যে নিজের স্থান অমর করে রাখতে পারতেন। জন মারিয়ানির কথায়, 'কেবল ছোটগল্পের ভিত্তিতেই যদি বলি, হেমিংওয়ে-যিনি নিজেকে বক্সিং ম্যাচের উপমা টেনে স্টেনডাল, তুর্গেনেভ আর তলস্তয়ের সঙ্গে তুলনা করতে ভালোবাসতেন, সম্ভবত সেরা মার্কিন বক্সার হিসেবে পয়েন্টের ব্যবধানে জয়ী হতেন। অন্যসব সেরা মার্কিন ছোটগল্পকারকে একটিমাত্র ছোটগল্পের নিরিখে স্মরণ করা হয়। ফিটজেরাল্ড স্মরিত হন 'ব্যাবিলন রিভিজিটেড'-এর জন্য, ফকনারকে মনে করায় 'দ্য বিয়ার', শার্লি জ্যাকসন 'দ্য লটারি', ফ্ল্যানারি ও'কনোর 'আ গুড ম্যান ইজ হার্ড টু ফাইন্ড', ট্রুম্যান কাপোটে 'ব্রেকফাস্ট অ্যাট টিফানি'জ'। কিন্তু হেমিংওয়ে সমানভাবে বিখ্যাত 'ইন্ডিয়ান ক্যাম্প', 'বিগ, টু হার্টেড রিভার', 'ইন অ্যানাদার কান্ট্রি', দ্য' কিলারস', 'আ ওয়ে ইউ'ল নেভার বি', 'আ ক্লিন ওয়েল লাইটেড প্লেস', 'দ্য শর্ট হ্যাপি লাইফ অব ফ্রান্সিস ম্যাকম্বার', এবং 'দ্য স্নোজ অব কিলিমাঞ্জারো'-র জন্য, যার সবগুলোই লেখা হয়েছিল মাত্র বারো বছর সময়কালের মধ্যে।'

১৯২০-এর দশকে লেখক হিসেবে যাত্রা শুরুর পর থেকেই লেখালেখির নিজস্ব একটি শৈলী দাঁড় করান হেমিংওয়ে। প্রথম জীবনে সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা এক্ষেত্রে কাজে লেগেছিল। বাগাড়ম্বরতা, অলঙ্কারবহুলতা, আবেগের প্রদর্শন এবং সবধরনের বাহুল্য ঝেঁটিয়ে বিদায় করে ভাষাকে করে তুলতেন ঋজু ও টানটান। নৈর্ব্যক্তিকতা আর সততা-এ দুটো গুণের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে ছোট ছোট, সহজ বাক্যে বর্ণনা করতেন গল্পকে। মূলত নির্ভর করতেন বিশেষ্য আর ক্রিয়ার ওপর, ছেঁটে ফেলে দিতেন সব বিশেষণ আর ক্রিয়া বিশেষণ। অল্পকথায়, আড়ম্বরহীনভাবে লেখার এ ঢংটি আজীবন ধরে রেখেছিলেন। এটিকে নিজের 'সিগনেচার স্টাইল' হিসেবে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন যে এ শৈলীই বিশ দশকের সাহিত্যিকরা সবচেয়ে বেশি অনুকরণ করেন। লেখক হিসেবে হেমিংওয়ে ছিলেন অসম্ভব পরিশ্রমী। সংশোধন ও পুনঃসংশোধনের মাধ্যমে লেখাকে কাঙ্ক্ষিত রূপে নিয়ে যেতে কঠিন পরিশ্রম করতেন। কথিত আছে, 'দ্য ওল্ড মান অ্যান্ড দ্য সি'-কে প্রকাশকের টেবিলে পাঠানোর আগে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে পাণ্ডুলিপিটি দুশোবারের মতো সংশোধন করেছিলেন। হেমিংওয়ের কাছে একবার জানতে চাওয়া হয়েছিল শিল্পের কাজ কী। নিজের অনণুকরনীয় ভঙ্গিতে উত্তর দিয়েছিলেন হেমিংওয়ে, 'এ পর্যন্ত যা ঘটেছে এবং যা ঘটছে, আপনি যা জানেন এবং যা জানার উপায় নেই-এ সবকিছু থেকে উদ্ভাবনীক্ষমতার জোরে যখন এমন কিছু তৈরি করেন যা কোনোকিছুর প্রতিনিধিত্ব করে না, যা সম্পূর্ণ নতুন এক জিনিস; সত্য ও জীবন্ত যেকোনো জিনিসের চেয়ে বেশি সত্য এবং আপনারই হাতে জীবন্ত; যদি ঠিকভাবে তৈরি করা যায়, তাকে দেয়া যায় অমরত্ব-এটাই হচ্ছে শিল্প।'

জীবৎকালে, এবং মৃত্যুর পরও হেমিংওয়ে যে খ্যাতি অর্জন করেছেন তার তুলনা বিশ্বাসাহিত্যে বিরল। তাঁর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ও রোমাঞ্চপ্রিয়তা লেখক হিসেবে তাঁর সৃজনপ্রতিভার মতোই বহুল আলোচিত, হেমিংওয়েকে যা পরিণত করেছে চিরকালের এক কিংবদন্তীতে। এ কারণে মৃত্যুর ছয় দশক পেরিয়েও হেমিংওয়ে সমান জনপ্রিয়। ২০১৭ সালে হেমিংওয়ের প্রকাশক 'স্ক্রিবনার' কেবল উত্তর আমেরিকা মহাদেশেই তাঁর বইয়ের সাড়ে তিন লক্ষ কপি বিক্রি করেছিল। এখনও প্রতি বছর নতুন নতুন জীবনী ছাপা হয় তাঁর। এ মুহূর্তে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস হেমিংওয়ের ছয় হাজার চিঠি ষোলটি খণ্ডে প্রকাশের কাজে ব্যস্ত আছে। রুশরা তাঁর নামে ছোট একটি গ্রহের নামকরণ করেছে। চশমা থেকে কলম পর্যন্ত অসংখ্য পণ্যের ব্র্যান্ড হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছেন হেমিংওয়ে। মানুষ ও লেখক হিসেবে এবং বিশ্বজোড়া লেখকদের অনুপ্রেরণা হিসেবে মৃত্যুর এত বছর পরও এ কারণেই অম্লান আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। ভবিষ্যতেও তাই থাকবেন।