আই হেট দ্য ইন্টারনেট

zakia_sultana
Published : 22 March 2016, 04:15 AM
Updated : 22 March 2016, 04:15 AM

আমেরিকান অ্যাকশন ফিল্ম "মাচেতে(২০১০)"-এ একটি দৃশ্য রয়েছে যেখানে, নায়ক ড্যানি ট্রেজো তার এক প্রতিপক্ষের পেট চিড়ে নাড়িভুঁড়ি বের করে ফেলে এবং সেটাকে দড়ি হিসেবে ব্যবহার করে উঁচু দালান থেকে লাফিয়ে পড়ে। অ্যাকশনধর্মী সিনেমাগুলোতে এ ধরনের দৃশ্যের অবতারণা নতুন বটে!

জ্যারেট কোবেকের নতুন উপন্যাস আই হেট দ্য ইন্টারনেট-এ লেখক তথাকথিত ইনফর্মেশন হাইওয়েতে আমেরিকান চেতনার অন্ত্রে ছুঁড়ি চালানোর মতোই কৌশল ব্যবহার করেছেন। তবে জনাব কোবেক এই উপন্যাসে উল্লাসে নাকি অবসাদে একাজ করেছেন তা ভেবেই পাঠক কিছুটা বিমুঢ় হয়ে যাবে।

তবে 'আমি অন্তর্জাল ঘৃণা করি' বা আই হেট দ্য ইন্টারনেট–এরকম দুর্বল শিরোনাম দেখে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। আপনার সেলফিগুলো আকর্ষণীয় না হয়ে কেবলই কেন গোমড়ামুখো হচ্ছে, তা মোটেই এই বইয়ের বিষয়বস্তু নয় বরং এটা একটা রগরগে রাজনৈতিক এবং সামাজিক বাগাড়ম্বরতা, নতুন বৈশ্বিক সময়ে নৈতিকতা এবং ক্ষমতার বিশুদ্ধ গলাবাজি যা পাঠকের তাজা মনে টগবগে ফুটন্ত আভাস হিসেবে দেখা দেয়।

জনাব কোবেক একটি পুরো জেনারেশনের ল্যাপটপ ও মুঠোফোনের আসক্তির বিষয়ে মন্তব্য করেছেন যে "কোন কিছুই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের পরিপূরক নয়"। তিনি এ বিষয়ে সুর মিলিয়েছেন এই বলে যে, "৫০০ মিলিওন ইলেক্ট্রনিক ভোক্তা ক্রীতদাস তৈরি হয়েছে এবং সে নরকে আপনাকে অভিবাদন"।
জনাব কোবেক একজন তুর্কী বংশোদ্ভূত আমেরিকান লেখক, বর্তমানে ক্যালিফোর্নিয়ায় বাস করেন। তার প্রথম উপন্যাসের নাম "আতা", যা ওয়ান ইলেভেন-এর সেই প্লেন হাইজ্যাকার পাইলট আতা'র উপন্যাসোচিত জীবনালেখ্য।
আপাতদৃষ্টিতে তাঁর এ নতুন উপন্যাস 'অ্যাডেলিন' নামক এক মধ্যবয়সী নারীর গল্প, যিনি একজন সুপরিচিত কমিক-রাইটার। লেখিকা ত্বরিত শিল্পায়নের প্রভাবে সৃষ্ট নগরায়ন(Gentrification) এবং টেকনোলজির অবাধ্য উল্লম্ফনে চিন্তিত এবং শোকাহত। এই শহরে তাঁর নিজেকেই আগন্তুক মনে হয়। মনে হয় তিনি যেন এখানে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছেন।
গল্পটা শুরু হয়েছে এভাবে যে, অ্যাডেলিন ২১ শতকের একমাত্র ক্ষমার অযোগ্য ভুল করেছেন- তা হলো একটি বক্তৃতানুষ্ঠানে তাঁকে ডাকা হয়েছে এবং তাঁর বক্তব্য কেউ রেকর্ড করায় তিনি সে অনুষ্ঠান বর্জন করেছেন।
অ্যাডেলিনের অবশ্য আরও কিছু সমস্যা রয়েছে-
(১) তিনি এমন একটি সংস্কৃতির অংশ যেখানে নারীদের ঘৃণা করা হয়।
(২) তিনি কিছুটা স্বনামধন্যও বটে এবং
(৩) তিনি অপ্রিয় মতামত প্রকাশ করেন/ স্পষ্টভাষী।

তাঁর কিছু কিছু মতবাদ ইউটিউবে বেশ বদনাম কুড়িয়েছে, যেমন- "কেন মেয়েদের টেক-কোম্পানিগুলোতে কাজের সময় অতিশয় সজাগ থাকা প্রয়োজন"? তিনি তাঁর আটলান্টিকের অপরপাড়ের বোকাবোকা উচ্চারণে যখন বলেন, "এসব হুজুগে তরুণীরা তাঁদের নিজেদের খুব কাছের শার্টওয়েস্ট(বিশেষ পোষাক) ফ্যাক্টরিতে পোড়ার জন্য একত্রিত হয়েছে এবং ভাবছে যে এসব আগুন জ্বালানো প্রযুক্তি তাঁদের ক্ষমতায়ন করছে" তখন মনে হয়, তা যেন সেই চল্লিশের দশকের বিখ্যাত নারীবাদী সাংবাদিক ডায়ানা ভ্রিলান্ডের মাদকতাপূর্ণ বাণী!
তাঁর কিছু কিছু মতবাদে বর্তমান সময়ের পপ স্টারদের গানে, ভিডিওতে এবং সামাজিক মাধ্যমগুলোতে খ্যাতি এবং ক্ষমতার প্রতি মোহ নিয়ে অসন্তুষ্টিও প্রকাশ পেয়েছিল। বিশাল একটা জনগোষ্ঠী মনে করে যে রিহান্না এবং বিয়োন্সে যতটা না লোভী তার চাইতে বেশি অনুপ্রেরণা। আমরা বইটি পড়ে জানতে পারি যে অ্যাডেলিন তাঁদের সেসব তথাকথিত দেবতাদের প্রতি থুথু নিক্ষেপ করেছে। অ্যাডেলিন টুইটার সম্পর্কেও খুব কমই জানে। রিরি এবং বে যখন তাঁকে এবিষয়ে আক্রমণ করেছিল তিনি তাঁর নীতিগত সিদ্ধান্তের প্রতি যুক্তি খুঁজেছিলেন।

অ্যাডেলিনের গল্পের পাশাপাশি অ্যালেন নামক আরেক তরুণীর গল্পও রয়েছে যে কি না পুরনো প্রেমিকের সাথে বিচ্ছেদের পর উক্ত প্রেমিক তাঁদের শারীরিক অন্তরঙ্গতার মুহূর্তের ভিডিওচিত্র ওয়েবসাইটে ছড়িয়ে দেয়, যা অ্যালেনের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে। জনাব কোবেক প্রতিটা নারী চরিত্রই খুব আন্তরিকতার সাথে কৌতূহলোদ্দীপক করে তুলে ধরেছেন। কিন্তু "আই হেট ইন্টারনেট" বইটি মূলত সামাজিক সমালোচনার একটা প্লাটফর্ম।

কোবেকের এই রচনাটি কিছুটা ফরাসী লেখক মাইকেল হউলবেক(Michel Houellebecq)'র লেখার মতো অস্পৃশ্য বিদ্রুপাত্মক । আবার এতে থমাস পিকেটির (Thomas Piketty) অর্থনৈতিক বৈষম্যের আবেশ রয়েছে। এমনকি অ্যাম্ব্রোস বিয়ার্সের The Devil's Dictionaryর মতো শব্দকে ধারণায় পর্যবসিত করে এদের বিরূপ ব্যবহারের মাধ্যমে যথাযথ অর্থ কাজে লাগিয়েছেন।
নতুন সংজ্ঞা? কমিক্সে এখন পর্যন্ত সূক্ষ্ম পর্নোগ্রাফির চর্চা হয়ে থাকে, কমিক্স সম্মেলনগুলো সাধারণ লোকজনদের বড় বড় কর্পোরেশনসমূহ তাঁদের মেধাস্বত্বের মতো সাজপোষাক করার একটা ছুতো তৈরি করে দেয়। মানুষকে মাপার জন্য অর্থই একমাত্র অপমানজনক পরিমাপক। আর মানুষ একটি টাকার জন্য কি না করে!

লেখক আরও জানান, আমাজন একটি অলাভজনক ওয়েবসাইট যারা প্রকাশনা শিল্পকে ধ্বংস করার জন্য নিয়োজিত। আর ইন্সটাগ্রাম হলো প্রথম সামাজিক মাধ্যমের প্লাটফর্ম যেখানে মানুষের সুবিবেচনাসমূহকে প্রতিনিয়ত সচেতনভাবে ঘৃণা করা হয়। এটা হলো জর্জ ডব্লিউ বুশের সেই চিত্রকর্মটির মতো- যা আত্মঘাতী গুপ্তচরের মতো কারোর ছিন্নমনের উপরে নজরদারি করছে।

এটা কিছুটা আজব এবং অবশ্যই বিনোদনমূলক উপন্যাস। সময়ের পরিসরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দু'টি প্রশ্ন তুলে ধরেছেন লেখক:
– মানুষ কেন ফেসবুক আর টুইটারের এতোটাই আত্মমগ্ন হয়েছে যে কখন তাদের ব্যক্তিসত্তাকে সাদা চামড়ার মানুষের কাছে বিকিয়ে দিয়েছে তা সে টেরই পায়নি?
-এবং মানুষ কি মনে করছে যে, ১৪০ শব্দের নৈতিকতার বাণী তাঁদের সমাজকে অনেক এগিয়ে নিচ্ছে?
তিনি লিখেছেন, ২১ শতকের অন্যতম কৌতূহলী দৃষ্টিভঙ্গিতে অনেক লোকের জন্যই এ এক মহান বিভ্রম, বিশেষ করে সানফ্রান্সিকোর উপকূলীয় অঞ্চলে প্রযুক্তির প্লাটফর্মে বাক-স্বাধীনতা এবং মতবাদ-স্বাধীনতার সর্বশ্রেষ্ঠ চর্চিত মাধ্যম। এভাবে কর্পোরেশনের মালিক হয়ে অর্থ উপার্জন করাও সম্ভব।

তিনি আরও বলেছেন, টুইটারের মাধ্যমে প্রকাশিত মতবাদের অধিকাংশই অতিরঞ্জিত ভন্ডামি, নিতান্তই অর্থহীন। যদি টুইটার এবং বর্ণবাদিতাকে পাশাপাশি রাখা হয় তবে কোনটি বেশি ভয়ংকররূপে পরিগণিত হবে? লেখক বলেছেন, "বর্ণবাদের বিরুদ্ধে উদ্বেগ প্রকাশ করাটা নতুন এক ধরনের ধর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। লেখক আরও জানিয়েছেন যে রাজনৈতিকভাবে কার্যকর পরিবর্তন না করে শুধুমাত্র ভাষার উপরে জোড় প্রয়োগ করাটা অর্থহীন, যদি না কেউ প্রথম সারির নীতিনির্ধারকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে না পারে।

সকল বিপদগ্রস্ত অনুযোগের মতো আই হেট ইন্টারনেট সমস্যার সমাধানের চেয়ে বরং প্রশ্নই করেছে বেশি। পাঠকের মনে হতে পারে কোন নারী অথবা আফ্রো-আমেরিকান তাঁদের নারীবাদ ও বর্ণবাদের এসব তিক্ত পর্যবেক্ষণ উল্লেখ করে গেছেন।

লেখক বলেছেন, পুরো বিশ্বই এক হারিয়ে যাওয়া পান্ডুলিপির নাম যেখানে লোকজন শুধুমাত্র তাদের প্রাপ্ত পৃষ্ঠাই পড়ছে এবং পড়ে শেষ করার আগেই সেই লাইনগুলো হারিয়ে যাচ্ছে।
আর আমার উপদেশ এই যে একদিনের জন্য কম্পিউটার থেকে লগ অফ করে বইটি নিয়ে বসুন।

(দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত ডিউইট গার্নারের নিবন্ধ অবলম্বনে)

আর্টস বিভাগে প্রকাশিত জাকিয়া সুলতানার আরও লেখা: