লোকনাট্য-গান সংগ্রহ ও উৎসব-নৃত্য প্রত্যক্ষণ প্রণমহি বঙ্গমাতার ফিল্ডওয়ার্ক পদ্ধতি

saymon_zakaria
Published : 14 April 2008, 04:00 AM
Updated : 14 April 2008, 04:00 AM

আজ থেকে প্রায় দশ বছর আগে প্রথম আলো সাহিত্য সাময়িকীর পাতায় কবি সাজ্জাদ শরিফ


……
প্রণমহি বঙ্গমাতা (চতুর্থ পর্ব) ।। মাওলা ব্রাদার্স ।। ফেব্রুয়ারি ২০০৮ ।। পৃষ্ঠা ১৬০ ।। ২০০ টাকা ।। প্রচ্ছদ: কাইয়ুম চৌধুরী ।।
……
ও ব্রাত্য রাইসুর প্রশ্রয়ে একটি নিয়মিত কিন্তু অনিয়মিত কলাম হিসেবে প্রণমহি বঙ্গমাতা লিখতে শুরু করি। তারও প্রায় পাঁচ বছর আগে থেকে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী নাট্যধারার স্বরূপ অনুসন্ধানে গ্রামে গ্রামে ঘুরছিলাম। এই ঘুরাঘুরির মধ্যে বিশেষত এদেশের বহুবিধ উৎসব-নৃত্য, লোকনাট্য-গান প্রত্যক্ষণ এবং সে সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্যসংগ্রহের ভেতর দিয়ে নিজস্ব একটি ফিল্ডওয়ার্ক পদ্ধতি অনুসরণ করতে থাকি। উল্লেখ্য, নিজস্ব সেই পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে বিগত পাঁচ বছরের মধ্যে পত্রিকার কলামের পাশাপাশি প্রণমহি বঙ্গমাতার চারটি খণ্ড গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এখানে পাঠকদের জন্য প্রণমহি বঙ্গমাতার ফিল্ডওয়ার্ক পদ্ধতিটি ব্যক্ত করছি।

●●●


"বুদ্ধি আছে কিন্তু সাধনা নেই, এইটেই আমাদের দেশে সাধারণতঃ দেখতে পাই,
অধিকাংশ স্থলেই আমরা কম শিক্ষায় বেশী মার্কা পাবার অভিলাষী।"

–'হরপ্রসাদ শাস্ত্রী', রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হরপ্রসাদ-সংবর্দ্ধন-লেখমালা (দ্বিতীয় খণ্ড),
শ্রীনরেন্দ্রনাথ লাহা ও শ্রীসুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় (সম্পাদিত), কলিকাতা : বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষদ, ১৩৩৯

আজ থেকে প্রায় পৌনে একশত বছর আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বলা কথাটা বাংলাদেশের ফোকলোর চর্চার ক্ষেত্রে খুব বেশি করে খাটে। ব্যক্তিগতভাবে


সিলেটের ধারাবহরে অজামিলচন্দ্রনাথ ও সুকৃতি দেবনাথের বিয়েতে ধামাইল গান ও নাচ শেষে শিল্পীদের কাছে নিয়ম-কানুন বুঝে নিচ্ছেন লেখক। ছবি: মাহবুবুর রহমান, ২১/১০/৭

প্রায় চৌদ্দ বছর ধরে নিতান্ত প্রেমের টানে ফোকলোর বিষয়ক ফিল্ডওয়ার্কে নেমে উপলব্ধি করেছি–আসলেই এ দেশে ফোকলোর চর্চায় ফিল্ডওয়ার্ক- কর্মীদের মাঝে নিষ্ঠা ও সাধনার যোগ খুব কম। রবীন্দ্রনাথের কথার সূত্র ধরে বলতে চাই–কম শিক্ষায়, কম পরিশ্রমে, কম নিষ্ঠায়, বেশি আয়াসে যেমন সাধনায় সিদ্ধি সম্ভব নয়, তেমনি বুদ্ধির সঙ্গে সাধনার ঐক্য স্থাপন ছাড়া ফোকলোর বিষয়ক ফিল্ডওয়ার্কের কোনো সার্থকতা থাকে না। এক্ষেত্রে মনে রাখা প্রয়োজন ফোকলোর চর্চায় ফিল্ডওয়ার্কের যে সাধনার কথা বলছি, তা কিন্তু কোনো যোগাচারী বা তান্ত্রিকের সাধনা নয়, ফোকলোর চর্চায় ফিল্ডওয়ার্কের সাধনা হবে জনমানুষের সঙ্গে জনমানুষ হয়ে ওঠার সাধনা, তারপর জনমানুষের ভেতর থেকে তাদের চর্চিত জীবনের চিন্তা, ভাবনা, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাকার সার্বিক বিষয়ের ইতিহাস অন্বেষণ।

প্রসঙ্গক্রমে নিজের লেখা একটি কবিতার কথা মনে পড়ছে। কবিতার নাম 'পানি চেনা'। তাতে লেখা আছে–

মনে আছে সাঁই
তুমিই তো বলেছিলে–
কূলে বসে পানি চিনবে? নাকি নামবে গাঙে?
–পানি যদি চিনতেই হয় গাঙে নামাই ভালো।
আমি তাই জলে দিয়ে মাথা
পানি চেনার গুপ্ত কথা সারে ব্যক্ত করি॥

কিশোর বয়সে সাধুদের গান শুনে মুগ্ধ হতাম। মুগ্ধতার ভেতর থেকে গানের মর্মার্থ বোঝার জন্য চেষ্টা করতাম। একদিন সাধক-কণ্ঠশিল্পী মতিয়ার সাঁই সে আগ্রহ দেখে বললেন, 'তুই কি কূলে ব'সে পানি চিনবি? নাকি গাঙে নামবি?'

মতিয়ার সাঁইজির এই প্রশ্নে কিছুক্ষণের জন্য খেই হারিয়ে ফেলি। তিনি আবার বললেন, 'বল, কূলে ব'সে পানি চিনবি? নাকি গাঙে নামবি?'

সাহস ভরে উত্তর করি, 'পানি যদি চিনতেই হয় গাঙে নামা-ই ভালো।'

এরপর শুরু হলো পানি চেনার জন্য গাঙে অর্থাৎ নদীতে নামার পর্ব। এই ভাব-কথাকে ভেঙে বললে দাঁড়ায়–গাঙ বা নদীতে নামা মানে ফিল্ডওয়ার্ক বা মাঠসমীক্ষণে যাওয়া আর 'পানি চেনা' মানে জনমানুষের প্রাণকে যথাযথভাবে অন্বেষণ করা। বর্তমান অধ্যায়ে আত্মবিবরণের ভঙ্গিতে সেই নদীতে নামা ফিল্ডওয়ার্ক এবং ফিল্ডওয়ার্কে গিয়ে কেমন করে প্রণমহি বঙ্গমাতার তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করি বা কোনো এলাকার জনমানুষের সঙ্গে মিশে যাই সে কথাগুলোই বলবো।

যেভাবে অসাম্প্রদায়িক হয়ে উঠেছি
এক্ষেত্রে নিজের প্রতি নিজের একটা প্রশ্ন আছে, প্রশ্নটা হচ্ছে, কেমন করে ফিল্ডওয়ার্কে যাবার জন্য অসাম্প্রদায়িক হয়ে উঠেছিলাম? এ প্রশ্নের উত্তর অন্বেষণের জন্য নিজের বালকবেলার দিকেই ফিরে তাকাই। দেখতে পাই, একেবারে বালকবেলা থেকে নানা-নানীর বাড়িতে মনসার গান, দাদা-দাদীর বাড়িতে গাজীর গান এবং নিজস্ব গ্রাম বসন্তপুরের মাঠে লাঠিখেলার বিস্তর আয়োজন দেখে কিশোর বয়স পেরিয়ে গেলো। লক্ষ করার বিষয়, এই বেড়ে ওঠার সঙ্গে ধর্মাধর্মের কোনো বেড়াজাল ছিল না। লৌকিক হিন্দুদেবীর আখ্যান মনসা গান ও লৌকিক মুসলমানপীর আখ্যান গাজীর গানের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব কোনোদিন দেখিনি। অপরদিকে ধর্মনিরপেক্ষ লাঠিখেলার আয়োজনও সমানভাবে মুগ্ধ করেছিল। সে সময়ে একই বিশ্বাসে, ভক্তিতে, প্রেমে মসজিদে, দরগাতলায়, মনসামূর্তির সামনে, কিংবা শীতলাদেবী ও বসন্তঠাকুরের পূজায় যেতে হয়েছিল। কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ অঞ্চলের উদার সামাজিক ও পারিবারিক পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠতে উঠতে কোনো হিন্দু দেব-দেবী ও মুসলমান পীর মাহাত্ম্যের মাঝে কখনোই কোনো দ্বন্দ্ব তৈরি করতে দেখিনি। আজ স্পষ্টভাবে বুঝতে পারি, ফোকলোরই ছোটবেলা থেকে সত্তার ভেতর অসাম্প্রদায়িক চেতনার বীজ রোপন করে দিয়েছিল। আর সে বীজের বৃক্ষকে বুকে ধারণ করে ছুটে চলেছি বাংলার পথে পথে। আসলে, কোনো প্রকার সাম্প্রদায়িক চেতনায় আচ্ছন্ন হয়ে বা কোনো সুনির্দিষ্ট ধর্মীয় বিশ্বাসের অনুসারী হয়ে ফোকলোর চর্চায় ফিল্ডওয়ার্ক করলে জনমানুষের প্রাণস্পন্দনের প্রকৃত ছন্দটার অপলাপ ঘটতে পারে।

জনমানুষ সম্পর্কে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা
বাংলাদেশের সব অঞ্চলের গ্রামীণ মানুষের প্রাণের স্পন্দনের সঙ্গে তিনটি বিষয়কে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে দেখেছি, তা হচ্ছে–ভক্তি, বিশ্বাস, প্রেম। এক্ষেত্রে এদেশের ফোকলোর চর্চার ফিল্ডওয়ার্কে নেমে ব্যক্তিগতভাবে এই তিনটি বিষয় ভক্তি, বিশ্বাস ও প্রেমকে হৃদয়ে ধারণ করেই গ্রামীণ মানুষের কাছাকাছি যেতে চাই। কেননা, জনমানুষের তথ্যানুসন্ধান করবো–তাদের সঙ্গে একাত্ম হবার এটাই সহজ পথ। তারা যে বিশ্বাসের অনুসারী ফিল্ডওয়ার্কে গিয়ে নিজের শিক্ষা-দীক্ষা এমনকি ব্যক্তিগত সামাজিক অবস্থানের সব কিছু ভুলে সেই বিশ্বাসের অনুসারীদের মতো হয়ে উঠি এবং তাদের সব লোকাচারের প্রতি তাদেরই মতো ভক্তি ও প্রেম প্রকাশ করি। এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে ফিল্ডওয়ার্কের প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে আনি। তবে, একথাও ঠিক যে, ফিল্ডওয়ার্কে নেমে উপর্যুক্ত ভক্তি, বিশ্বাস ও প্রেম বিষয় তিনটির সঙ্গে যুক্তি এবং বুদ্ধিকে যোগ করতে সচেষ্ট থাকি। আর এভাবেই ফিল্ডওয়ার্কের বৈজ্ঞানিক ও আধুনিক ব্যাখ্যার সূত্র তৈরি করে রাখি।

ফিল্ডওয়ার্কের নিজস্ব পদ্ধতি
ফোকলোর চর্চায় ফিল্ডওয়ার্ক করতে নেমে গ্রামের মানুষের মতো প্রধানত দুইটি হিসেব খুব ভালোভাবে মাথায় রাখতে হয়–এক. চাঁদের হিসাব, দুই. বাংলা মাসের হিসাব। অবশ্য, কখনো কখনো ইংরেজি মাসের হিসেবও মনে রাখতে হয়। খুব মনে পড়ে, উচ্চশিক্ষার্থে যখন কুষ্টিয়া ছেড়ে ঢাকায় চলে আসি, তখন চাঁদের হিসেব মেনে প্রায় প্রতিটি পূর্ণিমাতে কুষ্টিয়াতে চলে যেতাম, লালন সাঁইজির আখড়াতে বসে সাধুদের মুখে গান শুনবো বলে। এই গায়ক সাধুরাই অপূর্ব এক দীক্ষা দিয়েছিল–চাঁদের গঠন সংক্রান্ত। এক চাঁদ আকাশে ওঠে আরেক চাঁদ ওঠে দেহের ভেতর। বিজ্ঞানের বই পড়ে সাধুদের কথার প্রতিধ্বনি দেখে পরে বিস্মিত হয়েছি বহুবার। সে আরেক গল্প, আজ সে কথা নয়। তারচেয়ে ফিল্ডওয়ার্কের জন্য মাস গণনার যে কথা বলছিলাম সে কথাতে ফিরে আসি।

বাংলাদেশের প্রায় সকল প্রকার লোক-উৎসব, লোকসংস্কার, লোকবিশ্বাস, লোকপূজা, লোকাচার ইত্যাদির সঙ্গে চন্দ্রমাস ও বাংলা মাসের যোগ আছে। প্রায় এক যুগেরও অধিক সময় ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তাতে চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলে দিতে পারি কখন কোন চাঁদে কোথায় কী হচ্ছে, কারা করছে। একই কথা বাংলা মাসের হিসেব ধরেও বলে দিতে পারি। তারপরও ফিল্ডওয়ার্কে যাবার পূর্বে স্থানীয় পর্যায়ে একজন রিসোর্স পারসনের সাহায্য নিয়ে থাকি। এক্ষেত্রে কেমন করে রিসোর্স পারসনের সাহায্য নিয়ে থাকি সে বিষয়ে কিছু বলার প্রয়োজন বোধ করি।

আসলে, ব্যক্তিগতভাবে কবিতা লেখার সূত্রে, লিটল ম্যাগাজিন করার সূত্রে, থিয়েটার করার সূত্রে এবং সম্প্রতি দৈনিক পত্রিকায় নিয়মিত লেখার সূত্রে সারাদেশের অধিকাংশ এলাকার বিভিন্ন গ্রামে ও শহরে অনেক সুহৃদ ও বন্ধু তৈরি হয়েছে। কোনো এলাকায় যাবার পূর্বে আগে তাদের সঙ্গে ফোনে বা চিঠিতে যোগাযোগ করে নিই। তারাই প্রাথমিকভাবে তাদের স্থানীয় জনমানুষের সুনির্দিষ্ট কোনো লোকজীবন চর্চা নিয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য সম্পর্কে নিশ্চিত করে। সঠিক দিন-তারিখ-সময়-ক্ষণ বা তিথি তারা প্রাথমিকভাবে স্থানীয় জনমানুষের সঙ্গে আলাপ করে জানালে সুনির্দিষ্ট সময়ের আগেই সেখানে পৌঁছে যাই এবং খুবই স্বাভাবিকভাবে তাদের জীবনাচারকে প্রত্যক্ষ করি।

এছাড়া, প্রয়োজন মতো বিশ্বস্ত এক বা একাধিক তথ্যদাতার সঙ্গে আলাপ করি। এ ধরনের আলাপের ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় বিশেষভাবে খাতা কলমে নোট করি, টেপ-রেকর্ডারে ধারণ করি এবং ক্যামেরায় ছবি তুলে রাখি। যেমন, তথ্যদাতার নাম, ধাম, বয়স, পেশা, সংসার, সন্তানাদির পরিচয় এবং তাদের জীবনাচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত পোশাক-আশাক, আবাসন, ভাষারীতি ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর সঙ্গে ভক্তি, বিশ্বাস, প্রেম বা ধর্মীয় রীতি-নীতি, মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির মধ্যে ঐতিহ্যবাহী গীতি-বাদ্য, নাট্যধারা ও নৃত্যধারার অবস্থান সম্পর্কে তথ্য নিয়ে থাকি। পরে এই তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি নিয়ে আরো কিছু বলবো। এখন বলবো, ফিল্ডওয়ার্কের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ এবং সময় কোথায় পাই?

অর্থের চেয়ে ইচ্ছেশক্তি বড়
সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্ম হয়নি আমার। জন্ম থেকে দেখেছি কীভাবে একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের মা-বাবা গভীর সংযমের ভেতর দিয়ে সন্তানকে বড় করে তোলেন, বাবা-মাকে দেখেছি অনেকটা মাকড়সার মায়ের মতো, যে তারা নিজের বুকের পাজর দান করে এই সন্তানকে বড় করে তুলেছেন। সে মায়ের সন্তান হয়ে বুকের পাজর নিয়ে ছুটে গিয়েছি ফোকলোর চর্চার ফিল্ডওয়ার্কে। এক্ষেত্রে ফিল্ডওয়ার্কের জন্য আজ পর্যন্ত কারো কাছ থেকে কোনো অর্থ বরাদ্দ নিইনি। যা কিছু করেছি নিজের অন্য খাত থেকে উপার্জিত টাকাতে। খুব মনে পড়ে, ঢাকাতে স্নাতক প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়ে প্রুফরিডার হিসেবে একটি খণ্ডকালীন চাকুরী নিয়েছিলাম। প্রতিদিন বিকাল পাঁচটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত অফিস করতে হতো। সে চাকুরীর প্রথম মাসের বেতনের টাকা দিয়ে একটি টেপ-রেকর্ডার কিনেছিলাম। সেই টেপ-রেকর্ডারটিই ছিল ফিল্ডওয়ার্ক জীবনের প্রথম অবলম্বন। এরপর কেবল যাওয়া-আসার অর্থ বা বাসভাড়াটা পকেটে করে ছুটে গিয়েছি ঢাকা থেকে বাগেরহাট-পিরোজপুর, রাজশাহী-নাটোর, নওগাঁ-জয়পুরহাট, রংপুর-দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম- লালমনিরহাট, সিলেট-শ্রীমঙ্গল, হবিগঞ্জ-সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা-ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ-ব্রাহ্মণবাড়িয়া আরো কত জেলার কত না গ্রামে। না, এক্ষেত্রে ফিল্ডওয়ার্ক করতে তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। বরং বাংলাদেশের মানুষের অন্তরাত্মার ভেতর প্রেমের অমিয়ধারা দেখে শিহরিত হয়েছি। খাবার টাকা ছিল না বলে কোথাও না খেয়ে থাকতে হয়নি, কোথাও গাছতলায় ঘুমাতে হয়নি। আজও ব্যক্তিগত কোনো ক্যামেরা নেই। কিন্তু ছবি তো ঠিকই তুলতে পেরেছি। আজও ধার করা ক্যামেরাতেই ছবি তুলে যাচ্ছি। এই ফিল্ডওয়ার্ক জীবনের প্রায় পনের বছর কেটে গেল। সে ফিল্ডওয়ার্ক জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা প্রায় নয় বছর ধরে প্রণমহি বঙ্গমাতা নামে সারাদেশের মানুষের সামনে নিয়মিত উপস্থাপনও করেছি।


সিলেটের ধারাবহর গ্রামে অজামিলচন্দ্রনাথ ও সুকৃতি দেবনাথের বিয়েতে ধামাইল নাচ-গান চলছে

এখন প্রশ্ন হতে পারে অর্থ ছাড়া কেমন করে এই ফিল্ডওয়ার্ক করলাম? উত্তরে জানাই, ওই যে বলছিলাম চন্দ্র ও বাংলা মাসের হিসেবের কথা, ওটাই অর্থ ছাড়া ফিল্ডওয়ার্ক করার মর্মকথা। কারো কারো মনে প্রশ্ন আসতে পারে–মানে? উত্তরটা এবার ভেঙে বলি, চন্দ্র ও বাংলা মাসের হিসেব অনুযায়ী যে উৎসব, পূজা ও নাচ-গানের অনুষ্ঠান বা নাটকের অভিনয় অনুষ্ঠান হয়, তা নিশ্চিতভাবেই জনমানুষের নিয়মিত আয়োজনের অংশ, আর তাতে একজন ফিল্ডওয়ার্ক-কর্মী যোগ দিলে ওই আয়োজনের জন্য আয়োজক কর্তৃপক্ষকে ফিল্ডওয়ার্ক-কর্মীর পক্ষ থেকে কোনো আয়োজন বরাদ্দ দিতে হয় না। বরং সুনির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মূল আয়োজনের স্বতঃস্ফূর্ত ও মূল রূপটা বিনা খরচে দেখে আসা যায়। ফিল্ডওয়ার্কে এই কৌশলটি বিশেষভাবে মেনে চলি। এতে একই সঙ্গে যাওয়া-আসা ও ক্যামেরা-টেপরেকর্ডারের খরচ ছাড়া অতিরিক্ত কোনো খরচের প্রয়োজন হয় না। আর এই কৌশলের ভেতর দিয়ে সুনির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশও প্রত্যক্ষ করতে পারি।

নিষ্ঠার যোগসূত্র
ফিল্ডওয়ার্কের জন্য যে নিষ্ঠা এবং সাধনার কথা বলছি, এ পর্যায়ে তা কেমন করে অর্জন করি সে বিষয়ে কিছু কথা বলা যাক। অনেকেই হয়তো জানেন না, কোনো একটি জনগোষ্ঠীর সুনির্দিষ্ট কোনো সংস্কৃতি বা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে ফিল্ডওয়ার্ক করলে তা একবারে গিয়ে করি না। একাধিকবার গিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা নিয়ে তারপর তা লিখে প্রকাশ করি। উল্লেখ করতে পারি, মণিপুরী রাসের কথা।

গত প্রায় দশ বছর ধরে মণিপুরী সম্প্রদায়ের রাসের আয়োজনে যাই। প্রথম বছর বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের রাস দেখতে গিয়ে অন্তর ও চোখ-মুগ্ধতার মধ্যে দিশা হারিয়ে ফেলে। দ্বিতীয় বছর একই বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী সম্প্রদায়ের পুরো রাসের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রাধা-কৃষ্ণ লীলার আখ্যান আবিষ্কার করি। তৃতীয় বছর আখ্যানের পুরো বিষয়টি খাতা কলমে নোট করি। চতুর্থ বছর একজন বয়োজ্যেষ্ঠ মণিপুরীর সঙ্গে রাসের আসরে বসে আগের বছরের নোটগুলো নতুন করে পরীক্ষা করে নিই এবং একই সঙ্গে রাসে পরিবেশিত সমস্ত গানের সুর ও বাণীকে টেপ-রেকর্ডারে গ্রহণ করি। উল্লেখ্য, আগের বছরগুলোতেও গানের সুর-বাণী যথাযথভাবে টেপ-রেকর্ডারে ধারণ করেছিলাম। কিন্তু এবারে পাঠটি তার থেকে আরো ভালোভাবে টেপ-রেকর্ডারে ধারণ করি এবং সে পাঠটির শ্রুতি লিখন করে মূল মণিপুরী রাসধারীদের দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে নিই। সেই সাথে রাসের তাৎপর্য এবং তার উৎপত্তি ইতিহাসের তথ্যানুন্ধান করি। তারপরও শেষ হয় না মণিপুরী রাসের ফিল্ডওয়ার্ক। কেননা, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ছাড়াও আরো একটি মণিপুরী সম্প্রদায় রাসের আয়োজন করে থাকে, তা তখনও প্রত্যক্ষ করা হয়নি।

পরের বছরগুলোতে সেই অসম্পূর্ণ দিকটার দিকে নজর দিতে মৈতৈই মণিপুরীদের রাসে যোগ দেই। সে আরেক অভিজ্ঞতা। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, যদি বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের রাস দেখেই মণিপুরী রাসের বিবরণ সীমাবদ্ধ রাখতাম, তাহলে মহা ভুলের উপর ফিল্ডওয়ার্ক প্রতিবেদনটা দাঁড়িয়ে থাকতো। কেউ কেউ প্রথম আলোর সাহিত্য সাময়িকীতে প্রকাশিত প্রণমহি বঙ্গমাতা কলামটি পড়ে বলতে পারেন, লেখার শরীরে কেন কোনো বিশ্লেষণ থাকে না বা করি না? এক্ষেত্রে প্রণমহি বঙ্গমাতার বৃহত্তর পাঠকের জন্য উত্তর হচ্ছে, এর মাঝে সে লেখাগুলোর উপর বিশ্লেষণধর্মী প্রবন্ধ কিছু একাডেমিক জার্নালে প্রকাশিত হতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের জার্নাল থিয়েটার স্ট্যাডিজ-এ একটি গবেষণা প্রবন্ধ "মধ্যযুগের নাটগীত শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ও মণিপুরী বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের নটপালা : একটি তুলনামূলক আলোচনা" প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া, শিল্পকলা একাডেমী ও বাংলা একাডেমী পত্রিকায় আরও কয়েকটি বিশ্লেষণধর্মী প্রবন্ধ প্রকাশিত হচ্ছে, যার প্রধান আশ্রয় ছিল প্রণমহি বঙ্গমাতার লেখাগুলো।

এবারে প্রাসঙ্গিকভাবে ফিল্ডওয়ার্কে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে রচিত 'বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী রাস' রচনা থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি—

"রস থেকেই রাস কথাটির উৎপত্তি। আর রসাস্বাদনের জন্য যে ক্রীড়া বা লীলা তা-ই রাসলীলা। এই রাসলীলা সর্বপ্রথম প্রবর্তন করেন স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। সেটি দ্বাপর যুগের ঘটনা এবং তার সংঘটন স্থান ছিল শ্রীব্রজধাম। কিন্তু বর্তমান যুগের ভারত ও বঙ্গে যে রাসলীলা কেন্দ্রিক রাস উৎসব হয়ে আসছে–তার প্রচারক হচ্ছেন প্রখ্যাত মণিপুরী রাজা ভাগ্যচন্দ্র। মণিপুরীদের মাঝে লোক-কথা আছে যে কয়েক শতাব্দী পূর্বে এই মণিপুরী রাজা ভাগ্যচন্দ্রই স্বপ্নাদৃষ্ট হয়ে ভারতের মণিপুরীদের মাঝে নতুনভাবে রাসলীলার প্রচলন শুরু করেন। তৎপরবর্তীতে মণিপুর যুদ্ধের কারণে স্বভূমি থেকে মণিপুরীরা উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েন ঠিকই কিন্তু স্বভূমির ধর্ম-সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক পরিচয় থেকে তারা কখনোই নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন রাখেননি। উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থান নিয়ে মণিপুরীরা তাদের বংশপরম্পরায় বিভিন্ন ধর্ম-সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে প্রতিবছর রাসপূর্ণিমার তিথিতে তাদের রাস উৎসব অব্যহত রেখেছেন। উল্লেখ্য, মণিপুরী প্রবীণেরা এই উৎসবকে রাসলীলা বলতেই অধিক পছন্দ করেন।

অষ্টাদশ শতকের প্রথম পাদে বাংলাদেশের সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ জেলায় বসতি স্থাপনকারী মণিপুরীরা আজ থেকে প্রায় দেড় শতাধিক বছর পূর্বে ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে প্রথম এই দেশে তাদের ধর্ম-সংস্কৃতির প্রধান উৎসব রাসলীলার সূচনা করেন। সেই থেকে দু'একটি ব্যতিক্রম ভিন্ন মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জের আদমপুর-মাধবপুরের মণিপুরীরা প্রায় প্রতিবছর নিয়মিতভাবে রাস উৎসব করে আসছেন।

মণিপুরীদের রাসলীলার উৎসবের পোশাক-পরিচ্ছদে, নৃত্যে-গীতে এবং মঞ্চ-অলঙ্করণে যে রাজকীয় গাম্ভীর্য দৃষ্ট হয় তা আমাদের দেশের অন্য কোনো সাংস্কৃতিক পরিবেশনার কোথাও দেখা যায় না। এ দেশের শিকড় পর্যায়ের অন্যান্য সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে অনিবার্যভাবেই যেক্ষেত্রে কেবলমাত্র সাধারণের সংস্কৃতি বলে মনে হয়, রাসলীলার উৎসব মণিপুরী জন-সাধারণের একান্ত ধর্মীয় সংস্কৃতি হলেও তাকে রাজদরবারের পরিবেশনা বলেই ভ্রম হয়। আসলে, রাসলীলার প্রচারণ ইতিহাস বা লোক-কথাতেই এমন ভ্রমের উত্তর পাওয়া যাবে। কেননা, লোক-কথায় বলা হয়েছে, আধুনিক কালে রাস প্রচলন করেন মণিপুরী রাজা ভাগ্যচন্দ্র আর রাজা ভাগ্যচন্দ্র নিজেও নাকি রাসের পোশাক পরে নেচেছিলেন। অতএব, রাসের জন্ম হয়েছে রাজদরবারে। কিন্তু তাকে গ্রহণ করে নিয়েছেন সাধারণ মণিপুরী জনগণ। ধর্ম-সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এমন ঘটনা খুব কমই ঘটেছে যে, রাজদরবারের বস্তু সাধারণে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করে নিয়েছে। কিন্তু মণিপুরীদের রাসলীলার ক্ষেত্রে এমনটি ঘটেছে। রাসলীলা এখন আর কোনো রাষ্ট্রপ্রধানের সংস্কৃতি হয়ে নেই, তা হয়ে আছে সাধারণের সংস্কৃতি। মণিপুরী রাসলীলা আজ সাধারণের কৃত্য হলেও এর পোশাক-আশাক ও গীতি-নৃত্য দৃষ্টে মনে হতে থাকে যে রাজদরবার থেকে উদ্ভূত রাসের প্রাচীন গাম্ভীর্য এখনও বোধ হয় ঠিক ঠিক মণিপুরী রাসে অক্ষুণ্ন রয়ে গেছে।

পর পর বেশ কয়েক বছর ধরে বেশ কয়েকবার কমলগঞ্জের মাধবপুর গ্রামের জোড়মণ্ডপের রাস উৎসবের মুগ্ধ আর বিস্মিত একজন দর্শক মাত্র। বিস্ময় আর মুগ্ধতার ভিতর যে আনন্দ আছে তার পুরোটা মণিপুরীদের রাস উৎসব থেকে প্রথমবার ধারণ করা খুব শক্ত হয়েছিল। বারবার তাই পাশাপাশি অবস্থান নেওয়া তিন তিনটি মণ্ডপের একটি থেকে আরেকটিতে ছুটে গিয়েছি। তখন মণিপুরী পল্লীর তেমন কারো সাথে পরিচয়ও ছিল না, এক শুভাশিস সিনহা আর তাদের পরিবারের সদস্য এবং কয়েকজন প্রতিবেশী ভিন্ন। পরবর্তীতে অনেকের সাথে ভাব জমে ওঠে, শুভাশিসদের বাড়ি হয়ে ওঠে নিজের আপন বাড়ি। আর মণিপুরীদের গ্রামগুলো যেন হয়ে যায় নিজের গ্রাম। সেই থেকে রাসের আসল রসাস্বাদন একটুখানি সহজ হয়ে দেখা দেয়। বুঝতে পারি রাসলীলা আসলে মানুষের প্রতীকে পরম পুরুষের সঙ্গে প্রকৃতির চিরন্তন লীলা। অন্যদিকে রাসের নাটকীয় গুণসমূহও চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আর এটা ঘটে পর পর তিন বছর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে রাসলীলা পর্যবেক্ষণ করার পর। আজ দুইটি পর্বে রাসলীলার সেই নাট্যগুণের দিকেই দৃষ্টিপাত করবো। একটি পর্বে থাকছে–'রাখালনৃত্য : সত্য আমি গোষ্ঠে যাবো', অন্য পর্বে থাকছে–'রাসলীলা : রাস মানে রসময় ধারা'।"

এই দীর্ঘ উদ্ধৃতির ভেতর দিয়ে পাঠক নিশ্চিতভাবেই আবিষ্কার করতে পারবেন–ফিল্ডওয়ার্ক থেকে প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে একটি সুনির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে কেমন করে ইতিহাস, বিশ্বাস এবং উক্ত বিষয় চর্চা নিয়ে প্রচলিত লোকবিশ্বাস ও তাঁর বর্তমান রূপরেখা সম্পর্কে নিজস্ব ব্যক্তবকে প্রকাশ করে থাকি।

উদ্ধৃতির প্রথম ও দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে পাঠক প্রথমেই লক্ষ করবেন, মূল রাস উদ্যাপনের মর্ম-কথা এবং মণিপুরীদের মধ্যে আদি রাসের অনুকরণে নতুন করে প্রবর্তন সম্পর্কিত লোক-কথা, একই সঙ্গে ভারতদের মণিপুরী প্রদেশ থেকে মণিপুরীদের অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে পড়ার কথা এবং বাংলাদেশে তাঁদের আগমন প্রসঙ্গ ও রাস প্রবর্তন সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক তথ্য।

উদ্ধৃতির তৃতীয় অনুচ্ছেদে আছে রাসের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্পর্কে ব্যক্তিগত মূল্যায়ন, যেখানে বলেছি– রাসের পোশাক-পরিচ্ছদে, নৃত্যে-গীতে এবং মঞ্চ-অলঙ্করণে যে রাজকীয় গাম্ভীর্য লক্ষ করা যায় তা থেকে অনুমান করা অসঙ্গত নয় যে, রাস রাজদরবার থেকে উদ্ভূত হয়ে সাধারণের সংস্কৃতিতে রূপ লাভ করেছে। আর চতুর্থ অনুচ্ছেদে আছে–রাস বিষয়ক ফিল্ডওয়ার্ক পদ্ধতি সম্পর্কে কিছু কথা। উল্লেখ্য, ফিল্ডওয়ার্ক থেকে প্রাপ্ত সকল তথ্যকে ব্যক্তিগতভাবে লাইব্রেরিতে প্রাপ্ত ইতিহাস গ্রন্থের সাহায্যে পরীক্ষা করে নিয়েছি।
ফিল্ডওয়ার্কে প্রাপ্ত তথ্যকে লাইব্রেরিতে প্রাপ্ত গ্রন্থের মাধ্যমে যাচাই করে নেবার কোনো সুযোগ থাকলে প্রায় সর্বক্ষেত্রে সে সুযোগ গ্রহণ করি। তবে, কোনো কোনো বিষয়ে ফিল্ডওয়ার্ক প্রাপ্ত তথ্যকে লাইব্রেরিতে প্রাপ্ত গ্রন্থের সাহায্যে পরীক্ষা করে দেখার সুযোগ না থাকলে, বিষয়টি নিয়ে একাধিক রিসোর্স পারসনের সাথে আলাপ করতে হয়। তারপর নিজস্ব যুক্তি ও বুদ্ধির উপর ভর করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি।

আসলে, বারবার মণিপুরী জনগোষ্ঠীর মানুষের ভেতর গিয়ে একটি সুনির্দিষ্ট অনুষ্ঠানকে বিভিন্নভাবে দেখার চেষ্টাকে একই সঙ্গে ফিল্ডওয়ার্কের নিষ্ঠা ও সাধনা বলতে চাই। এই নিষ্ঠা ও সাধনার ভেতর দিয়ে আরো দেখেছি, পাশাপাশি গ্রামে একই আখ্যানের গানের সুর, কথা, এমনকি পরিবেশনারীতি কেমন করে বদলে যায়, আবার একই আখ্যানও সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে কেমন করে বদলে যায়। প্রণমহি বঙ্গমাতার ফিল্ডওয়ার্কের অর্জনের মধ্যে এই দু'টি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে এক মনসার আখ্যানেরই প্রায় পনেরো প্রকারের পরিবেশনারীতি দেখেছি। কোথাও এর পালা করে বিধবা নারীরা–তার নাম হয় বিষহরির গান, কোথাও করে সধবা নারীরা–তার নাম হয় রয়ানী, কোথাও করে হিজড়ারা–তার নাম হয় গুরমী মনসার গান, কোথাও করে মুসলমান হাজাম ও ধর্মসূত্রে মুসলমান বিচিত্র পেশার মানুষেরা–তার নাম হয় পদ্মার নাচন, কোথাও করে হিন্দু-মুসলমান সম্মিলিতভাবে–তার নাম হয় পদ্মাপুরাণ গান, কোথাও করে শুধুই হিন্দু জনগোষ্ঠী–তার নাম হয় কান্দনী বিষহরির গান, কোথাও করে কৃষিজীবী মুসলমান মানুষেরা–তার নাম হয় বেহুলাবালি, ভাসানযাত্রা, কোথাও বিচিত্র পেশাজীবী নিম্নবর্গের হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষেরা–তার নাম হয় মনসামঙ্গলের ঢপযাত্রা ইত্যাদি আরও কতো কী। উল্লেখ্য, মনসার আখ্যানকেন্দ্রিক এই বিচিত্র পরিবেশনারীতির ফিল্ডওয়ার্ক গত দশ বছর ধরে করছি, তবু তা শেষ হচ্ছে না, এখনও অনুসন্ধানে আছি না-জানি জানার বাইরে মনসার আখ্যানকেন্দ্রিক আরো কত পরিবেশনা রয়ে গেছে। একই চিত্র লোকায়ত মুসলমানদের গাজীপীর, মানিকপীর ও মাদারপীরের গানের ক্ষেত্রেও প্রত্যক্ষ করেছি। মুসলমানদের পীর-কাহিনীর পরিবেশনার মধ্যে সবচেয়ে বৈচিত্র্য দেখেছি গাজীর গান, গাজীর গীত, গাজীর পালা, গাজীর যাত্রা'র মধ্যে, পরিবেশনারীতির নামের সঙ্গে এ সকল পরিবেশনারীতিতে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। নিশ্চয় গাজীপীরের আখ্যান পরিবেশনার আরও বহু রূপ এখন প্রত্যক্ষ করতে পারি নি। তাই এদেশে প্রচলিত গাজীর গান পরিবেশনার সকল রূপ প্রত্যক্ষ করার বাসনা হয়। জানি না তার শেষ কোথায়? কিন্তু আসলে কি ফোকলোর বিষয়ক ফিল্ডওয়ার্কের শেষ আছে? মনে হয় শেষ নেই।

ফিল্ডওয়ার্ক ছাড়া লেখি না কিছু
না দেখে কখনো কোনো কিছু লেখি না। কিন্তু ফিল্ডওয়ার্কের নামে না-দেখে শুধু শুনে শুনে অনেক কিছু ফোকলোর বিষয়ক গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হতে দেখি, এমনকি ফিল্ডওয়ার্ক না-করে বা সামান্য দু'একটি ফিল্ডওয়ার্ক করে ফোকলোর বিষয়ক সুবৃহৎ পিএইচ.ডি গবেষণা-অভিসন্দর্ভ রচনার দৃষ্টান্ত এদেশে বহু আছে। এ প্রসঙ্গে অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়, সে দিকে না যেয়ে শুধু একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। বহুদিন ধরে বাংলাদেশের কয়েকটি আদিবাসীগোষ্ঠীর কারামপূজা নিয়ে ফিল্ডওয়ার্ক করছিলাম। ফিল্ডওয়ার্কে প্রাপ্ত তথ্যগুলো পরীক্ষা করে দেখার জন্য এবং একই সঙ্গে পূর্ববর্তী গবেষকদের ফিল্ডওয়ার্কের তুলনামূলক পাঠ নির্মাণের লক্ষে লাইব্রেরিতে কারাম বিষয়ক গবেষণাগ্রন্থের অনুসন্ধান করি, হাতে পাই শ্রীসুধীরকুমার করণ রচিত ফোকলোর বিষয়ক ফিল্ডওয়ার্কধর্মী গবেষণাগ্রন্থ সীমান্তবাঙ্লার লোকযান। জানতে পারলাম, গ্রন্থটি বাংলার ফোকলোর ফিল্ডওয়ার্ক ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য দলিল হিসেবে স্বীকৃত। গ্রন্থটির সূচি, নির্ঘণ্ট এবং পৃষ্ঠা উল্টিয়ে কারামের বর্ণনা আছে দেখে প্রথমত খুশি হয়ে উঠলাম, কিন্তু গ্রন্থে লিপিবদ্ধ কারামের বর্ণনা পড়তে গিয়ে ভীষণ হতাশ হলাম।


শ্রীমঙ্গলের ভুড়ভুড়িয়া চা-বাগানের দেশোয়ালীরা করমাপূজা শেষে ছরাতে করমা-ডালকে বিসর্জন দিচ্ছেন

কেননা, বর্ণনা পড়ে বুঝলাম লেখক জনাব সুধীরকুমার করণ না-দেখেই কারামের বর্ণনা লিখেছেন, কারামের মতো একটি প্রাণবন্ত লোকউৎসবের বিবরণ না-দেখে লেখার কোনো যৌক্তিকতা আছে বলে জানা নেই। এই গ্রন্থ পড়ার আগেই অন্তত তিনবার বাংলাদেশের তিনটি অঞ্চলে একাধিক আদিবাসী গোষ্ঠীর মাঝে কারামপূজা দেখেছি। তারপর আরও একটি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কারাম বা করমপূজা দেখতে গিয়ে জানতে পারি, আরও প্রায় সাত-আটটি আদিবাসী জনগোষ্ঠী বিভিন্ন সময়ে এই কারামপূজা করে থাকে। এই তথ্য আবিষ্কার করে আনন্দিত হয়ে উঠি। আসলে, ফিল্ডওয়ার্কের প্রতি নিষ্ঠাবান থাকলে কোনো ধরনের ডিগ্রি বা স্বীকৃতির মোহ ছাড়া এভাবেই তথাকথিত শিক্ষিতদের না-দেখে লেখা ইতিহাসকে বারবার প্রত্যক্ষ করে অপার আনন্দ খুঁজে পাওয়া সম্ভব। নিজেকে সেই আনন্দের অভিযাত্রী ভাবি। খুব ইচ্ছে আছে, সকল আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কারামপূজা প্রত্যক্ষ করার পর একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ রচনা করবো।

অপরাপর যে সকল বিষয়ে নজর রাখি
ফিল্ডওয়ার্ক মানে জনসমষ্টির সামগ্রিক রূপের অনুসন্ধান। এই রূপের অনুসন্ধানের জন্য স্বভাবগত ভাবে মানুষের চিন্তাধারা, ব্যবহারপ্রণালী, পরিবেশ-পরিস্থিতির উপর প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি বিষয়ে জনমানসের বাস্তব চিত্রটি তুলে ধরতে চাই।

প্রণমহি বঙ্গমাতার বিবরণধর্মী রচনাকে নৃ-বিজ্ঞানের শিক্ষক বন্ধুগণ অ্যানথ্রো-রিপোর্টিং বলে অভিহিত করেন। তাদের অনেকে মনে করেন ফিল্ডওয়ার্ক কর্মী হিসেবে রিপোর্টটি ব্যাখ্যার ভার না-নিলেও ক্ষতি নেই। আসলে বিশ্লেষণের দায়িত্ব নেওয়া উচিত তাত্ত্বিকদের। তাদের সঙ্গে কোথাও কোথাও একমত পোষণ করি। তবে, একথাও বলে রাখি ফিল্ডওয়ার্ক অভিজ্ঞতা প্রকাশের আশ্রয় হচ্ছে একটি দৈনিক পত্রিকা। এক্ষেত্রে ফিল্ডওয়ার্ক অভিজ্ঞতার ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণের ভেতর গেলে তার যে বিস্তার ঘটে তা দৈনিকে ছাপা সম্ভব নয়, আবার জনমানসের বাস্তব চিত্র উপস্থাপনের জন্য তা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে বলে ধারণা।

সে যা-ই হোক, নৃ-বিজ্ঞানের প্রধান দুই শাখা ভৌত ও সাংস্কৃতিক (Anthropologe =Physical+Cultural) বিষয়টা কিন্তু সকল সময় প্রণমহি বঙ্গমাতার ফিল্ডওয়ার্কে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে উঠে আসে বলেই ধারণা করি।

এর পর আসে ইতিহাস অন্বেষণ প্রসঙ্গ। সব সময় একটা কথা বলি দেহ আর প্রাণরস ছাড়া পোশাকের মর্যাদা আমাদের ফোকলোর চর্চায় সবচেয়ে বেশি। কারণ, ইতিহাস অনুসন্ধানের পথ ছাড়া প্রাণরস বা প্রাণবস্তুর জ্ঞান অর্জন করা যেমন সম্ভব নয়, তেমনি দেহের রূপ গঠন সম্পর্কেও ধারণা নেওয়া বা দেওয়া সম্ভব নয়। বলা হয়ে থাকে, History is the mother of all knowledge। এ কথার মর্ম জানি। তাই প্রণমহি বঙ্গমাতার ফোকলোর ফিল্ডওয়ার্কে কয়েক পুরুষের এবং গুরুপরম্পরার একটা ইতিহাস এবং সেই সঙ্গে পরবর্তী প্রজন্মের সঙ্গে তার সংশ্লেষ বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্যের সমাবেশ থাকে।

ফিল্ডওয়ার্কে গেলে প্রাকৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ের দিকে বিশেষ লক্ষ রাখি। কেননা, প্রাকৃতিক বিষয়টির সঙ্গে যেমন কোনো অঞ্চলের অর্থনীতি নির্ভরশীল, তেমনি অর্থনৈতিক বিষয়টির সঙ্গে রাজনৈতিক বিষয়টির যোগ থাকে। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে লক্ষ করে দেখেছি, প্রাকৃতিকভাবে যারা উত্তরবঙ্গের তিস্তাপাড়ের বসবাসকারী, তারা অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া এবং রাজনৈতিকভাবেও পিছিয়ে পড়া মানুষ। কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ করে দেখেছি, ওই পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোর সাংস্কৃতিক চর্চাগুলো অত্যন্ত বর্ণিল। যেমন, কুশানগান, কান্দনী বিষহরির গান–এটা দেখা অভিজ্ঞতা। এর বাইরেও হয়তো ভিন্ন চিত্র আছে। যা আরো গভীরভাবে মিশে বের করতে হবে।

ফিল্ডওয়ার্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ভাষাতত্ত্ব (Linguistic)। প্রতিটি ফোকলোর ফিল্ডওয়ার্কে এই বিষয়টির প্রতি বিশেষভাবে নজর রাখি। এক্ষেত্রে তিনধরনের ব্যক্তির সাহায্য নিয়ে থাকি, যথা, মাতৃস্থানীয় কোনো নারী বা অল্প-বয়সী ছেলে-মেয়ে বা সুনির্দিষ্ট বিষয়টি সম্পর্কে অভিজ্ঞ কোনো ব্যক্তি। মাতৃস্থানীয় ব্যক্তি সহজেই তাঁর নিজের সন্তান-স্থানীয় ভেবে তাঁর নিজের ভাষার গাঁথুনিগুলো ভেঙে বোঝাতে পারেন। আর অল্প-বয়সী ছেলে-মেয়ে অধিক বিশ্বস্ততার সাথে তাঁর নিজের মাতৃভাষার মূলরূপটি কোনো ধরনের বিকৃতি ছাড়াই বুঝিয়ে দিতে সচেষ্ট থাকে। অন্যদিকে সুনির্দিষ্ট বিষয়টি সম্পর্কে অভিজ্ঞ ব্যক্তি তাঁর পার্শ্ববর্তী অন্যান্য সংস্কৃতির সাথে তুলনামূলক ব্যাখ্যায় তাঁর নিজের ভাষার স্বাতন্ত্র ও বৈশিষ্ট্যগুলো ধরিয়ে দিতে সক্ষম হন। আসলে এই তিন ধরনের ব্যক্তির সাহায্য নিয়ে যথাযথভাবে ভাষাতত্ত্বের পাঠ গ্রহণ করতে সচেষ্ট থাকি। শুধু তা-ই নয়, তাঁদের সহায়তায় টেপ-রেকর্ডারে ধারণকৃত ফিল্ডওয়ার্কে প্রাপ্ত ভাষা-নিদর্শনের শ্রুতি লিখন করার পর আবারও সুনির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর সুনির্দিষ্ট তথ্যদাতাদের দিয়ে তা পরীক্ষা করিয়ে নিয়ে থাকি।

সকল কিছুর মূলে সমাজবিদ্যা (Sociology)। সেই সমাজবিদ্যার পাঠ তো সমাজের একজন মানুষ হিসেবে বহু আগেই ঘটেছিল। আগেই বলেছি, জনমানুষের ভেতর মিশে গিয়ে জনমানুষের প্রাণের স্পন্দনকে একজন ফোকলোর ফিল্ডওয়ার্ক-কর্মী হিসেবে অন্বেষণ করতে সচেষ্ট। আর এই ব্যাপারটি কতটা গভীরভাবে এবং বিশ্বস্ততার সাথে করতে পারি, তার জন্য সবশেষে একটি ঘটনার বিবরণ দিতে চাই। ঘটনাটা এই রকম যে, কোনো জনগোষ্ঠীর ভেতর ফিল্ডওয়ার্ক করে যখন ফিরে আসতে উদ্যত হই তখন প্রায়ই পেছন থেকে একটা ডাক শুনতে পাই–'দাদা'।

পিছন ফিরে তাকাই।

লোকটা বলেন–'আপনার কাছে একটা প্রশ্ন।'

'কী প্রশ্ন বলেন?'

'আপনি আসলে কোন ধর্মের লোক?'

হেসে উত্তর করি–'আমি তোমাদেরই লোক।'