মনে পড়ে, গত বিশ্বকাপের ফাইনালে ফ্রান্সের যে দু'জন ফুটবলার টাইব্রেকারে পেনাল্টি 'মিস' করেছিলেন তাঁদের গায়ের কালো রঙ নিয়ে 'কটাক্ষ' করেছিলেন কিছু মানুষ
Published : 25 Mar 2024, 09:53 PM
দুই বোন--একজন খুব ফর্সা, আর অন্যজন কালো। 'ফর্সা'র প্রতি বাড়ির সকলের আদর আর আহ্লাদ অন্তহীন, সমস্ত আলোর কেন্দ্রে সে। আর 'কালো'টি নিদারুণ অনাদর, অবহেলা ও উপেক্ষায় যেন একটি বিষাদপ্রতিমা। একা একা থাকে, পুতুল নিয়ে একা একাই খেলা করে ইত্যাদি। তারপর পুতুলখেলার বয়স শেষ হলে বাড়ি থেকে শিগগির 'আপদ' দূর করার দুরন্ত ব্যগ্রতায় 'কালো'র বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়! অপরদিকে 'ফর্সা'টি শিক্ষায়-দীক্ষায় সমস্ত কিছুতে একেবারে 'আধুনিক সভ্যতার উপযোগী' হয়ে ওঠে। অবশেষে অকালমাতৃত্বের 'ভারে' অবনত জীবনের অন্তিম মুহূর্তটি যখন ঘনিয়ে আসে তখন 'কালো' হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে 'ফর্সা' বোনকে অনুরোধ করে যায় যে, সে যেন নবজাতিকাটিকে 'তার মতো করে' বড় করে তোলে!
অনেকদিন আগে পড়া একটি গল্প। কিন্তু, এ তো শুধু গল্প নয়; নির্মম বাস্তবের প্রতিচ্ছবি। 'কালো' মেয়েদের 'জীবনযন্ত্রণা'র অবসান আদৌ আর কোনও দিন হবে কি না সন্দেহ! প্রশ্ন হ'ল, যে 'ফর্সা' আমাদের কাছে এতটাই আকর্ষণীয়, তাকে 'রূপ' বলার ভ্রমে আচ্ছন্নতা কি যুক্তিসঙ্গত? 'রূপ' শব্দটি তো ব্যাপক অর্থবোধক। তার ব্যঞ্জনা বহুমাত্রিক। পুরুষেরও 'রূপ' থাকতে পারে। নারী 'রূপসী' হলে পুরুষও হতে পারে 'রূপময়'। 'রূপ' বস্তুটাই আলাদা। 'কালো' যেমন একটি রঙ, 'ফর্সা'ও তো নিছকই একটি রঙ মাত্র। দিনের শেষে তাহলে কি আমরা আসলে 'রঙের পূজারী', রূপের নয়? ঠিক তাই। তাহলে তো নিজেদের 'আত্মপ্রতারিত' বলা ছাড়া আর উপায় থাকে না!
মনে পড়ে, গত বিশ্বকাপের ফাইনালে ফ্রান্সের যে দু'জন ফুটবলার টাইব্রেকারে পেনাল্টি 'মিস' করেছিলেন তাঁদের গায়ের কালো রঙ নিয়ে 'কটাক্ষ' করেছিলেন কিছু মানুষ; যদিও রাষ্ট্রীয়ভাবে সেই দুই ফুটবলারের পাশেই ছিল ফ্রান্স। কিন্তু, প্রশ্ন হচ্ছে, মানুষের মনের 'অন্ধকার' দূর হবে কবে? যে 'কালো রং' নিয়ে বহু মানুষের এত 'সমস্যা' তারা যদি জানত যে, তাদের মনে পুঞ্জীভূত 'অন্ধকার'-এর রঙটিও 'কালো' তাহলে বোধহয় ওই ধিক্কারযোগ্য 'কটাক্ষটা' তারা করত না! ওইসব মানুষকে একথা বোঝানো নিতান্ত অর্থহীন যে, কী অসম্ভব, অপরিমেয় মনস্তাত্ত্বিক চাপ মাথায় নিয়ে একজন ফুটবলারকে পেনাল্টি শট মারতে হয়!
বসন্ত রঙের ঋতু। প্রসঙ্গত বলা যাক, 'রাঙিয়ে দিয়ে যাও'--রবীন্দ্রনাথের এই অনবদ্য গানটি যদি মনোযোগ দিয়ে শোনা যায় তাহলে বোঝা যাবে যে, 'বসন্ত'-কে নিয়ে তাঁর ভাবনা কত গভীর ছিল ! বসন্তের হৃদয়ের সঙ্গে কবি নিজের গহন অন্তরাত্মাকে মেশাতে চেয়েছিলেন কীভাবে এবং কেন, যা গোটা বিশ্বমানবেরই হৃদয়ের অন্তর্গত, এমনতর একটি 'দর্শন' এই গানে ফুটে উঠেছে! না, কবির কাছে 'বসন্ত' কেবলই একটি রঙের ঋতু হিসেবে নয়; বরং 'রঙ' ছিল কবির গভীর ভাবনার উদ্দীপক মাত্র। ''রঙ যেন মোর মর্মে লাগে, আমার সকল কর্মে লাগে ।'' এই আকুতি অথবা প্রার্থনা কেবল একজন কবির নয়, দিনের শেষে বিশ্বমানবেরই। নিছক বাহ্যিকতায় নয়, মর্মের গহনে প্রবেশ করবে 'রঙ'। 'মর্ম' বর্ণময় হয়ে উঠলে বাহ্যিক জীবনও যথার্থই দীপ্ত হয়ে ওঠে, কর্ম যার প্রতীক। কিন্তু, আমরা 'ভিতর থেকে বাইরে' আসি না! বরং 'বাইরে'টাই আমাদের সব! ''ও পলাশ ও শিমুল কেন এ মন মোর রাঙালে..''--এই গানেও বর্ণময় পুষ্পসম্ভারে সজ্জিত প্রকৃতি মনের ভিতরে শুধু প্রবেশই করছে না, একই সঙ্গে হয়ে উঠছে একাকারও। আরেক গভীরতর বাণী কবিকণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে এভাবে: ''আমারই চেতনার রঙে পান্না হ'ল সবুজ, চুনি উঠল রাঙা হয়ে, আমি চোখ মেললুম আকাশে...।'' এই গূঢ়তম 'আমার চেতনা'কে কি সত্যিই আমরা চিনতে পেরেছি ? সম্ভবত নয়। 'পারিনি' বলেই আপন হৃদয়ে কবির প্রত্যয়, শুদ্ধ শ্লাঘা ও চর্যার সঙ্গে আমাদের 'দূরত্ব' আর ঘুচল না!
'রঙ' তো অনেক। রঙের প্রভাবও আমাদের জীবনে অনস্বীকার্য। কিন্তু, সব ছাপিয়ে গভীর ব্যঞ্জনায় দুটো রঙের প্রভাবই বোধহয় আমাদের জীবনে সবচেয়ে বেশি। সাদা ও কালো। জীবন, সমাজ, রাজনীতি সবখানেই এই দুটো 'রঙ' প্রবল প্রতাপে সর্বদা হাজির। তারাশঙ্কর 'কবি' উপন্যাসে 'স্বশিক্ষিত' নিতাই কবিয়ালকে দিয়ে বলিয়েছিলেন: ''কালো যদি মন্দ তবে কেশ পাকিলে কান্দ কেনে..?'' শান্তির সাদা পায়রা অদৃশ্য হয়ে থাকে, আর যুদ্ধের কালো ধোঁয়ায় ঢেকে যায় আকাশ-বাতাস! 'কালো মেয়ে'-কে নিয়ে কপালে উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তার ভাঁজ নিরন্তর পুরু হতে থাকে অগণিত হতভাগ্য জনক ও জননীর! এভাবেই চলতে থাকলে বলা বড় কঠিন যে, অশোক, কিংশুক, পলাশ সমস্ত ফুলের দল '...আনন্দে রহে ফুটিয়া'!
বস্তুত, জীবনকে যে গভীরভাবে বুঝতে পারে সে-ই জীবনকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারে ; মেঘলা আকাশ নয়, জীবনকে করে তুলতে পারে মেঘমুক্ত, প্রসন্ন নীলাকাশ। এই কথাটি এক ও অদ্বিতীয় শিবরাম চক্রবর্তীর ক্ষেত্রে নির্দ্বিধায় বলা যায়। শৈশবে 'রাজার অসুখ' গল্পে যে ফকিরের কথা পড়েছিলাম, যার চালচুলো কিছুই নেই, অথচ তার মতো 'সুখী'ও আর কেউ নেই। সুকুমার রায় তাঁর আশ্চর্য প্রতিভায় কঠিন কথা কত সহজ করে যে বলতে পারতেন! আমি গল্পের সেই সুখীতম মানুষটির মধ্যে শিবরামের স্পষ্ট ছায়া দেখতে পাই! বস্তুত, শিবরাম চক্রবর্তী 'হাসির গল্প' লেখেননি, তিনি 'জীবনকে হাসিময়' করে রাখার গল্প লিখেছেন! হর্ষবর্ধন ও গোবর্ধনের সুস্নিগ্ধ গল্পগুলিতে দুই ভাইয়ের যে 'অটুট ও অমলিন ভ্রাতৃত্বভাব' তিনি 'এঁকেছেন' সেটা বোধহয় সচরাচর সবার চোখে পড়ে না। হাসতে গিয়ে এই 'মূল্যবোধটা' ভুলে গেলে কিন্তু চলবে না। 'হর্ষবর্ধন অমনিবাস' গল্পগ্রন্থের প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ করেছিলেন প্রখ্যাত শিল্পী শৈল চক্রবর্তী। এই বইয়ে তিনি 'দুই চক্রবর্তী' শীর্ষক ভূমিকার শেষে লিখছেন: ''...শুধু সাহিত্য কেন প্রকৃতিতে অমন সরল শিশু আমার অভিজ্ঞতায় কেন অনেকের অভিজ্ঞতাতেই বিরল বলতে হবে। কোনওটাতেই ওঁর ক্ষোভ দুঃখ অসম্মান ছিল না, সংসারের বিরাট কালো রঙের ত্রুটিগুলোকে উনি হেসে উড়িয়ে দিতেন কোন যাদুতে জানি না। এক শিশুরাই বুঝি পারে যার জন্যে G K Chesterton-এর একটা কথা মনে পড়ে:
Stand up and be childlike,
But don't believe in anything
That can't be told
in coloured pictures. "