মঈনুল আহসান সাবেরের ‘কারণজল’ অথবা সুবিন্যস্ত ধাঁধাজাল

মুহিম মনির
Published : 17 Oct 2018, 10:02 AM
Updated : 17 Oct 2018, 10:02 AM


'আমার জন্মের মাস দু-আড়াই আগে আমার মনে হলো, জন্মের পর আমি যাকে বাবা বলে ডাকব, সে আমার জন্মদাতা বাবা নয়।'–ঠিক এভাবেই শুরু হয়েছে মঈনুল আহসান সাবেরের উপন্যাস, 'কারণজল'। আমাদের যাপিত জীবনের রঙরক্তই হচ্ছে এ উপন্যাসটির উপজীব্য বিষয়। আপাত সুখতৃপ্তির ভেতরেও যে লুকোনো থাকে অতৃপ্তির বিষণ্ণতা, সুবিন্যস্তভাবে সেসবই সামনে এনেছেন সাবের। শুরুতেই পাওয়া যায় যার স্পষ্ট আভাস। ওঁত পেতে থাকা ইঙ্গিতে আটকে গিয়ে ক্ষণিকের জন্য হলেও পাঠককে ভাবতে হয়–
এক। 'জন্মের দু-আড়াই মাস আগে', তার মানে কথাটি যে বলছে, তার এখনো জন্মই হয়নি। তাহলে? তবে কি কথক কোনো নবজাতকও নয়?
দুই। গর্ভস্থ ভ্রূণটির কোমল মনে এই কণ্টকিত সন্দেহটিই-বা জাগল কেন? তার মানে কি…
এমন একেক-পর-এক প্রশ্ন-সংকট-সন্দেহ পাঠককে টেনে নিয়ে চলে। একবার একটা উত্তর মিলব মিলব করেই আবার শুরু হয় আরেকটি সংকটের। আর 'উপন্যাসের শিল্প ও সমাজবাস্তবতা'য় সত্যেন্দ্রনাথ রায় যেটি বলেছেন–সংকটে উপন্যাসের আপত্তি নেই, বরং আগ্রহ আছে। সংকটের সমস্যার ধাক্কার মধ্যে দিয়েই উপন্যাসের কার্যকারণপরম্পরা প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠে।–'কারণজলে' সেটিই অবলোকন করতে থাকেন পাঠক। একটা ধাঁধাজালে আটকা পড়ে এগোতে থাকেন শেষ পর্যন্ত।

আলো-আঁধারীর আখ্যানভাগে চলতে গিয়ে পাঠকের পরিচয় ঘটে আলী জামান খান, খসরু, শামীমুল নামক চরিত্রগুলোর সঙ্গে। প্রথমোক্ত সংলাপলব্ধ ধারণা থেকে যাদের প্রত্যেকের দিকেই আঙুল তোলা যায়। কিন্তু তর্জনীর কোনো তীরই শেষ পর্যন্ত লক্ষ্যবিদ্ধ হয় না। বেঁকে বেঁকে যায়। যা প্রমাণ করে সাবেরের সুকৌশলী হাতের মুন্সিয়ানা। তবে লক্ষ্য-বিচ্যুতির বেদনা পেয়ে বসে না পাঠককে। কেননা 'কারণজল'র পাঠকরা এমনটিই চান। চান তাঁদের সন্দেহ মিথ্যে প্রমাণিত হোক! কিন্তু সেটিও খুব সহজে হয় না। ঔৎসুক্য আর উৎকণ্ঠার ঘোরের মধ্যে আটকে থাকতে হয় শেষাবধি।

প্রথম সন্দেহটা জন্মে আলী জামান খান বা এজেকের ওপর। রহস্যময় এই লোকটি শাহনাজের স্বামী মাহমুদের ব্যবসায় অনেকভাবে সহযোগিতা করে। আর দশটা ক্ষেত্রে যা হয়, 'কারণজলে'ও তা ঘটে। ধীরে ধীরে শাহনাজের সঙ্গেও যোগাযোগ স্থাপিত হয় এজেকের। নারীলিপ্সা তার সহজাত বৈশিষ্ট্যের অন্তর্গত বলেই পাঠকের চক্ষুশূলে বিদ্ধ হয় সে। একদিন কাউকে না-বলে তার বাগানবাড়িতে শাহনাজের চলে যাওয়া এবং আরেকদিন ফাঁকা বাসায় আলী জামানের নিমন্ত্রণটাও পাঠকের কানে কানে কিছু বলে। আর স্বয়ং শাহনাজ যখন মাহমুদকে বলে–জীবন বড় অদ্ভুত। অদ্ভুত না হলে কেন তোমার সঙ্গে ওনার (আলী জামান খানের) পরিচয় হবে!… তারপর আমার সঙ্গেও… আমার সঙ্গেও…।–তখন সেই সন্দিগ্ধতাকে একরকম সত্যই ধরে নেন অনেকে। বাচ্চাটির বাবার জায়গায় আলী জামান খানকে বসানোটা তখন নেহাত বাতাসে বাড়ি বানানো বনে যায় না।

কিন্তু শাহনাজের দেবর-সম্পর্কীয় খসরুকেই কি দূরে রাখা যায়? ঐ যে বোহেমিয়ান যুবকটি, শিমুলের সঙ্গে যার একটি সম্পর্ক ছিল, তার বিয়ের ব্যাপারে শাহনাজের বেঁকে বসাটাও কম ধাঁধাজাল বোনে না। পূর্ববৎ ধারণা বদলে গিয়ে পাঠকমনে তাই উঁকি দেয় নতুন দ্বৈধ। দেয়ারই কথা। কেননা এ কথাগুলো যে সে-কথাই বলতে চায়, 'ব্যাপারটা এমনই দাঁড়াল–শাহনাজই এ বিয়েটা হতে দিল না। হতে দিল না মানে, সে এ বিয়ের ব্যাপারে শক্ত হয়ে দাঁড়াল। এ নিয়ে অবশ্য স্পষ্ট করে কেউ কিছু বলল না, খসরু তো নয়ই, মাহমুদও না, এমনকি শিমুলও শুধু অভিমানের চোখ নিয়ে ফিরে গেল, কিছু বলল না। সে অবশ্য আরো পরে এ বাসায় আরেকবার এসেছিল। দুপুরের দিকে। সাড়াশব্দহীন নিথর এক দুপুরের দিকে। অদ্ভুত চোখে শাহনাজের সঙ্গে কিছু কথা বলেছিল। তবে, ওসব পরে। হ্যাঁ, পরে।'
পরে বলতে এর প্রায় পঁয়তাল্লিশ পৃষ্ঠা পরে এসেছিল নরম শান্ত মিষ্টি চেহারার মেয়ে, শিমুল। এসে স্পষ্ট কণ্ঠে বলেছিল, 'খসরুকে ছেড়ে দিন।' এমনকি মুখের ওপর এও বলেছিল–শুধু ধরেই রাখেননি, ওকে নিয়মিত খাচ্ছেনও।' এতে শাহনাজের ক্রোধের মাত্রাটা বেড়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত কী ঘটল? স্তিমিত হয়ে এল দপ করে জ্বলে ওঠা শাহনাজ। এখানে এসে এক হাতে আলী জামানকে পাকড়াও করার মতো করে আরেক হাতে খসরুর কলারও চেপে ধরতে পারেন পাঠক। কিন্তু শামীমুলকে ধরবেন কোন হাত দিয়ে? তার ওপরই কি আর কম সংশয় জন্মে?

সেদিনের ঠিক তিন-চারদিন পরে শামীমুলের প্রতি শাহনাজের যৌনাকাঙ্ক্ষার আবহ ভিন্ন গন্ধ ছড়ায়। পাঠক পুনরায় খেই হারিয়ে ফেলতে শুরু করেন। সরল সুদকষার অংকটা মেলাতে পারেন না কিছুতেই। দেখতে দেখতে শেষদিকে এসে শাহনাজ যখন মাহমুদকে বলে–আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। খুব।–তখন সংবেদনশীল পড়ুয়া অবশ্য ভোলার চেষ্টা করেন সূচনালব্ধ ধ্যানধারণা। আর তার পরপরই 'টুকুন' চরিত্রের টুক করে ঢুকে পড়াটা তার মনকে করে তোলে আরেকটুখানি সংবেদী। আসলে ওসব কিছুই নয়; সেই কৈশোরের প্রথম প্রেমের স্মৃতিই হয়তো তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে শাহনাজকে, এমনটা ভেবে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন মধ্যবিত্তীয় মূল্যবোধসম্পন্ন পাঠক।

আর সম্ভবত এ কারণে মায়ের পেটে বর্ধিষ্ণু পান্তাবুড়িকেও অবশেষে এসে বলতে হয়, 'কারণজলের কথা ভেবে, উৎসের কথা ভেবে–আমার ভেতর যে সামান্য খুঁতখুঁতানি আছে, জানি, পৃথিবীর আলো দেখার পর তা-ও আর থাকবে না।… এসব বুঝে ওঠা কঠিন। থাক বরং, সবকিছু বুঝতেই হবে, এমন কোনো দিব্যি এই প্রকৃতি দিয়ে রাখেনি, বোঝার ব্যবস্থাও সে রাখেনি। সুতরাং থাক বরং।'
কিন্তু সে-থাকা থাকে কি? আগের রেশই যে বরং থেকে যায় মনের গহীনে। অতো সহজে উবে যায় না সেই অনুত্তর ধাঁধাটা। খুঁতখুঁত করতে থাকে পোড়োদের মন। আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে কেবল মাহমুদেরই নয়; আলী জামান, খসরু আর শামীমুলেরও শয্যাসঙ্গিনী হয়েছিল শাহনাজ। হতে পারে না কি? নইলে প্রাগৈতিহাসিক আকর্ষণে শাহনাজের শামীমুলের ঘরে ছুটে যাবার এক-দেড় মাস পরে ডাক্তার যখন জানালেন যে, নতুন অতিথি আসছে, তখন শাহনাজ কেনই-বা বলে উঠল, 'কিন্তু কবে হলো!' না, এটা কোনো প্রশ্ন ছিল না। ছিল উদ্বেগ কিংবা উৎকণ্ঠা। আবার উচ্ছ্বাসও হতে পারে। বাক্যশেষে বিস্ময়চিহ্নটি (!) বসিয়ে এখানেও একটা ধাঁধাজাল বুনে দিয়েছেন সাবের।
এখন 'কারণজল' পাঠশেষে একেকজন একেকভাবে ভাবতেই পারেন। যোগাড় করতে পারেন প্রতিটি প্রতর্ককে নাকোচ করার মতো প্রমাণ। মতদ্বৈধতার এ ব্যাপারে তেমন কাউকেই হতাশ করেননি সাবের। নিজে থেকে নেননি কোনো সিদ্ধান্ত; করে দেননি কোনো সমাধান। একা একাই লিখে ফেলেননি পুরো উপন্যাস। পাঠককেও সঙ্গে নিয়েছেন তিনি। আর এ জায়গায় এসেই সার্থকতা দাবি করে 'কারণজল'। এবং কথাসাহিত্যিক মঈনুল আহসান সাবেরের এভাবেই পাঠক-হৃদয়কে কেবল আলোড়িতই করেন না, জয়ও করে ফেলেন সমান দক্ষতায়।

উপন্যাস: কারণজল
লেখক: মঈনুল আহসান সাবের
প্রকাশক: দিব্যপ্রকাশ
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ১৫
প্রচ্ছদ: মঈনুল আহসান সাবের
মূল্য: ১৩৫ টাকা মাত্র।