-জানি না। হঠাৎ আপনার এই চিরকূটটা দেখলাম। মনে হলো আপনি আমাকে আসতে বলেছেন..
Published : 03 Mar 2025, 05:00 PM
হাতের মাটির ঢেলাটা হাতেই রয়ে গেল। পানিতে ছুঁড়তে গিয়েও পারল না অরুণ। জানে, ঢিলটা পানিতে পড়লেই ছবি ভেঙে যাবে। ওর ছবি। ওই একটু একটু তির তির করে কাঁপতে থাকা নিজের ছবির ভেতরে আরেকটা ছবি ক্ষণিক ভাসে, ক্ষণিক ডোবে। চিনি চিনি করেও চিনতে পারে না অরুণ। বহুবার এমন হয়েছে। হঠাৎ করেই মনে হয় কার যেন মুখ? কার মুখ? তারপর স্মৃতির সিঁড়ি বেয়ে পেছনে চলে যায়। এ যেন পেছনে নয়, নিচে নামা। অতলে নেমেও থৈ পায় না। ফিরে আসে।
অরুণ জানে তার নাম অরুণ। শুড়িখানায় মাস্তানি করে। আরও জানে হোদোলকুঁতকুঁত চেহারার সোলায়মান লোকটা তার বাপ, কিন্তু ‘বাবা’ বলে ডাকেনি কখনও। ডাকতে ইচ্ছে করেনি। নিরেটবুদ্ধির অরুণ ওই লোকটার চোখে কখনও মায়া দেখেনি। রাত গভীর হলে লোকটা এসে ক্যাশ থেকে টাকা গুনে গাড়ি চড়ে চলে যায়। অরুণ শুড়িখানার পেছনে একটা আট বাই আট খুপরিতে থাকে। প্রেমহীন। মায়াহীন। আশাহীন। কখনও তার মনেও আসেনি সে আসলে কে।
একদিন সন্ধ্যেরাতে ঘাড়ের কাছে থলথলে মাংসের দলা নিয়ে একটা লোক ফুটফুটে একটা মেয়ে নিয়ে শুড়িখানায় এলো। অরুণ জানে এখানে মেয়েরা আসে না। ছোট থেকেই শুনে শুনে শিখেছে। ভদ্র ঘর বলতে কী বোঝায় তাও জানে না। শুধু জানে সচারচর মেয়েরা শুড়িখানা বা বারে আসে না।
অরুণ ঘরের কোণে তার নির্ধারিত টুলে সটান বসে থাকে। ওর কাজ-শুড়িখানায় বেমক্কা গিলে কেউ বেগড়বাই করলে তাকে সামলাতে হবে। গাট্টাগোট্টা অরুণ কাউকে মারে না, তবে এমনভাবে ধরে যেন হাড় থেকে মাংস খসে আসবে। ওই কাজই তাকে খাবার দেয়। আশ্রয় দেয়। আর গভীর রাতে নিঃশব্দে কাঁদার একাকীত্বও দেয়।
মেয়েটা একটা স্কচ নিয়ে মাথা নিচু করে সিপ করছিল। থলথলে চর্বির ডান হাতটা মেয়েটার পিঠে মাকড়সার মত ঘুরে বেড়াচ্ছে। অরুণ চোখ সরিয়ে নেয়। টিক টিক করে দেওয়াল ঘড়িটা ঘুরে চলেছে। অনেকক্ষণ বাদে মেয়েটাকে দেখল টেবিলে মাথা ঠেকিয়েছে। ডান হাতটা এখন ঘুরছে না। এক জায়গায় একদলা মাংস খামচে ধরে আছে। কয়েকটা ছোকরা টলতে টলতে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় খিল্লি নেয়-
-চালিয়ে যান কাকা! খাসা মাল!
থলথলে চর্বি আড়ষ্ট ভঙ্গিতে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। আরও একজন আরও কাছে এসে ফিসফিস করে বলে- ‘পারবেন, না প্রক্সি দেব কাকু?’ লোকটা খিস্তি করে-‘বান্দির পুত এক থাবড়া মারব, যা ভাগ’। ছোকরাগুলো টলতে টলতে বেরিয়ে যায়।
লোকটা বেয়ারা ডেকে বিল মেটায়। তারপর মেয়েটার হাত ধরে তুলতে গেলেই মেয়েটা মোমের মত টেবিলের নিচে গলে পড়ে! ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে থপাস বসে পড়ে লোকটা। খানিক বাদে ইশারায় অরুণকে ডাকে। যন্ত্রচালিতের মত এগিয়ে যায় অরুণ। ও জানে কী করতে হবে। আলতো করে মেয়েটাকে কোলে তুলে নিয়ে সাবধানে বেরিয়ে আসে। লোকটা গাড়িতে উঠে বসেছে। অরুণ আস্তে করে মেয়েটাকে পেছনের সিটে নামিয়ে দেয়ার সময় হঠাৎ মেয়েটা অরুণের হাত খামচে ধরে। এত জোরে ধরে যে অরুণ জোর করেও ছাড়াতে পারে না। এক সময় অরুণ জোর করে হাত ছাড়াতে গেলে মট মট করে চুড়ি ভাঙার শব্দ হয়। এতক্ষণে ও খেয়াল করে মেয়েটার এক হাতে ঘড়ি, অন্য হাতে একগাদা কাচের চূড়ি! মুহূর্তে ভাঙা কাচে হাতের চামড়া উঠে রক্ত ঝরতে থাকে। অরুণ বুঝতে পারে না কী করবে? গাড়ি ছাড়বে এই সময় মেয়েটা একেবারে সুস্থ্য মানুষের মত উঠে বসে সটান অরুণের চোখে চোখ রাখে। চমকে ওঠে অরুণ! কী যেন আছে ওই চোখে! বুঝতে পারে না। লেখাপড়া না-জানা অরুণের ভেতরটা চমকে উঠলেও ঠাওর করতে পারে না। সশব্দে গাড়িটা বেরিয়ে যায়। অরুণ কি মনে করে গাড়িটার দিকে তাকাতেই দেখে মেয়েটা মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে আছে। সেই বিস্ফোরিত চোখ!
লাইটপোস্টের হলুদাভ আলোয় রাস্তার দুটো কুকুর অলসভাবে হেঁটে যায়। আলো ঘিরে ভাট পোকাগুলো অনর্থক গোল হয়ে ঘুরছে। আলোর ওপরে ধোঁয়াটে আকাশ। সাঁই সাঁই করে এক একটা গাড়ি চলে যাচ্ছে। পেছনের লাল আলো জ্বলছে-নিভছে। সেই দুটো কুকুরের একটা এসে লাইটপোস্টের নিচে শুয়ে পড়ে। একটা আরশোলা সোজা এসে কুকুরটার নাকের কাছে থামে। কি মনে করে আরও সাহস দেখাতে গেলে কুকুরটা আড়মোড়া ভাঙে। আরশোলা দ্রুত অন্ধকারে সরে যায়। সে রাতে অরুণ ঘুমাতে পারে না। খুব ভোরের দিকে স্বপ্ন দেখে মেয়েটাকে।
অরুণ যেন সেই ছোট্টবেলাকার গ্রামে। দুপুরে বিলে গিয়ে ঢ্যাপ তুলে আনে। ডুব দিয়ে শালুক তুলতে গিয়ে পেটে পানি ঢুকলে খক খক করে কাশতে থাকে।
-মা ঢ্যাপের খৈ বানিয়ে দেবে?
-পাগল ছেলে, ঢ্যাপ হলেই কি খৈ হয়? অনেক ঝামেলা…
ঢ্যাপ ঢ্যাপ! ঢ্যাপের খৈ…. মনে হতেই ঘুম ভেঙে যায় ওর। বিদুৎচমকের মত মনে পড়ে কাকে যেন ও ছোটবেলায় ‘ঢ্যাপের খৈ’ বলত!
চচ্চড়ে রোদের সকালে রাতের সবকিছু হারিয়ে যায়। আর একটা নতুন দিন। সেই রোজকার অরুণের ডিউটি। টুংটাং মদের গ্লাসের শব্দ। কখনও কখনও বিশ্রী খিস্তি। রাত গভীর হলে সদর দরজা বন্ধ করে তার নিজের আট বাই আট খুপরি।
মাস খানেক পর এক রাতে সন্ধ্যে থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে। ওরই মধ্যে সেই মেয়েটা হাজির। অবাক হয় অরুণ। মেয়েটা আজ একা! একটা ফাঁকা টেবিলে বসে মদের অর্ডার দিয়েছে। অনভ্যস্ত হাতে ঢকঢক করে গিলে ফেলল। কিছুক্ষণ পর সেইদিনের মত গলে পড়ল টেবিলের নিচে। অরুণ দৌড়ে গিয়ে মেয়েটাকে তোলে। ও জানে এখন একদল হারামির বাচ্চা এসে মেয়েটাকে একা পেয়ে হেনস্তা করবে। এসছিলও। কিন্তু অরুণের গাট্টাগোট্টা শরীর দেখে সাহস করেনি। অরুণ মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে টেনে টেনে বাইরে এসে সিএনজি খুঁজতে থাকে। সিএনজিতে ওঠার আগ পর্যন্ত মেয়েটা বেহুশ, কিন্তু যেই সিএনজি ছাড়বে তার আগ মুহূর্তে সোজা হয়ে বসে অরুণের দিকে তাকায়। যেন বুকের ভেতর পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে। শেষ মুহূর্তে মেয়েটা এক টুকরো কাগজ গুঁজে দেয় অরুণের হাতে। অরুণের খেয়াল নেই। ভুস করে সিএনজি চলে যেতেই কাগজটা খুলে ধরে। বাড়ি নম্বর ১১, রোড নম্বর ২২, লালমাটিয়া। মেয়েটা কেন তার ঠিকানা দিল বুঝতে না পেরে রোবটের মত খুপরিতে ফের ও।
এক মাস, দু মাস। মন থেকে হারিয়ে যায় মেয়েটা। বর্ষাকাল শেষ হয়েছে। শুড়িখানার বাইরে ফুটপাথে ধুলো জমে সেখানে একটা বটের চারা গজিয়েছে। কটকটে সবুজ। বিকেলটা ঝুপ করে অন্ধকার হয়ে যায়। কারা যেন রংহীন প্রতিমা নিয়ে যায় হাফ ট্রাকে করে। অরুণের মনে পড়ে এখন বড় পুজোর সময়। রাতে অরুণ অনেকদিন পর তোষকের তলা থেকে একটা জরাজীর্ণ সাদা-কালো ছবি বের করে। মা। নিয়ম করে কয়েক মিনিট ধরে দেখে। তারপর আবার গুঁজে রাখতে যায় তোষকের নিচে। আর তখনই সেই চিরকূটটা নজরে পড়ে। বাড়ি নম্বর ১১, রোড নম্বর ২২, লালমাটিয়া।
ওর সাধারণত দিনে কোনো কাজ থাকে না। ঘুমায়। আজ ঘুমাল না। একটা পরিষ্কার জামা পরে বেরিয়ে গেল। রিকসায় উঠে বলল-রোড নম্বর ২২ লালমাটিয়া। আধ ঘন্টা পর এ গলি সে গলি ঘুরে পেল সেই ১১ নম্বর বাড়ি। বুক ঢিপ ঢিপ করছে। কী বলবে? কেন এসেছে? যদি ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়? এরকম ভাবতে ভাবতে গেটের বাইরের কলিংবেল চাপ দেয়। সাড়াশব্দ নেই। আবারও চাপ দেয়। এবারও কেউ আসে না। তৃতীয়বার চাপতে যাবে এমন সময় ঘড় ঘড় করে চাকা লাগানো গেট খুলে যায়। চাতালে ঢুকতেই দেখে সেই মেয়েটা ব্যালকনিতে দাঁড়ানো।
-সোজা উপরে উঠে আসো।
-আমাকে চিনতে পেরেছেন? ওই যে বারে….
-পেরেছি। অত কথার তো দরকার নেই, আসতে বলেছি, উঠে এসো।
এবার সাহস পেয়ে দোতলায় উঠতে থাকে অরুন। মেয়েটা সিঁড়ের শেষ ধাপে ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে লিভিংয়ে বসায়। হচকচিয়ে যায় অরুণ। ঘাড় ঘুরিয়ে সেই হোৎকা লোকটাকে খোঁজে। দেখে না। মেয়েটা বুঝতে পেরেছে।
-আমি আর দারোয়ান ছাড়া আর কেউ নেই বাড়িতে।
অবাক হয় অরুণ। কী করবে ভেবে পায় না। দুজনই নিশ্চুপ। আরও পরে মেয়েটা বলে-
-কেন এসেছ?
-জানি না। হঠাৎ আপনার এই চিরকূটটা দেখলাম। মনে হলো আপনি আমাকে আসতে বলেছেন..
-আশ্চর্য! কেন আসতে বলব? আমি তো ঠিকানা দিয়েছিলাম যদি বেহুশ হয়ে পড়ি তাহলে যেন বাসায় পৌঁছে দাও….
-ওহ হো, সত্যিই তো। আমি খামাখা আসলাম…
আচ্ছা। এই জায়গাটাতে এসে আমরা পজ দিলাম। ভাবা যাক মেয়েটা প্রথম দেখাতেই অরুণকে চিনেছিল। অরুণ চেনেনি। মেয়েদের সিক্সথ তো আছেই, সেভেন্থ সেন্সও কাজ করে। বড় পূজোর সময় মামাবাড়ি যাবার সময় অরুণদের নৌকাডুবি হয়। অরুণ আর তার ছোটবোনকে বাঁচানোর জন্য মা-বাবা দুজনই প্রাণান্ত চেষ্টা করে দুজনকে বাঁচাতে পারলেও নিজেরা মারা যায়। সিনেমার মত ছিটকে যায় দুটি শিশু। অরুণ ফুটপাথে ঠেলা-গুতো, লাথি-ঝামটা খেয়ে বড় হয়। মেয়েটা একটা ধনীর নজরে পড়ে। নিজের মেয়ের মত মানুষ করে। তারপর এক রাজপুত্তরের সাথে বিয়ে হয়। কয়েকদিন পরই রাজপুত্তুর ইয়ার-দোস্তদের নিয়ে মেয়েটার সাথে গ্যাংব্যাং করে। মেয়েটা পালিয়ে যায়। পড়ে সেই ঘাড়ে চর্বি মটকুর পাল্লায়। সে তাকে কলগার্ল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
মেয়েটা অরুণকে চিনলেও পরিচয় দিতে সাহস করে না। ভাবে গল্প-সিনেমার মত হয়ত অরুণ কিছু একটা দেখে ঠাওর করতে পারবে যে সে তারই হারিয়ে যাওয়া বোন- তাপসী ওরফে ঢ্যাপের খৈ! কিন্তু না। এটা গল্প-সিনেমা না। অরুণের কোথায় যেন একটা খচ খচ করেই আবার থেমে যায়। ওই যে অরুণ মার ফটো দেখে, সেটাও আসলে ফটো না। সব অরুণের মনে করা কেবল। অরুণ ক্লাইম্যাক্সে যেতে পারে না। লেখাপড়া না জানার এই এক বিপদ! সব জানে বোঝে, কিন্তু প্রকাশ নেই। সিনেমায় কি হতো? মেয়েটা একটা গান গাইত। হঠাৎ অরুণের মনে পড়ত-এই গান কোথা থেকে শিখল? এ তো তার মায়ের গান! ব্যাকওয়ার্ডে ঝনঝন করে মিউজিক বাজত….ভাটপোকা, দুটো কুকুর। একটা লাইটপোস্ট। আর পোস্টের আলোর ওপাশে গাঢ় অন্ধকার মাথায় নিয়ে অরুণের আলোর গতিতে সব মনে পড়ত…..তারপর? দুভাই বোনের মিলন। হ্যাপী এন্ডিং!
না। এই গল্পের ক্লাইম্যাক্স কী তা আমরা জানি না। আমি হলে কী করতাম, আপনি হলে কী করতেন, এই পর্যন্ত ভাবতে পারতাম। তারপর? বেশ্যা বোনকে মেনে নিতেন? তর্কের খাতিরে বলতেন- নিশ্চই নিতাম। কিন্তু অরুণ, তাপসী, ঘাড়ে চর্বি, ফচকে ছোকরার দল, দুটো অলস কুকুর, শুড়িখানার মালিক সোলায়মান এবং আমি-আপনি সক্কলে জানি- এটা গল্প। এখানে যা খুশি করা যায়। আসলে কী তাই?
উত্তর দিতে পারে সেই আরশোলাটা! কীভাবে? ওরা সেই ডাইনোসর যুগ থেকে সব দেখে আসছে। সব জানে। ওরা জানবে না তো কে জানবে?