সাঁওতাল তরুণটি প্রথম তাকে ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে সিলেটের এক ব্যবসায়ীর কাছে।
Published : 07 Oct 2024, 10:58 PM
মধ্যাহ্ন তাপের নিচে সূর্য একাই পৃথিবীর মালিক হলে রোদ চশমা চোখে বাদশা বাস থেকে নামে। সূর্যের সঙ্গে তার যত বোঝাপড়া। রোদচশমা খুলে সে সূর্যকে চোখ রাঙ্গায় তারপর ক্রমশ পা বাড়ায় পুরোনো অশ্বথ গাছের নিচে অবস্থিত চায়ের দোকানের দিকে। কবিরের এখানে আসার কথা। ততক্ষণে যাত্রীরা আড়মোড়া ভেঙ্গে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে নিজেদের প্রস্তুত করছিল। মানুষের দীর্ঘদিনের অভ্যেস অনুযায়ী বাসের দরজায় দাঁড়িয়ে পরিচিত কাউকে দেখার প্রত্যাশায় চারিদিকে তাকায়।
চার কাপ চা ও ৬টা সিগারেট শেষ করার পূর্বে কবির মাটি ফুঁড়ে একেবারে সামনে উপস্থিত হলে বাদশা চমকায় না। বাদশা এখন কিছুতে চমকায় না। এমনকি মৃত্যু এসে হাজির হলেও সে চায়ের পেয়ালায় নির্বিঘ্নে চুমুক দিয়ে বলবে, একটু দাঁড়ান চাটা শেষ করে নেই। আজও কবিরকে দেখে চমকাল না, বরং ত্রস্ত হয়ে বলল, চলেন যাওয়া যাক।’
ইচ্ছাকৃত লেট হয়নি বিষয়টা ঢাকবার জন্য কবিরের অহেতুক অজুহাত উপেক্ষা করে বাদশা একটা সিএনজি ডাকে। সিএনজিতে উঠে নিজের অজান্তে কবিরের মুখ ফসকে বেরিয়ে পরে, শ্রীবর্দী।
সিএনজিতে কবির বাদশাকে অনবরত যা বোঝাচ্ছে তার অধিকাংশ বিকট শব্দের কারণে বাধাগ্রস্ত হয়। বিষয়টা কবির বুঝতে পেরে নিজেকে সংযত করে কৌশলে সিগারেট ধরিয়ে বাদশাকে অফার করে। বাদশা নিজস্ব ব্রান্ড ছাড়া অন্যটা গ্রহণ করে না জেনেও কবির কাজটা করে। হয়ত ভদ্রতার খাতিরে নয়ত প্রহসন করার জন্য। কে জানে! বাদশা ব্যপারটিতে বিচলিত হয় না। পারতপক্ষে সে সিএনজিতে চড়ে না বলে কিছুটা কাচুমাচু হয়ে বসে থাকে।
সরি স্যার, আপনার তো আবার সিএনজিতে ভয়। কি করব বলেন, ওইখানে তো আর প্রিমিও করলা যায়না! আমরা হচ্ছি স্যার খেটে খাওয়া মানুষ, এক রকম গোলামও বলতে পারেন! অর্থের বিনিময়ে জান বাজি রেখে গহিন বন থেকে গুপ্তধন যোগান দেবার শর্তে আপনাদের গোলামিত্ব বেছে নিয়েছি।
এই শহরে বাদশা প্রথম না, তবুও তার কাছে অচেনা লাগে সব। শেরপুর বাজারের শেষপ্রান্ত থেকে শুরু হয়ে পথটা সামনের দিকে ক্রমশ অদৃশ্য হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে কল্পনার কোন শহরে তারা চলেছে। রাস্তার গতিময় দৃশ্য তাকে কিছুটা নষ্টালজিক করে। তার শৈশব- কৈশোর- যৌবন রঙিন মন পেরিয়ে বিকেল গুনে দেখে প্রায় অর্ধশত বছর। সারা জীবন সাপের পাঁচ পা দেখবার আকাঙ্ক্ষায় অতিবাহিত করেছে। প্রথমে বাবা তারপরে চাচার সঙ্গে চেনা-অচেনা- অজানা শহর-গ্রাম চষে বেড়িয়েছে। পথের বাঁকে বাঁকে অজানা সব বিপদ অপেক্ষা করছে জেনেও এই পেশা তাকে আষ্টে-পৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছিল। এ যেন তাদের বংশের এক আদিম চক্র, তারা এই পেশায় বৃত্তের মধ্যে ক্রমশ দঁড়ি পেছিয়ে ছেড়ে দেয়া লাটিমের মতো ঘূর্ণায়মান। ঘূর্ণায়মান এই চক্রে আবদ্ধ হয়ে বাপ-দাদার রক্ষিত সম্পদ বিক্রয় করে আজ স্বর্বশান্ত।
আজকেরটা যদি ভুয়া হয় তাইলে এই বান্দার জান নিয়া নিয়েন। ম্যালা কাঠখড় পোড়াইতে হয়েছে এই মালটার খোঁজে। ওজন ও লম্বায় একেবারে পারফেক্ট। সাড়ে ১৬ থেকে পৌনে ১৭ ইঞ্চি। ওজন ২৬২ গ্রাম। আরেকটা কথা শুনলে আপনার খুশিতে মইরা যাইতে ইচ্ছা করবে। হাঁস পা!! আহারে স্যার! মালটা একবার হাতে চইলা আসলে জীবনটা পাইল্টা যাবে। কবিরের চোখে মুখে রৌদ্রজ্জ্বল দিন ঝিলিক মারে।
শ্রীবর্দী পোড়াগাঁও বাজারের কাছে সিএনজি থামলে তারা নামে। বাদশা চারিদিকটা একবার অবলকন করে বাজারের মধ্যে চায়ের দোকানে বসে। কবির নেমেই তারামিয়ার কাছে মোবাইল লাগালে সে জানায় দশ মিনিটের মধ্যে পৌছে যাবে।
২.
পনের দিনের মতো গহিন বনের মধ্যে গারো পরিবারটার সঙ্গে অবস্থান করে হাঁপিয়ে উঠছিল। দোচালা বাড়ির মাচাঙ্গে দড়ির খাঁচাটিতে দম বন্ধ হবার জোগাড়। বাংলাদেশ থেকে পাচারের সময় বিজিবি তাদের ১১ টিকে আটক করেছিল। কলারোয়া উপজেলা গাড়াখালি এলাকায় জিরো পয়েন্ট থেকে বিজিপি উদ্ধার করে বন বিভাগে দিয়েছিল ঠিকই। কিন্তু পরবর্তীতে তাদের কে কোথায় চলে গেছে তার খবর কেউ রাখেনি।
তার পায়ের মূল্য আকাশ ছোঁয়া! মুরগি পা ও হাঁস পা। হাঁস পায়ের দাম আকাশচুম্বি। গত শীতে তাকে পাওয়ার পর শুরু হয়ে গেল চটকদার গল্প। এটা নাকি খুবই দুষ্কর। ওজন ৩০০ গ্রাম হলে মূল্য হবে হাজার কোটি টাকা। ভাবা যায়! মানব প্রজাতির নানান উপকারে নাকি তাদের শরীরের প্রতিটা অংশ কাজে লাগে। দেহাংশ দিয়ে এইচ আইভি ও ক্যন্সারের প্রতিষেধক তৈরি গবেষণায়, যৌন ক্ষমতা বর্ধক, মাদক তৈরি এমন কি তাদের শরীরে রয়েছে এক প্রকার বিষাক্ত দানা যা পারমানবিক রাসায়নিক তৈরিতে কাজে লাগে।
শুধু এতেই ক্ষান্ত হয়নি। তাদের মাংস খেলে বন্ধ্যাত্ব সেরে যায়, পুরনো বাত ও হাপানি রোগের উপশম হয়। আর কত কি! গৃহস্থের মঙ্গল হয় ভেবে গারো পরিবারটি থেকে আদৌ মুক্তি পাবে কিনা ভেবে ঝিম মেরে বসে থাকত।
৩.
দশ মিনিট পর শূন্য হাতে অচেনা ব্যক্তিটির উপস্থিতি বাদশার মাথায় রক্ত চড়িয়ে দেয়। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে হোঁচট খেতে খেতে সে এখন ক্লান্ত। ভেবেছিল আজকের দুর্লভ জিনিসটা তার ভাগ্য পরিবর্তনে যথেষ্ট ছিল।
কি ব্যপার তারামিয়া মাল কই? তুমিতো বলেছিলা একহাতে মাল অন্য হাতে টাকা।'
কবিরের কথার ঝাঁঝ টের পেয়ে তারামিয়া ভরকে গেল।
কাচুমাচু হয়ে বলে, সবই ঠিক আছিল। তয় ঝামেলাডা বাদাইল হেই গারো ব্যাডার বউ। কইলাম ৪০ হাজার ট্যাহা নগদ দিমু মালডা দিয়া দে। হের পরেও হুনল না। হেরা কয় এইডা বলে ভাগ্যলক্ষ্মী! তাই ওয়ানগালা অনুষ্ঠানের আগে কিছুতেই ছাড়ব না। ৫০ হাজার দিলেও না!
এক লাখ টাকা নগদ দিব। জিসিনটা আমার চাই।- বাদশার কঠিন স্বর শুনে কবির বলে, দ্যাহনা তারামিয়া! আবার একটু চেষ্টা কইরা।
তারামিয়া আঁকুপাকু চেয়ে, মোবাইল টিপে মনুমিয়া নামে জৈনক ব্যক্তির সঙ্গে কিছুক্ষণ তর্ক করল। আরে চিন্তা করস ক্যারে! পার্টি জেনুইন। গারোর ব্যাডারে বুঝাই কও। এক লাখ ঠ্যাহা জীবনে চক্ষে দ্যাখসস!
এভাবে কিছুক্ষণ বাগবিতণ্ডা করার পর তারামিয়া একটা সিন্ধান্তে উপনীত হয়। স্যার, যদি বিশ্বাস করেন ট্যাহাডা আমারে দ্যান। তারামিয়া গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলল, বেলা থাকতে থাকতে মালডা লইয়া আই। আর বিশ্বাস না করলে আপনেরাও আমার লগে যাইতে পারেন। তয় রাস্তা তেমন বালা না। গ্রামডা জঙ্গলের এ্যাক্কেরে ভিতরে। অহন আপনারাই ডিসিশন লন কি করবেন!
সমস্তটা শুনে বাদশা সজোরে হেসে ওঠে। মানুষকে বোকা বানাবার বুদ্ধিটা ভালোই এঁটেছ। জিনিস হাতে না আসা পর্যন্ত এক টাকাও পাবে না। যেভাবে পার জিনিসটা আনার ব্যবস্থা কর। তাতে তুমিও লাভবান হবে। এই লাইনে তারামিয়ার মতো ধান্দাবাজ লোক কম দেখেনি বাদশা!
কবির তারামিয়ার হয়ে সুপারিশ করে। যতদূর জানি তারামিয়া এই লাইনে অনেক সৎ। কিছুক্ষণ ভেবে বলে, স্যার,এক কাজ করলে কেমন হয়, তারামিয়ার সঙ্গে স্পটে গেলেই তো সব সমাধান হইয়া যায়।
'গারোর বাড়ি কতদূর? অনেক ভেবে বাদশা প্রশ্ন করে।
হেই গারো পাহাড়ের উপরে সীমান্তর লগে কর্ণঝোড়া এলাকায় খ্রিস্টান পল্লীর আরো ভিতরে। বালা রাস্তা দিয়া গেলে পুলিশ বিজিপি সন্দেহ করবার পারে তাই ম্যালা দূর ঘুইরা যাওন লাগব। খ্রিস্টান পল্লীর কাছে মনুমিয়া আমাগোরে হেই বাড়িত পৌছাই দিব।
মনুমিয়া আবার কে? বাদাশা দুভ্রূর মাঝে ভাঁজ ফেলে প্রশ্ন করে। ব্যাপরটা তার ঘোলাটে মনে হচ্ছিল।
মনুমিয়ার মতো এক্সপার্ট এই লাইনে খুব কমই আছে। হেইতো মালডার খবর দিলো। কেউ য্যান না সন্ধেহ করতে না পার হেই ল্যাইগ্গা মালডারে গারোর বাড়িত রাখছে। গারোর বউ ভাগ্যলক্ষ্মী ভাইবা হেইডারে পূজা করে। হেগ বিশ্বাস, জিনিসটা বাড়িত রাখলে বলে সন্তান হয়। হেগ তো কুন সন্তান নাই তাই কয় না বিশ্বাসে মিলাই বস্তু তক্কে বহু দূর।
বাদশা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে। তারও তো স্ত্রী- সন্তান কেউ নেই। তবু কোন মোহে সে এখানে এসেছে? পরবর্তীতে নিজের দুর্বলতা পাছে সবাই জেনে যায় ভেবে নিজেকে সামনে বলে, প্যাঁচাল ছেড়ে সেখানে কিভাবে যাওয়া যায় সেই কথা বল। এরই মধ্যে কবির বাদশাকে একটু দূরে আসতে বলে। এক সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্তে আসে খ্রিস্টান পল্পী পর্যন্ত তারা সবাই একসঙ্গে যাবে। তারপর শুধু কবির মনুমিয়ার সঙ্গে স্পটে।
দুটো রিক্সা করে তারা শ্রীবর্দী থেকে ভায়াভাঙ্গা বাজারের কাছে থামে। স্যার, এখান থেকে ঐযে সরু পাহাড়ি পথ দেখতাছেন হেই পথে পায়ে হাইটা যাওন লাগব।
ভায়াভাঙ্গা বাজারের পাদদেশ ঘেষে উপরে উঠে গেছে গারো পাহাড়। শেরপুরে শ্রীবর্দী উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় বাস করে পাহাড়ি গারো, কোচ, হাজং ও স্থানীয় আদিবাসী। চারপাশে উঁচু উঁচু সবুজ পাহাড় ও ঘন অরণ্য। উঁচু উঁচু শাল ও সেগুনগাছের সারি। পাহাড়ি ঢালুর আঁকাবাঁকা রাস্তার পাশ ঘেষে বাঁশ বেত গাছের কাঁটা ঝোপ। বুনো গাছ-পালার ফাঁকে ফুটে আছে হরেক রকমের বুনো ফুল। তাদের উপর প্রজাপতির ওড়াউড়ি। পাহাড়ের আঁকাবাঁকা উঁচু-নিচুঁ পথ পেরিয়ে যতদূর এগোনো যায় ততই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সমারোহ বাড়তে থাকলেও বাদশার মন অজানা আশংঙ্কায় ধুকপুক করে। বেলা অনেক বাকি থাকলেও পাহাড়ের গায়ে মেঘ- রোদ্দুরের খেলা তাদের নজর কেঁড়ে নিচ্ছিল। এর মধ্যে কয় কিলো পার করেছে তারা জানে না। ঘড়ি দেখে বোঝে প্রায় ঘন্টা খানেক তারা হেঁটেছে। হঠাৎ সামনে পানি দেখে থমকে দাঁড়ায়।
স্যার, অহন প্যান্ট উঠাইতে অইব। শালার এমপি ভায়াভাঙ্গা বাজার- বালিজুড়ি রাস্তাডা পাকাকরণের প্রতিশ্রুতি দিসিল, মাত্র আধা কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা। দ্যাহেন অহনও কি অবস্থা। রাস্তা তো অই নাই,অহন বর্ষার মৌসুম পানি আইয়া প্যাক প্যাকা অইয়া গেছে। হুদা পানি না, পাহাড় থেইক্যা হাতি আইয়া খেতের ধান খাইতাছে,সমানে মানুষ মারতাছে। এইহানে দেহনের কেউ নাই। এমপি ভোটের আগে ম্যালা কথা কইয়া ভোট নিল মাগার কাজের বেলায় ফুট্টুস।
কবির পরনের প্যান্ট ফোল্ড করলেও বাদশা গজগজ করতে থাকে। অতিকষ্টে পথটা অতিক্রম করে বাদশা জিন্সের প্যান্ট ঠিক করে নাইকির স্নিকার টিস্যু দিয়ে মুছতে থাকে। মনে মনে নিজেকে ভৎসঁনার সুরে বলে, কেন যে এই জুতাটা পরতে গিয়েছিলে? এবার বোঝ!
৪.
আজ গারো বউটি ওয়ানগালা উৎসবের প্রস্তুতি করছিল। তাদের এবার জুমচাষ করে প্রচুর ফসল হয়েছে। দেবতা মিসি আর সালজং -এর উদ্দেশ্যে উৎপাদিত ফসল উৎসর্গ করা হবে। সামনের সপ্তাহের গ্রামের আয়োজিত অনুষ্ঠানে সে নাচবে। অনুশীলন শুরুর আগে পূজা করে দেবতা তাতারওকে স্মরণ করল। প্রাণীটি ভাবে, তাদের পূর্ব প্রজন্ম মনুষ্য সমাজে এতো কদর পেয়েছে কিনা ভেবে তেমন কোন স্মৃতি পেল না। তবে পূর্বে মানুষ তাদের ডাকে ভয়ে আঁতকে উঠত। সবাই তাদের তক্ষক, সান্ডা বললেও গ্রামে গঞ্জে তাদের টক্কা নামে চেনে। স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে পুরনো গাছের কোটরে তারা দিব্যি বসবাস করত। গ্রীষ্ম ও বর্ষায় প্রজনন সময় ছাড়া স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াত। নিতান্তই আর পাঁচটা বন্যপ্রাণীর মতো জীবন অতিবাহিত করে আসছিল বংশপরম্পরায়। মনুষ্য সমাজে তাদের অকষ্মাৎ এতো কদর বেড়ে যাবার রহস্য সত্যি বিষ্ময়কর!
সাঁওতাল তরুণটি প্রথম তাকে ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে সিলেটের এক ব্যবসায়ীর কাছে। ডিজিটাল স্কেলে মাথা থেকে লেজের শেষ পর্যন্ত মেপে লন্ডনি বায়ারের মুখের অবয়বে চিন্তার রেখা। তাদের কাঙ্ক্ষিত মাপের চেয়ে মাত্র আধা ইঞ্চি ও ওজনে মাত্র কয়েক গ্রাম কম দেখে মাথায় হাত। তারা সেবার ১৮শ সালের কিছু কয়েন সংগ্রহ করেও পরীক্ষা করে রিজেক্ট করে দিল। বায়ার সামনের বছর তাকে আকাশছোঁয়া দামে কিনে নেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে লন্ডন চলে গেল। ভাগ্যকে মেনে নিয়ে ব্যবসায়ী কয়েনগুলো লোকাল মার্কেটে সস্তায় বেঁচে দিলেও তাকে নিয়ে বিপাকে পড়ে। ব্যবসায়ীর ড্রাইভার ও পিয়নের সহযোগিতায় কোন রকমের অফিসের বাথরুমের পল ছাদে ঝুড়ির ভেতর আটকে রাখল। তার দ্রুত বৃদ্ধির জন্য লন্ডনি বায়ার সেদ্ধ ডিম ও হরমোন ইঞ্জেকশন দেবার কথা বললেও ব্যবসায়ী সেটা করেনি ড্রাইভারের পরামর্শে। ড্রাইভার বলল, টিকটিকি তেলাপোকা ইঁদুর ধরে খাওয়ালে নাকি একবছরের মাথায় তাদের কাঙ্ক্ষিত ওজনের হয়ে যাবে। পিয়ন ঠোঁট উল্টে বলল, কস্মিনকালেও না। এগুলা বাড়তে সময় লাগে।
কথায় আছে না বন্যরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে। যতই ওইসব ছাইপাশ খাওয়াক না কেন ক্রমশ শুকিয়ে যাচ্ছিল। ছয়মাসের মাথায় আর না হোক কয়েকশ বার তাকে মেপেছে। রাগে একেক সময় তাদের কামড়ে দিত। তাতে তারা আরো খুশি হতো। ভাবত কামড়ের বিষক্রিয়ায় তাদের কঠিন রোগ সেরে যাবে। এভাবে সময় গড়ালে ড্রাইভার ও পিয়নের লোভ বাড়তে থাকে। এরই মধ্যে ব্যবসায়ী জরুরী কাজে সিঙ্গাপুর গেলে দু’জনে মিলে লোকাল কয়েকজন বায়ারের সঙ্গে ৪লাখ টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে অপপ্রচার চালাল, খাবার দেবার সময় পিয়নকে কামড়ে লাফ দিয়ে বারান্দা দিয়ে বেরিয়ে গেছে। ব্যবসায়ী শোকে হার্ট অ্যাটাক করে হসপিটালে শুয়ে গেছিল এই পর্যন্তই সবাই জানত। এরপর বাংলাদেশের বিভিন্ন দালালের মাধ্যমে হাত বদল হতে হতে শিলি গুড়ির অদূরে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত ফুলবাড়িতে পাচারকারীদের গোপন আস্তানায় কিছুদিন অবস্থান করলে বিজিপির তাড়া খেয়ে বাংলাদেশেরই মনুমিয়ার হাত হয়ে এই গারোর পরিবারে আশ্রয় পায়। গারোরা মাতৃতান্ত্রিক বলে গারো বেটা কিছুতেই পারমিশন পাচ্ছিল না গারো বউর কাছ থেকে। গারো পরিবারটিকে মনুমিয়া বিশ্বাস করেছিল। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে গারো বউটির জন্য তার এক ধরনের অনুভূতি জন্মে গেল। একমাত্র তার চোখে দেখেছিল নির্লোভ দৃষ্টি।
গারোর বেটা চোলাই খেতে বাইরে গেলে মাচাঙ্গে বসে বউটির চালচলন অবলোকন করত। লুঙ্গি ও ব্লাউজে কানে মাকড়ি ও গলায় সোনার হাসুলি পরে মাঝারি গড়নের নাক বোচা ফর্সা বউটির প্রতি এক ধরণের আকর্ষণ তৈরি হয়। এতোদিনে জেনেছে তাদের ধর্মের নাম সাংসারেক। তাদের আদি দেবতার নাম তাতারা রাবুগা। তাদের বিশ্বাস এই দেবতার আদেশে পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে। সালজং মানে সূর্য, ছোছুম মানে চন্দ্র, গোয়ারা বা বজ্র ও মেন বা মাটি প্রভৃতি দেব-দেবীর পূজা করে। অবস্থাপন্ন টিনের ঘরটিতে সব থাকলেও কোন মানব শিশুর বিচরণ ছিল না। তারা জেনেছিল তার উপস্থিতিতে তাদের ভাগ্য খুলে যাবে। বংশ বৃদ্ধি পাবে।
৫.
গীর্জায় ২টার ঘন্টা বাজলে খ্রিষ্টান পল্লীর কাছাকাছি বাদশা উঁচু পাহাড়ের গাছের ছায়ায় বসে। এখন দিনের একদম উষ্ণলগ্নে তার সহ্য ক্ষমতা নিঃশেষ হবার জোগাড়। বাইরের তাপমাত্রা অসহনীয় মনে হলে সে বসে। মনে মনে ভাবে নিত্যদিনের স্বাভাবিক স্ট্রেস থেকে নিজেকে ডিস্ট্রাক্ট করতে প্রতিদিন এখানে বসতে পারলে মন্দ হতো না! মুক্ত পরিবেশ তাকে সাময়িক হতাশা ও দুঃখ বোধ থেকে শান্তি দিল। মাত্রাতিরিক্তভাবে জীবন থেকে পালিয়ে বেড়াতে বেড়াতে আজ সে ক্লান্ত। বংশগতভাবে সম্পদশালী হওয়া সত্ত্বেও উচ্চবিত্ত হবার স্বপ্ন তার স্বাভাবিক জীবন কেড়ে নিয়েছিল। জন্মের পর থেকে শুনে আসছিল তাদের পূর্বপুরুষের সম্পদশালী হবার গল্প। তার দাদীর মা মানে তার বড়মার সোনার কলস পাওয়ার গল্প। নির্জন দুপুরে বাড়ির পুকুরে গোসল করতে নামলে ফুসমন্তরের মতো সোনার কলসটা ভস করে ভেসে ওঠে। বড়মা খলসে মাছ ধরার মতো খপ করে ধরে আঁচল দিয়ে ঢেকে বাড়ি নিয়ে আসে। তারপর তাদের আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। যদিও কয়েক বছর পর বড়মার সেকি জলবসন্ত উঠল। কোন ডাক্তার কবিরাজ সেই রোগ সারাতে পারেনি। লোকমুখে মুখে সেই গল্প সবাই জানত। তারও অনেক পরের গল্প, ছোটচাচা বাড়ির কাছে মাছের লিজ কাটতে গেলে কোদালের সঙ্গে কিছু একটা লেগে ঠন করে শব্দ করলে চমকে ওঠে। পরদিন বাবাসহ মাটি সরিয়ে দেখে বন্দুকের বুলেটের মতো বড় একটা লোহার পিলার। বাতাসের আগে গ্রামে ছড়িয়ে পরল হাসান-হোসেন দুইভাই ম্যাগনেট পেয়েছে। এখন সাত পুরুষ সম্পদের উপর গড়াগড়ি খেলেও সম্পদ ফুরাবে না। লোক মুখে মুখরোচর কথা শুনে সবাই বাড়িতে আসতে শুরু করে। দুইভাই পিলার যক্ষের ধনের মতো আলগে রাখে। ভাবে, একদিন ইন্ডিয়া থেকে মানুষ এসে তাদের কাছ থেকে নগদ মূল্যে কিনে নিবে। এভাবে দিবাস্বপ্নে বিভোর দুইভাই সব কাজকর্ম ছেড়ে বসে দিন কাটাতে লাগল। অতপর একদিন প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের লোকেরা নামেমাত্র মূল্যে তাদের কাছ থেকে পিলারটা নিয়ে গেলে বাদশার বাবা হাসান নিজেকে সামলে নিলেও চাচা হোসেন অধিক শোকে পাগল। গ্রামের মানুষের প্রতারণার শিকার হয়েছিল তারা। সেই ঘটনার পর আর কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি। আরও শুনেছিল পূর্ব পুরুষেরা সাপের মণির আশায় দেশান্তর হয়েছিল বহু আগে। সবই শোনা গল্প। এক সময় অনুধাবন করলো বসে খেলে রাজার গোলাও ফুরিয়ে যায়। তারাও আজ সর্বস্বান্ত। ম্যাগনেটের শোকে তারা কাজে মনোনিবেশ করতে পারেনি। দিনরাত দিবাস্বপ্ন দেখত। ছোটবেলা থেকে তার রক্তের মধ্যে সেসব নেশা তাড়িয়ে বেরাত। আজকের জিনিসটা হাতে পেলে বদলে যাবে সব। ফিরে পাবে তাদের পুরানা ঐতিহ্য। বাদশার চোখেমুখে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়। মনে মনে গেয়ে ওঠে, তোরা যে যা বলিস ভাই আমার সোনার হরিণ চাই...
হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বাদশা সূর্যের অবস্থানের মধ্যে নিজের অবস্থান বুঝে নেয়। নাহ, দিনের আলো তাদের কাজ শেষে শ্রীবর্দী পৌঁছে দিতে পারবে। যদিও ঢাকা পৌছতে পৌছতে মধ্যরাত। স্পটে যাবার কথা শুনে সবাই নড়েচড়ে ওঠে। আঁকুপাকুঁ করে ইতিউতি চায়।
কবির অতি উৎসাহি হলে তারামিয়া ও মনুমিয়া চুপসে যায়। তাদের মনে অন্য রকম কিছু ছিল। মনুমিয়া দাঁড়ির ভেতর আঙুল চালিয়ে উসখুক করে।
মনুমিয়া বলে,স্যার, এতোগুলান মানুষ একলগে গেলে এলাকার মানুষ সন্ধেহ করবার পারে। এমনিতে সীমান্তে বিজিপির লোক ঘুইরা বেড়ায়। তারা খবর পাইলে আম ছালা দুইডাই যাইব। তাই কই কি আমরা এইহান থাহি, হেরা দুইজন ট্যাহা দিয়া মাল লইয়া আউক।
তারা যে সিন্ডিকেটের পাল্লায় পড়েছে ব্যপারটা বুঝতে বাদশার কিছুটা দেরি হয়ে গেছিল। পকেটের ৫লাখ টাকা হারাবার কষ্টে ব্যথিত ছিল না বরং কোটি টাকার জিনিসটা পাছে হাত ছাড়া হয়ে না যায়! নাছোড়বান্দা বাদশা যাবার সিন্ধান্তে অটুট থাকলে অগত্য সবাই যাত্রা শুরু করে। যেতে যেতে তারামিয়া ও মনুমিয়া টাকার অংশের কথা নিজেদের মধ্যে আলোচনায় ব্যস্ত হলে বাদশা স্পষ্ট বলে, আগে জিনিস।
গারোর ঘরে পৌঁছে দেখে গারোর বউ গির্জায় গিয়েছে ওয়ানগালা অনুষ্ঠানের প্রস্তুতির ব্যপারে বিশদ জানতে। বিয়ের সাত বছর পর এবারই প্রথম সে অনুষ্ঠানে নাচবে। ম্যালা প্রস্তুতি। গারো পুরুষটি ঘরের সিঁড়িতে বসে আয়েশ করে পান চিবোচ্ছিল। দৃশ্যটা কিছুটা বলদ গরুর বসে জাবর কাটার মতো। মনুমিয়াকে দেখে ক্ষণিকের জন্য প্রবল হয়ে ওঠা লোভ সুড়সুড়ি দিলেও মুহূর্তে ভোঁতা হয়ে যায়। তার বউ কিছুতে প্রাণীটা হাতছাড়া করবে না। বউটির শুদ্ধ আত্মার সত্যানুভূতি তাকে মোহগ্রস্ত করে রাখে। মনুমিয়া গারো পুরুষটির সঙ্গে তাদের ভাষায় বাতবিতণ্ডা করে কিছু একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছায় মনে হয়। এক সময় মনুমিয়া কবিরের কানের কাছে কিছু একটা বলে। কবির বাদশাকে সব খুলে বললে তার চেহারায় চোখ ধাঁধান দৃশ্যের ঘনঘটা। হঠাৎ করে তার উচ্চাশাগুলো এতো উঁচুতে উড়ে যে ভবিষ্যৎ বলতে পারে।
গারো পুরুষটি হীরা ছেড়ে কাঁচ তুলে নিল। মাত্র এক লাখ টাকার বিনিময়ে কোটি টাকার ধন হাত ছাড়া করলো। বাদশার মধ্যে কোন অনুশোচনা ছিল না। পাহাড়িদের জীবনে ১ লাখ টাকা কোটি টাকার সমতুল্য। এখন বাকী দুজনকে নিয়ে সে উদ্বিগ্ন। মনুমিয়াকে পল্লীর শুরুতে গির্জার পাশে যেখানে তাদের সঙ্গে মিলিত হয়েছিল সেখানে পৌছে এক লাখ দিতে হবে আর তারামিয়াকে সিএনজিতে তুলে দেবার সময়।
নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে মনুমিয়া টাকা পেয়ে সরে গেল। লোক চক্ষুর আড়াল করবার জন্য প্রাণীটিকে ইদুঁর ধরার খাঁচার চাইতে একটু বড় খাঁচায় ভরে পেছনে লেদার ব্যাগে নিয়ে নেয়। বাদশা ঘাড়ে ঝুলিয়ে তারামিয়াকে ফলো করতে থাকে। পাহাড়ি ঢালুর আঁকাবাঁকা পথ ধরে তারা নেমে আসছিল। বাদশার জীবনে আনন্দের ঘনঘটা ঘনিয়ে আসছিল। তার মনের গহিন থেকে আনন্দের ধারা দু’ঠোঁটের মাঝখান থেকে বেড়িয়ে শীষের ধ্বনি বাতাসকে উদ্বেলিত করে দিল।.. সে যে চমকে বেড়ায় দৃষ্টি এড়ায়, যায় না তারে বাঁধা। সে যে নাগাল পেলে পালায় ঠেলে, লাগায় চোখে ধাঁদা। আমি ছুটব পিছে মিছে পাই...
সেই সোনার হরিণ আজ তার হাতের মুঠোয়। মনের আনন্দে চিৎকার করে, আমি পেয়েছি। আমি জিতে গেছি। শোন আমার পূর্ব পুরুষেরা- আমি জিতে গেছি...
শেষ বিকেলে পুরো বনে তার কথা প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। গারো পাহাড়ের শাল, সেগুন, বাঁশ, বেতগাছের সারিতে মেঘ- রোদ্দুরের খেলা আর গারো, কোচ, হাজং ও স্থানীয় আদিবাসীদের জীবন আজ সত্যি তাকে আপ্লুত করে। ঝিনারী, কৃষ্ণাই, দুধনাই, গাননল, গনেশ্বরী ও সোমেশ্বরী নদ-নদীর বাঁকে জীববৈচিত্র ও প্রাণীর সমারোহ তার তৃষ্ণাক্ত বুকে প্রশান্তি বয়ে আনল। বিকেল যখন সন্ধ্যার দিকে ধাবমান হঠাৎ গভীর অরণ্যের ভেতর থেকে এক ধরনের আওয়াজ আসতে থাকে। মুহূর্তে মনে হলো পূর্ব পুরুষদের আনন্দের মিলিত শব্দ পাহাড়ের উপর থেকে দাবড়িয়ে নামছে। সবার একত্রিত হৃৎকম্পনে তার কান ফেটে যাবার উপক্রম। পুরো এলাকাটা মনে হচ্ছিল ছাই রঙের পদধুলিতে কেঁপে উঠছে। তারামিয়া কিছু একটা বোঝে। বলে, দ্রুত পা চালান। হাতি আইতাছে।
সবকিছু বোঝার আগে মানুষের হৈচৈ, উলুধ্বনি, হাঁড়ি-পাতিল পেটানোর শব্দে পরিবেশটা ঘনীভূত হয়ে ওঠে। মুহূর্তে তারামিয়া চিৎকার করে, ভুল পথে আইয়া পরছি.. হাতি আইতাছে বলে টাকার পোটলাটা এক প্রকার জোড় করে কবিরের হাত থেকে নিয়ে দে ছুট। কবির হতবিহ্বল হয়ে পথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে পরলে দেখে আলো-আঁধারিতে ধূসর রঙের একদল অন্ধকার তার দিকে এগিয়ে আসছে।
স্যার, দৌড় দেন। জংলি হাতির দল নেমেছে। বাদশা জীবনে এমন মুহূর্তের সম্মুখীন কোনদিন হয়নি। এটা কি প্রকৃতির প্রতিশোধ নাকি তার ভাগ্যের পরিহাস। হঠাৎ তার সামনে অতীত-বর্তমান- ভবিষ্যত থমকে গেল। অন্ধকার ভেদ করে ছুটে আসছে জঙ্গলের আজদাহা প্রাণীরা।