কিন্তু মাপা শব্দে, অর্থ আর অর্থহীনতার সূক্ষ্ম সুতোয় একইসঙ্গে থেকেছে নির্ভার আর মায়াবী।
Published : 10 Aug 2024, 07:48 PM
গড-গড
দু-বছর তিন মাসের নাতনি, সুহা, কাল নিজস্ব উচ্চারণে যা বলছিল:
গড ব্লেস দ্য মুন
অ্যান্ড গড ব্লেস মি...
(একটু থেমে)
গড-গড করে আসছে।
কে আসছে, জানতে চাইলে তার উত্তর সেই একই: গড-গড করে আসছে!
(২০ মে ২০১৬)
কবিতা, কবিতা নয়
ঝরছে বারিধারা চতুর্দোলহারা তিনটি রমণীর
পদারবিন্দরা আঘাতে ঝিমধরা--- কোথায় মন্দির?...
তখনও পঁচিশ ছুঁইনি। এমন একটি কবিতা, কুড়ি-বাইশ লাইনের হবে সম্ভবত, লেখার কয়েক দিন পর ছিঁড়ে ফেলেছিলাম। নেইও। মনে আছে আরো দু-চারটে লাইন। যেমন:
সে জানে না এসব, নীরধর কেশব প্রাচীনকালময়
চোখের কোণে কামরেখায় উদ্দাম যেমন ছিল, নয়
নয় সে তার জের, ক্লান্ত অশ্বের পৃষ্ঠে রেখে পাপ
সে-পথিকটি দূরে একলা-করা সুরে করছে রাগালাপ
ঝরছে বারিধারা চতুর্দোলহারা তিনটি রমণীর
পদারবিন্দরা আঘাতে ঝিমধরা--- কোথায় মন্দির?
কথা হল, কেন ছিঁড়েছিলাম? এটি কবিতা নয়, তাই। শুধু সাত মাত্রার হালকা দোলানিতে আর মিলের আড়ম্বরে কলেজ স্কোয়ারের জলে তরঙ্গ তোলা গেলেও যেতে পারে, সমুদ্রে যায় না। সমুদ্র আরো কিছু চায়। তবু এতদিন ধরে পঙক্তি ক-টি মনে আছে কেন? আছে সম্ভবত এই জন্য যে, যা স্মরণযোগ্য, তা-ই কবিতা নয়-- এটা প্রমাণেরও দায় যেন ওই পঙক্তি ক-টির।
(২৪ মে ২০১৬)
তেপাত্তি
কবিতালেখকরা তিন ধরণের। এক. যাঁদের ডানা আছে। দুই. যাঁরা মনে করেন, তাঁদের ডানা আছে। তিন. যাঁরা বিশ্বাস করেন-- একদিন-না-একদিন অবশ্যই তাঁদের পিঠে ডানা গজাবে।
(২ জুন ২০১৬)
বারান্দা
এত রাতে বারান্দায় বেরিয়ে দেখি, মস্ত চাঁদ! আদিম বিভ্রান্তি সর্বাঙ্গে জড়িয়ে সেই প্রাচীনা আজও প্রলুব্ধ করতে সক্ষম।
(২১ জুন ২০১৬)
মিরর
আজ বিকেলে ফাল্গুনি থেকে অটোয়। যাব পিএনবি। অটোর মিররে লেখা, লাল অক্ষরে:
"অল্প ভালোবাসায় সময় নষ্ট।"
(২৩ জুন ২০১৬)
হাই
হাই উঠছে! হাই আসলে মৃত্যুর দীর্ঘশ্বাস!
(২৩ জুন ২০১৬)
জাদু
বই যে আশ্চর্য বস্তু, আমার আড়াই বছরের নাতনি সুহা আমাকে দেখিয়েছিল প্রায় বছরখানেক আগে। এক সন্ধেয় বাড়ি ফিরে দেখি, খাটে পা ছড়িয়ে বসে একটা বই নিয়ে একমনে সে শুধু ফরফর করে পাতা ওলটাচ্ছে। বুঝলাম-- বিস্ময়কর কিছুর সন্ধান সে পেয়েছে। চৌকো, নিরেট একটা জিনিসের ভেতর এত কিছু যে থাকতে পারে, এত পাতা, সেগুলোর একটা দিক কেমন নিপুণ ভাবে আটকানো... এইসব ভাবছিল সম্ভবত। কেননা এত দ্রুত পাতাগুলো ওলটাচ্ছিল, এত দ্রুত, মনে হয় কিছু একটা আশা করছিল সুহা, পরের পাতায় কিছু একটা পাওয়ার আশা।
কী সেটা? জানি না। যেমন এতটা বয়স পেরিয়ে আসার পরও নিজেই জানি না, কী খুঁজছি পরের পৃষ্ঠায়!
(২৬ জুলাই ২০১৬)
শ্বাসকষ্ট
এ-রকমও তো হয়-- ঘাড়ে যখন কবিতার একটা মাত্র তির সবে এসে বিঁধেছে আর সেই ক্ষতে কতটা যন্ত্রণা পাওয়া উচিত তুমি ভাবছ, এমন সময় আচমকা বন্ধু-সম্পাদকের হুকুম: একটা গদ্য দাও। সাত দিনের মধ্যে।
এ হচ্ছে সেই রামধনু-রঙা ছিপছিপে ইভ আর প্রবল শক্তিমান ঈশ্বরের মাঝ-শূন্যে একখণ্ড মেঘের শ্বাসকষ্টের মতো। তোমার নিজস্ব আপেল, অন্তত সে তো এটা জানে!
(১১ আগস্ট ২০১৬)
বিকেলের ছবি
বিকেলে অটোয়। কোথাও না, যাচ্ছি করুণাময়ী। ধাবমান অটো, বাস, ট্যাক্সি, গাড়ির পর গাড়ি। সেন্ট্রাল পার্কের মাথায়, আচমকা আকাশের একটু কোনা। বিপজ্জনক নীল। একেবারে লেপে দেওয়া। ছোপ-ছোপ গাঢ়। লোত্রেকের আঁকা যেন। সেই তুলুঝ লোত্রেক-- মাংসল মেয়েদের বেষ্টনীতে অভিজাত, দুঃখী এক বামন। আর মুল্যাঁরুজ। ক্লেদ-মেশানো মদ। ছবির পর ছবি। মৃত্যুর রঙ যেগুলোতে নীল।
(১৫ আগস্ট ২০১৬)
টুলবক্স
একটা জাঁদরেল পেপার কাটার। দু-টো ঘাড়-বেঁকানো স্টেপলার-- একটা বড়ো, অন্যটা পুঁচকে। ফেবিস্টিক একটা। কাঁচি তিন সাইজের তিনটের মধ্যে একটা চীনা। একটা ছোটো স্ক্রু-ড্রাইভার। মোচনা (এটা গাঁয়ের কামার তৈরি করে দিত লোহা পিটিয়ে, কানের ময়লা বের করার জন্যে। ট্রেনে আচমকা বেচতে দেখে কেনা, কাজে না-লাগলেও সেই স্মৃতি থেকে। বাড়ি বলে কথা, একটা মোচনা থাকা তো দরকার!)। পাঁচ মিটারের স্টিলের টেপ একটা (সন্দীপনদার উপহার, সস্ত্রীক বেনারস থেকে ফিরে। কী মাপার জন্যে, কে জানে! কেউ বিশ্বাস করবে না, সঙ্গে দিয়েছিলেন বিখ্যাত ঘি আর প্যাঁড়া। ওই বেনারস থেকে)। একটা ছোট্ট বক্স, যাতে রয়েছে ছ-ধরণের ছ-টা ক্ষুদে স্ক্রু-ড্রাইভার, একটা ক্ষুদে ব্লেড (মোবাইল বা ল্যাপটপ সারাতে কখনো কাজে লাগতেও পারে ভেবে বছর দশেক আগে এরা এসেছে। এখনো কাজে লাগেনি।)। এমনকী রয়েছে একটা পেনসিল কাটারও। এসবই আজ খুলে, গুণে-গেঁথে, দেখলাম।
সশস্ত্রই বলা যায় আমাকে!
(১৭ আগস্ট ২০১৬)
সমবেত প্রতিদ্বন্দ্বী
তাঁকে যারা ভালোবাসতেন, তাঁদের মধ্যে নানা উপদলের অস্তিত্ব আজো রয়ে গেছে। এসবের ভিড়ে রয়েছে দুটি চরমপন্থী দল। এক দলের হাতে ‘সমবেত প্রতিদ্বন্দ্বী ও অন্যান্য’, অন্য দলের হাতে ‘হিরোসিমা, মাই লাভ’।
তাঁকে যারা অপছন্দ করতেন, তাঁদেরও নানা উপদল রয়েছে। রয়ে গেছেন চরমপন্থীরাও। এক দলের হাতে ‘সমবেত প্রতিদ্বন্দ্বী...’, অন্য দলের হাতে সেই ‘হিরোসিমা...’।
অথচ, সবাইকে দেখায় না। তাঁকে দেখিয়েছিল। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে। রসাতলে ফুটে-থাকা ভয়ংকর উজ্জ্বল মেরিগোল্ড ফুলটি।
কে? তাঁর স্ববিরোধিতা।
(২৩ আগস্ট ২০১৬)
আশা
প্রায় প্রতিদিনই ভাবি, পার্থ(প্রতিম কাঞ্জিলাল)-কে ফোন করতে হবে। করা দরকার। কিন্তু দরকারটা যে ঠিক কী, অনেক দিনের জমে-থাকা অজস্র দরকারের ভিড়ে কিছুতেই সেদিনেরটাকে খুঁজে পাই না। ভয় গেড়ে বসে-- কাল পাবো তো!
(৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬)
অসুখ
ঘুমোতে চাই না। তবু ঘুমিয়ে পড়তেই হবে!
(৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৬)
গাঙের ওপারে
প্রদ্যুম্নদা নেই।
হাজরা বাগান লেনে যাওয়ার পথে রেললাইন পেরোতে হত। প্রদ্যুম্নদার বাড়ি যেতে কত বার পেরিয়েওছি। ঘিঞ্জি গৃহস্থবাড়ির ফাঁকফোকর দিয়ে। পাড়ার গলির মতো। অথচ, সাউথ সেকশনের ঝাঁকাবোঝাই ট্রেন যাওয়ার ওই রেললাইন যত বার পেরিয়েছি, মনে হয়েছে— আহ্, একটা নদী পেরিয়ে এলাম!
(২ অক্টোবর ২০১৬)
কবিতার জন্ম-মৃত্যু
‘বনলতা সেন’ নয়। সবাই জানি, বাংলাভাষায় জীবনানন্দ দাশের প্রথম পরমাণুশক্তিধর কবিতা ‘বোধ’। এরকমই আরেকটি-- ‘আট বছর আগের একদিন’। কিছু আগে-পরে ‘সুরঞ্জনা’— এই আশ্চর্য কবিতাটি প্রথম দুটোর থেকে সমদূরত্বে রয়ে গেছে আজও। প্রায়-নিরলংকার ‘সুরঞ্জনা’ উপমা-উৎপ্রেক্ষাকে তুচ্ছ করেছে। বৃহদায়তন পটভূমিতে আঁকা চিত্রকল্পকে খণ্ড-টুকরো কেন, বলা যায়, নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। ভেসে আছে শিশিরসিক্ত অবয়বহীনতা। তারপর এই পৃথিবীর কয়েকটি নরম আর অতি-চেনা শব্দের সাহায্যে সংঘটিত হয়েছে সম্পূর্ণ অচেনা এক মনোজগতের অপরূপ বিস্ফোরণ।
তবু মৃত্যু আসে। মলিন হয় পার্থেননের গৌরব। আর সেই ধ্বংসের বীজ পোঁতা থাকে কোনো কোনো কবিতারই মৃত্তিকায়। কী ভাবে?
বহুবার পড়া ‘আট বছর আগের এক দিন’। আজ হঠাৎ মনে হল-- আরে, ‘অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে’? লিখেছেন জীবনানন্দ? দেখি তো। হ্যাঁ, ঠিকই। দেখে কষ্ট হল। তাঁর বিশাল আর অতুলনীয় সৌধের একটা খিলানের অংশ ভেঙে পড়ল যেন।
‘জানি-- তবু জানি
নারীর হৃদয়— প্রেম— শিশু— গৃহ— নয় সবখানি;
অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয়—
আরো-এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে
ক্লান্ত, ক্লান্ত করে;’
লাশকাটা ঘরে
সেই ক্লান্তি নাই’
এই যে বিস্ময়, যা বিপন্ন, বাংলা কবিতায় নবীন এক আগন্তুক, সে কি খেলা করতে পারে? ‘অন্তর্গত রক্তের ভিতরে’?
পালটা প্রশ্ন যদি আসে— কেন পারে না? উত্তরে বলতেই হয়, পারে না। কেননা, এ তো যে-সে খেলা নয়! এ সেই ‘আমার খেলা যখন ছিল তোমার সনে...’ বা ‘খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে’। সেই মরমী, কখনও অতি-অলৌকিক, কখনও লীলারূপী, কখনও দেহাতীত এই কাজটি আর যা-ই হোক, ‘বিপন্ন বিস্ময়’-এর পক্ষে করে ওঠা অসম্ভব। বিশেষত ‘অন্তর্গত রক্তের ভিতরে’। সে তো এসেছে আমাদের ক্লান্ত করতে। ক্লান্ত, ক্লান্ত করতে— যার পরিণতি লাশকাটা ঘর।
তবে কি লেখার এই বাঁকে চিন্তার, শব্দ-অন্বেষণের, শৈথিল্য ঘটেছিল কবির? যা-ই ঘটুক, এটা সেই বীজ, কবিতার খিলান যে ধসিয়ে দিতে পারে। এত বছর পর সত্যিই খানিকটা দিয়েছে।
অথচ, ‘বোধ’-এ তো তিনি লিখেছিলেন ‘কাজ’ শব্দটি, যা বোধ করতে পারে বলে প্রতীতি জন্মায়।
‘আলো-অন্ধকারে যাই— মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়, কোন্ এক বোধ কাজ করে,’
তবে এই কবিতাতেও সম্পূর্ণ আস্থা রাখতে পারেননি নিজের নতুন অবস্থানে। প্রথম পঙক্তির যুদ্ধোত্তর জটিল ‘মাথা’ থেকে চতুর্থ পঙক্তিতে গিয়েই উনিশ শতকীয় হৃদয়ের শরণাপন্ন হয়েছেন কবি। সেই উনিশ শতক, যেখানে স্বপ্ন শান্তি ভালোবাসা বিকশিত হতে পারার সম্ভাবনা দেখেছিল মানুষ। হয়তো ভুল ছিল দেখায়। তবু, সেই একই আশ্রয়ে বোধ? যে-বোধ কবিরও অনেকটা অচেনা? কেননা, মনে রাখতেই হচ্ছে, শুধু বোধ নয়, তিনি লিখছেন ‘কোন্ এক বোধ’।
‘স্বপ্ন নয়-- শান্তি নয়—ভালোবাসা নয়
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়;’
হৃদয়ের মাঝে কোনো চিন্তার বা বোধের জন্ম হতে পারে না। হৃদয়ের চিন্তাশক্তি নেই। তার কাজ শরীরের রক্ত পরিশুদ্ধ করা এবং সেই পরিশুদ্ধ রক্ত শরীরে সঞ্চালন করা। চিন্তার আঁতুড়ঘর এক ও অদ্বিতীয় মাথা। মস্তিষ্ক।
জানি না, হয়তো-বা এমনই সব পিছুটানের কারণেই কবিতার ক্রমমৃত্যু হয় এবং হবে!
(৬ অক্টোবর ২০১৬)
ভাগীরথী
জনৈক শুভার্থী বলেছিলেন— শনিকে সন্তুষ্ট রাখুন। রোজ সকালে সূর্যপ্রণামটা অন্তত করুন। এটা আপনার দরকার। তাঁর সুপরামর্শ ভুলিনি। প্রথম কাপ চা শেষ করে রোজ সকালে আমি নিষ্ঠাসহ একটি ভাগীরথী বিড়ি ধরাই।
(২৩ অক্টোবর ২০১৬)
ঘুমের ভূত
রাত বাড়লে কী হয়? কী আবার হবে, আরও বাড়তে থাকে। ঘুমকে চেপেচুপে একেবারে ছোট্ট করে দেয়। এইটুকু। তারপর সেই সর্ষেদানার ভেতর ঘুমের ভূত হয়ে সারা দিন ঘুরে বেড়াতে হয়।
(৭ নভেম্বর ২০১৬)
ডিজিটাল ইন্ডিয়া
প্রতিটি দিনের মতো আজকের দিনটারও একটা পরিচয় আছে।
ছোটোবেলায় দেখেছি, সকালে দোকান খুলে ধূপজল দিত ভটচাযকাকা। জ্বলন্ত ধূপগুচ্ছহাতে করজোড়ে প্রণাম করত প্রথমে পুবে, পরে ঘুরে গিয়ে পশ্চিমে। সেইসঙ্গে সুধীরকাকা দিনের খাতা খুলে এককোণে লিখত ‘শ্রীশ্রী দুর্গামাতা সহায়’। ছোটো করে। তারপর পাতার ওপরের দিকে লিখত ‘এলাহী ভরসা’। মাথায় দীর্ঘ ঈকারের ছাতাটি না-থাকলে এলাহির ভরসা যদি না-মেলে!
আজকের দিনটি হলে তার নীচে সুধীরকাকা ধরে-ধরে লিখত—
২৬শে কার্তিক, শনিবার।
সন ১৪২৩ সাল।
ইং ১২ নভেম্বর, ২০১৬ খ্রিঃ।
এসব স্মৃতিকথা। কয়েক হাজার বছরের ইতিহাস ঘাঁটলে দিনটা সম্বন্ধে নিশ্চয় জানা যাবে নানা চমকপ্রদ তথ্য। তবু, দিনটা কিন্তু বছরের যে-কোনো একটা দিনের মতো। কেননা, অন্যান্য দিনের মতোই হয়তো বহু বিখ্যাত মানুষের জন্ম অথবা মৃত্যু হয়েছে আজ। দুনিয়ার কোথাও নিশ্চয় পালিত হচ্ছে দিনটি। যেমন আজ। কত ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটছে, অন্য দিনের মতোই। পৃথিবীর কোনো প্রান্তে কোনো কবির কি জন্ম হয়েছিল আজকের দিনে? আজ হবে? জানি না।
দিনটা শুরু করেছিলাম ঠিক এইরকম ভাবে। কিছুই না-জেনে। শেষ কিন্তু তেমনটা হল না। জেনে ফেললাম জরুরি একটা তথ্য। দুপুরে গোবিন্দর দোকানে ফোন রিচার্জ করতে আর যাওয়া যাবে না। আগে বন্ধ থাকত দুপুরে। অটো ধরতে গিয়ে দেখি, আজ খোলা। গোবিন্দর জায়গায় এক মহিলা। ওর বউ। এবার থেকে দুপুরে খোলাই থাকবে। আশ্বস্ত হয়ে রিচার্জের কথা বলতেই হেসে জানাল— ও পারে না।
(১২ নভেম্বর ২০১৬)
খুব ছেলে!
এই ৫০০/১০০০ নোটের ডামাডোলে আমাদের দু-বছর আট মাসের নাতনি কী ভাবে যেন নারীবাদী হয়ে গেল!
গত দু-তিনদিন হল, 'ছেলে' শব্দটি নিন্দার্থে ব্যবহার করছে সে। আজ স্কুলের পোশাক পরানোর সময় সোয়েটার সে কিছুতেই পরবে না এবং আমিও ছাড়ব না। জোর খাটিয়ে পরাতেই বলল-- খুব ছেলে! তুমি খুব ছেলে!
(১৫ নভেম্বর ২০১৬)
শি অ্যান্ড হি
অরুন্ধতী রায়। সলমন রুশদি। ভারতীয় বংশোদ্ভূত লেখকদের মধ্যে ইংরেজি ভাষায় এই দু-জনই উপন্যাসের সেই সমুদ্রতীরে পৌঁছতে পেরেছেন, যেখানে বাদামওয়ালা, ভেলপুরি, ঘোড়া, ডেকচেয়ারে আলুলায়িত নগ্নতা, রাজনৈতিক নেতার বকরবকর, রঙবেরঙের বেলুন, বামন, ভিখিরি আর ওয়াটার স্কি-র তরঙ্গউড়ান। যেখানে পেইন্টার আর শয়তানের মুখোমুখি দেখা আর বিষাদমগ্ন মশকরা। যেখানে মহাকাব্য আর নষ্ট-হয়ে-যাওয়া জাদুশাস্ত্রের পাতা নিজেদের অবস্থান পালটে নিচ্ছে প্রতিনিয়ত। ধর্ম আর রাষ্ট্র যেখানে তেলচিটে বালিশের তুলোর ভেতরে ঘাপটি মেরে থেকে উপন্যাসকে দিয়েছে সেই তর্কে-ভরা প্রাণ, যার বিয়োগের পরও জয়ী আর পরাজিতজনের দ্বন্দ্ব থামে না।
(১৬ নভেম্বর ২০১৬)
অনুপস্থিতির দিকে
পরলোকগমন করেছেন কিনা আমরা কেউ জানি না (বলতে চাইছি, করেননি।)। আমাদের শ্রদ্ধেয় কবি আলোক সরকার, আলোকদা, গতকাল প্রয়াত হয়েছেন। ১৯৩১-এ জন্ম। প্রয়াণ ১৮ নভেম্বর ২০১৬। এমন এক কবি, যাঁর কবিতা ভাষা-ব্যবহারে আর সংস্কৃতিবোধে সম্পূর্ণ স্বদেশীয়।
তাঁর কবিতা শুরু হয় এইরকমই ঘরোয়া ভাবে---
'শোনো জবাফুল
তোমার মাটি সরস আছে তো
তোমার গায়ে
রোদ্দুরের কাপড় আছে তো
তোমার জন্যে আমাদের খুব
ভাবনা হয়'।
কোনো সহৃদয় প্রতিবেশী যেন, এমনই সরল ভাষায় শুরু হয় অন্তরঙ্গ কথোপকথন। সরল, তবে আপাতসরল। কেননা, পরে তিনি যেসব উপমা, চিত্রকল্প ব্যবহার করেন, সেসবই যেতে চায় শূন্যের দিকে। বলতেই হয়, তাঁর কবিতার যাত্রা মূলত অনুপস্থিতির দিকে। আলোক সরকারের কবিতা রূপ এবং রঙকে অস্বীকার না-করেও এ-সবের বিরুদ্ধে নীরব প্রতিবাদে ধ্বনিত। তাঁর বর্ণিত রঙ বিবর্ণতাকে নয়, প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে রঙের অনুপস্থিতিকে। তেমনই, রূপের অনুপস্থিতিকেও। এইদিক থেকেই শুধু নয়, সর্বদিক বিচারে বাংলা কাব্যজগতে তিনি ব্যতিক্রমী এক কবি। মনে পড়ে আলোক সরকারের প্রথম কবিতাগ্রন্থটির কথা, যেটির নাম ছিল 'উতলনির্জন' (১৯৫০)। তারপর প্রায় তিরিশটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর কবিতারও বিবর্তন হয়েছে। কিন্তু মাপা শব্দে, অর্থ আর অর্থহীনতার সূক্ষ্ম সুতোয় একইসঙ্গে থেকেছে নির্ভার আর মায়াবী। 'যা কিছু অর্জন/ সবই অভাবের প্রেক্ষিতে অর্জন।' ('আশ্রয়ের বহির্গৃহ', ২০০৮)-- এমন আশ্চর্য পঙক্তি তিনিই লেখেন, প্রকৃতিকে যিনি অনির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে দেখতে সক্ষম। সেই সক্ষমতার প্রকাশ আমরা দেখি তাঁর ছোটগল্পে, উপন্যাসেও। তাঁর আত্মজীবনী 'জ্বালানী কাঠ, জ্বলো' এবং 'আমার কবিতাজীবন' পাঠও এক অভিজ্ঞতা। অশীতিপর বয়সে তিনি যখন লিখেছেন 'যৌবন' নামের কবিতা, সেটি শুরু হয়েছে এইভাবে--- 'এই যে কোথাও যাচ্ছি না/ তা তোমার দিকে যাওয়া।' এই স্থিরতায় চরম অস্থির পৃথিবীর কেন্দ্রে আজ ঘুরপাক খায় 'আমাদের দৌড় আর/ সেই হাসি', যা 'পথের দু-প্রান্তকেই/ অবান্তর করছে।'
তাঁকে নমস্কার।
(১৯ নভেম্বর ২০১৬)
তেত্তিরিশ বছর আগে-পরে
কৃপণ হিসেবে কিঞ্চিৎ খ্যাতি ছিল তাঁর। কিন্তু একবার কোনোভাবে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি অব্দি পৌঁছে গেলে খ্যাতিটি ধসে পড়তে সময় লাগত না।
সে-ছিল এক রবিবার। ১৯৮৩। বরানগরে কাশীনাথ দত্ত রোডে যাওয়ার কথা। যত দূর মনে পড়ে, বাড়িটার নম্বর ছিল ৪৭। দক্ষিণখোলা দোতলায় উঠতেই তিনি। সকালবেলা। তবু মুখের কোথাও আবছা বলিরেখার মতো বিষণ্ণতা, যা ছিল তাঁর একান্ত সৌন্দর্য। সেই বিষণ্ণতা সরিয়ে সরব আহ্বান— এসো, এসো।
বৌদি রান্নাঘরে— তখনো বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারে কিচেন শব্দটি কচকচ করেনি— কিছু-একটা করছেন। ‘দ্যাখো, কে এসেছে’ বলে টেনে নিয়ে গেলেন সেই দরজায়, যার উলটোদিকে মুখ করে বৌদি ব্যস্ত। আমাকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে ছড়ানো দু-হাতে প্রকাণ্ড এক বেলুনের আয়তন দেখালেন তিনি— ‘বিরাট কবি। রোববার বলে কথা। লুচি-ফুচি তো খাওয়ানো উচিত।’
বলা বাহুল্য, রিনাবৌদি লুচি ভাজারই আয়োজন করছিলেন।
যে-ঘরে আমরা বসি, তার পুবের দেওয়ালে পেরেকে একটা সাদা কাগজ লটকানো। ফ্যানের হাওয়ায় উড়ছে। উড়ছে পাতাজোড়া লেখা—
‘যদি মনে পড়ে, আর বাড়ি ফিরব না গো।’
জিজ্ঞেস করায় তাঁর মুচকি হাসি-সহ (সবাই জানেন, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের সে-হাসিতে কী-কী মেশানো থাকত!) উত্তর—‘ওসব রাতের কথা। ছাড়ো।‘
সেটা কিন্তু সাতসকাল। কেননা তারপর তাঁরই কথামতো আমি যাব কাশীপুরে, গৌরকিশোর ঘোষের বাড়ি। সে-অন্য প্রসঙ্গ।
প্রাতর্ভোজন হিসেবে সেটা ছিল ভূরিভোজ। যাকে বলে ফুল কোর্স। অবশ্যই বাঙালি মতে।
তারপর বেশ কয়েক বছর একসঙ্গে কাজ করার সূত্রে প্রতিদিনই কথা বা দেখা হয়েছে। যেমন আমার, তাঁর একটা-দুটো উক্তি বা তাৎক্ষণিক শব্দ ব্যবহার অনেকেরই কোনো-কোনো দিনকে, সেই দৃশ্যকে সেদিনের সব ঘটনার জঞ্জাল ঝেঁটিয়ে হীরকসম্মান দিয়েছে।
শেষ আড্ডার স্থানটি ছিল চেতলায়। তখন তাঁর কেমো-বিরতি চলছে। অনেকটা ভালো আছেন। সুস্থই বলা যায়। এক রোববার নেমতন্ন। চেতলার বাড়িতে, মানে ছোট্ট ফ্ল্যাটে। যতক্ষণ ছিলাম, অসুখ বিষয়ে আমরা টুঁ-শব্দ করিনি। একবার জানতে চাই— নীচে এখন নামেন কিনা।
উত্তর ছিল— ‘তোমার বৌদির তো একটাই ছিপ। বঁড়শিতে চারা গেঁথে সেটাই নীচে নামিয়ে দেয়। আর আমি বাজার থেকে আলু, ধোপাবাড়ি থেকে থাকথাক জামাকাপড় নিয়ে উঠে আসি। ওই যে-সিঁড়িটা বেয়ে তুমি এসেছ।‘
খেতে বসে থালার পাশে ব্যঞ্জনের বৃত্ত দেখে স্তম্ভিত। কাল ভোরে কি আমার ফাঁসির দিন পাকা? কেউ বলেনি তো! নাহলে উটকো একজনের জন্যে কেন এত আয়োজন? প্রতিটি পাত্রে বৌদির শ্রম আর দীর্ঘদিনের চর্চার চিহ্ন দেখে মাথা হেঁট। মিথ্যে বলব না-- খুব গোপনে ভাবছিলাম, এ কি আপ্যায়ন নাকি অপমান? আসলে অবিশ্বাস্য দৃশ্যের মুখোমুখি হলে দুর্বলচিত্তের যা হয়, আমার তখন সেই অবস্থা। না হলে রিনাবৌদির মতো চমৎকার আর অভিজাত মনের অধিকারিণীর আর সন্দীপনদার মতো সংবেদনশীল (ভেবেচিন্তেই শব্দটি ব্যবহার করেছি।) এবং দুরারোগ্য একজনের আন্তরিকতা সম্বন্ধে সংশয় জন্মায় কী করে?
পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে বলতেই পারি, সেদিন ধ্যাদধেড়ে চেতলায়-- দর্জিপাড়া থেকে বাগবাজার পর্যন্ত-- একখণ্ড উত্তর কলকাতা জ্যান্ত হয়ে উঠেছিল। শেষ বারের মতো? অন্তত আমার ক্ষেত্রে।
একসঙ্গে খেতে বসি। যতটা সম্ভব খাওয়ায় সঙ্গ দিয়েছিলেন তিনিও। শেষে কথাবার্তা। বাংলা লেখালেখি বিষয়ে। অথচ তাঁর বুকশেলফ যেমন থাকে, প্রায় ফাঁকা। একজন লেখকের ঘরের তুলনায় সে-সব অকিঞ্চিৎকর।
ছোট্ট ঘর। হাতের নাগালে সব কিছু। কিন্তু সিঙ্গল বেড আর টেবিলের মাঝে প্রতিবন্ধক আমি। তাই টেবিলে রাখা ছোট্ট গ্লাসটা চাইলেন। জল খাবেন। গেবে-যাওয়া গ্লাসটা দিতে গিয়ে তাঁর লম্বা আঙুলগুলোর ওপর চোখ পড়ল বহু দিন পর, নিজেকে শ্বাসরুদ্ধ করতে যে-আঙুলগুলো নিজেরই গলা টিপে ধরে ছিল। আর সঙ্গে সঙ্গে মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল— আজকাল কি রুপোর গ্লাসে জল খাচ্ছেন?
তাঁর উত্তর--- গোয়েন্দার চোখ তোমার (নানা প্রসঙ্গে এই মন্তব্যটি আগেও করেছেন।)। আসলে ক-দিনই বা খাব। তাই হয়তো তোমার বৌদি বের করে দিয়েছেন।
দীর্ঘক্ষণ ছিলাম। সেই শেষ আড্ডায় একবারের জন্যেও মনে হয়নি, মৃত্যুপথযাত্রীর সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছি। কেননা, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের পক্ষে যেমন কারও পিসেমশাই মামা কাকু বা মেসোমশাই হতে পারা অসম্ভব ছিল, তেমনই কল্পনাতীত ছিল তাঁর মৃত্যু।
(২ ডিসেম্বর ২০১৬)