পাঁচ বছর আগে এক সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার পর থেকে শিল্পকর্মের কাজ থেকে বিরতিতে আছেন টিএসসি মোড়ের রাজু স্মারক ভাস্কর্যের শিল্পী।
Published : 13 Jan 2025, 11:44 AM
ছোট্ট বাসাটিই হয়ে উঠল গ্যালারি, থরে থরে সাজানো শিল্পকর্মগুলো যেন ভাস্কর শ্যামল চৌধুরীর শিল্প অনুশীলনের বহুমুখী দৃষ্টিকোণের অনন্য উপস্থাপন।
তিন দশকের বেশি সময় ধরে এই ভাস্করের তৈরি করা ৪৫টি শিল্পকর্ম নিয়ে শ্যামলীর এক বাসায় চলছে একক প্রদর্শনী ‘অবয়বের প্রতিধ্বনি’ । শিল্পীর ১২টি ভাস্কর্য আর ৩৩টি ড্রইং স্থান পেয়েছে সেখানে।
গত শুক্রবার প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন শিল্পী মনিরুল ইসলাম এবং গবেষক মফিদুল হক। মঙ্গলবার পর্যন্ত দুপুর ২টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা এ প্রদর্শনী খোলা থাকবে।
শ্যামল চৌধুরীর এটি দ্বিতীয় একক প্রদর্শনী। নেত্রকোণায় জন্ম নেওয়া এই শিল্পীর প্রথম একক প্রদর্শনী হয়েছিল ১৯৯৮ সালে লন্ডনে।
রোববার সন্ধ্যায় প্রদর্শনীর স্থানে প্রবেশ করতেই দেখা হল দেশের খ্যাতিমান ভাস্কর হামিদুজ্জামান খানের সঙ্গে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “শ্যামল তো আমার ছাত্র, তরুণদের মধ্যে প্রথম দিকেই যারা নজর কেড়েছে শ্যামল তাদের অন্যতম। আমাদের দেশে ভাস্কর্য শিল্পে যাদের হাত ধরে উন্নতি হয়েছে, শ্যামল তাদের অগ্রগণ্য। শ্যামলের কাজ নানান জায়গায় আছে, সে তার কাজের মধ্য দিয়েই আমাদের কাছে স্মরণীয়।”
প্রদর্শনী ঘুরে দেখা যায়, ফাইবার গ্লাসে করা 'কাউবয়' নামের একটি শিল্পকর্মে গরুর পিঠে হেলান দিয়ে রাখাল বালক বাঁশি বাজাচ্ছে।
অন্যদিকে 'ওল্ডম্যান এন্ড থিংকার' নামের আরেকটি শিল্পকর্মে পাশাপাশি দুই বৃদ্ধ মাথা নিচু করে চিন্তামগ্ন হয়ে বসে আছেন। জীবনের নানা রূপ যেন এসে মিশেছে এই প্রদর্শনীতে।
শ্যামল চৌধুরীর ছোট মেয়ে ফ্রিলান্স আর্টিস্ট রূপকল্পা চৌধুরী এ প্রদর্শনীর কিউরেটর। তিনি কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্য বিভাগ থেকে স্নাতক করেছেন।
রূপকল্পা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দর্শকদের গৃহস্থালীর পরিবেশে আত্মীয়তার বোধ সৃষ্টি এবং শ্যামল চৌধুরীর কাজের সাথে আরও ব্যক্তিগত ও গভীরভাবে সংযুক্ত হতে দেওয়ার প্রয়াস এই প্রদর্শনী।”
শ্যামল চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে ১৯৮৬ সালে ভাস্কর্যে প্রথম বিভাগে প্রথম হয়ে স্নাতকোত্তর শেষ করেন। পরে যুক্তরাজ্যের গ্লুচেস্টারশায়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক শিল্পী হিসেবে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেন।
চার বছরের বেশি সময় ধরে বাসাতেই নিভৃত জীবন কাটছে শ্যামল চৌধুরীর। ২০২০ সালে ঢাকার অদূরে রাজেন্দ্রপুরে এক সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার পর থেকে তিনি শিল্পকর্মের কাজ থেকে বিরতিতে আছেন।
শিল্পীকে উৎসাহিত করার জন্য তার পরিবারের সদস্যরা আয়োজন করেছেন ‘অবয়বের প্রতিধ্বনি’ শিরোনামের এই প্রদর্শনী। বড় মেয়ে কল্পপ্রিয়া চৌধুরীর বাসায় এ আয়োজন করা হয়েছে। স্ত্রী মণি চৌধুরী এবং দুই মেয়েই মূলত এই আয়োজন করেছেন।
হামিদুজ্জামান খানের সঙ্গে যখন আলাপ হচ্ছিল তখন পাশেই ছিলেন শ্যামল চৌধুরী। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমার মেয়েরা এই প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে, এতে আমি অনেক খুশি। সড়ক দুর্ঘটনার পর থেকে তো এখনো আমি কাজ করতে পারি না।”
রূপকল্পা চৌধুরী বলেন, “এই প্রদর্শনীটি মূলত বাবার শিল্পমনের প্রকাশ এবং তার কাজের প্রতি ভালবাসার জন্য উৎসর্গীকৃত একটি জীবনের উদযাপন। তার জীবন ও শিল্পকর্মের একটি অন্তরঙ্গ যাত্রা, যিনি একজন ভাস্কর এবং যার স্মারক ভাস্কর্যগুলি বাংলাদেশের দৃশ্যপটকে অমূল্য সম্পদে পরিণত করেছে।”
ভাস্কর শ্যামল চৌধুরীর নাম এলেই মনের দৃশ্যপটে ভেসে উঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মোড়ের রাজু স্মারক ভাস্কর্যের কথা। তার এ শিল্পকর্মটি হয়ে উঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
কেবল রাজু ভাস্কর্য নয়, সারা দেশেই তার বেশ কিছু শিল্পকর্ম অনন্য অবস্থান তৈরি করে আছে। ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বিজয় ৭১’, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্বাধীনতা চত্বর’, নারায়াণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের লোক ও কারুশিল্প জাদুঘরে ‘শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের আবক্ষ ভাস্কর্য’, জাতীয় গৃহায়ণ কার্যালয়ের ‘ভাস্কর্য’ এবং বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের প্রবেশদ্বার এই শিল্পীর করা ‘টেরাকোটা’ দেশের শিল্পকলার চর্চায় অনন্য সংযোজন।
রূপকল্পা চৌধুরী বলেন, “বাবার এই প্রদর্শনী ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা যোগাবে। আমরা এবার ছোট পরিসরে আয়োজনটি করেছি। পরে আরো বড় পরিসরে এরকম প্রদর্শনী করার ইচ্ছা আছে।”