স্তম্ভিত বিশ্বের বিস্ময় কাটেনি, রাবোভো গ্রামের মাঠে ছড়িয়ে থাকা এমএইচ১৭ এর ধ্বংসস্তূপ এখনো বলতে পারেনি কেন ঝরে গেল তিনশ প্রাণ।
Published : 19 Jul 2014, 02:55 AM
বিমান বিধ্বস্ত হয়ে প্রাণহানিতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শোক
বিমান ভূপাতিত: রাশিয়ার সমালোচনা ওবামার
কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে ক্ষোভ আহাজারি কান্না
তবে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ আর তদন্তের দাবির মধ্য দিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের টানাপড়েন নিয়েছে নতুন মোড়।
মালয়েশীয় এয়ারলাইন্সের ওই উড়োজাহাজ ‘ভূপাতিত’ হয়ে ২৯৮ জনের প্রাণহানির জন্য একে অপরকে দায়ী করছে ইউক্রেইন ও রুশপন্থী বিদ্রোহীরা। এমনকি বিধ্বস্ত বিমানের ‘ব্ল্যাকবক্স’ নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারেও রাশিয়া ও ইউক্রেইন কর্তৃপক্ষ পাল্টাপাল্টি দোষারোপ করছে।
এরইমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন,পূর্ব ইউক্রেইনের রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রে মালয়েশিয়ার ওই উড়োজাহাজ ভূপাতিত হয়েছে।
মস্কোর বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের আধুনিক অস্ত্র সরবরাহ করার অভিযোগ তুলে তাদের সমর্থন করা থেকে বিরত থাকার জন্য রাশিয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ওবামা। অন্যদিকে বিমান ভূপাতিত হওয়ার জন্য ইউক্রেইনকে দায়ী করেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
বিদ্রোহীদের থেকে সমর্থন প্রত্যাহার না করলে মস্কোর ওপর আরো কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য প্রস্তুত রয়েছেন বলেও জানান ওবামা।
বিমান ভূপাতিত্বের ঘটনায় ইউরোপই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে ওবামা দৃশ্যত মস্কোর উপর ওয়াশিংটন যে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে সে পথে এগোনোর জন্য ইউরোপকে উৎসাহ যুগিয়েছেন বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
তবে জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল বলেছেন, ওই বিমানে আসলে কী ঘটেছিল তা স্পষ্ট হওয়ার আগে মস্কোর উপর আরো নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না।
যুক্তরাজ্য বলেছে, মস্কোর ওপর আরো নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা বিবেচনার আগে জাতিসংঘের নেতৃত্বে তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত ঘটনা বের করতে হবে।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা কাউন্সিলেও বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনার ‘নিরপেক্ষ’ আন্তর্জাতিক তদন্ত দাবি করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার রাশিয়ার সীমান্তবর্তী পূর্ব ইউক্রেইনের দোনেস্ক শহরের কাছের রাবোভো গ্রামে বোয়িং নির্মিত ৭৭৭ মডেলের এমএইচ১৭ বিধ্বস্ত হলে ২৯৮ জন আরোহীর সবাই নিহত হন বলে উদ্ধার কর্মীরা জানিয়েছেন।
বৃহস্পতিবারকে নেদারল্যান্ডসের জন্য ‘কালো দিন’ বলে অভিহিত করেছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী মার্ক রাট।
এদিকে শুক্রবার মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর বিমানবন্দর ভারী হয়ে ওঠে বিধ্বস্ত উড়োজাহাজের নিহত যাত্রীদের স্বজনদের আহাজারিতে।
মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের তথ্য অনুযায়ী, ওই ফ্লাইটে ১৫ জন ক্রুসহ মালয়েশিয়ার ৪৪ জন নাগরিক ছিলেন।
এছাড়া অস্ট্রেলিয়ার ২৭ জন, ইন্দোনেশিয়ার ১২ জন এবং নয় জন ব্রিটেনের নাগরিক ছিলেন।
ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে বিমান বিধ্বস্তে প্রাণহানির এ ঘটনাকে ‘অবর্ণনীয় অপরাধ’ হিসেবে মন্তব্য করেছেন অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী টনি অ্যাবোট।
এদিকে ঘটনা খতিয়ে দেখতে রুশপন্থী বিদ্রোহীদের ‘সম্মতি’ নিয়ে শুক্রবার ঘটনাস্থলে পৌঁছেছেন অর্গানাইজেশন ফর দ্য সিকিউরিটি অ্যান্ড কো-অপারেশন ইন ইউরোপের (ওএসসিই) তদন্ত দলের সদস্যরা।
এ কাজে তদন্ত দল ও ইউক্রেইন কর্তৃপক্ষকে সহযোগিতা করার জন্য ওই এলাকার বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ওএসসিই।
তবে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার এলাকা আন্তর্জাতিকভাবে ইউক্রেইনের অন্তর্ভুক্ত হলেও সেখানে বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণ থাকায় তদন্তে সমস্যা দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন ওসএসসিই-এর চেয়ারম্যান ব্লেস।
বিধ্বস্ত বিমানের নিহত যাত্রীদের সনাক্ত করতে মালয়েশিয়া থেকে একটি দল ইউক্রেইনের রাজধানী কিয়েভ পৌঁছেছে।
ওই প্রতিনিধি দলে মালয়েশিয়ার সামরিক বাহিনীর সদস্য, পুলিশের ফরেনসিক বিভাগের বিশেষজ্ঞ, সিভিল এভিয়েশনের কর্মকর্তা, দুর্যোগ মোকাবেলা বিভাগের কর্মকর্তা, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা রয়েছেন।
১৪৯ সদস্যের ওই প্রতিনিধি দল মূলত মৃতদেহ শনাক্ত করবে বলে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর বিষয়ক মন্ত্রী দাতুক সেরি সাহিদান জানিয়েছেন।
মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের ওই উড়োজাহাজ ভূপাতিত হওয়ার ঘটনা বিপর্যয় ডেকে এনেছে বিশ্বের এইডস গবেষণা অঙ্গণেও। ওই ফ্লাইটে শীর্ষ কয়েকজন এইডস বিশেষজ্ঞসহ ১০০ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল ছিল, যারা এ বছরের এইডস সম্মেলনে যোগ দিতে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন যাচ্ছিলেন।
ওই বিমানে আন্তজার্তিক খ্যাতিসম্পন্ন ডাচ এইডস বিশেষজ্ঞ ইওপ লাঙ্গেসহ ডজন খানেক এইডস বিশেষজ্ঞ নিহত হয়েছেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ইওপকে এইডস চিকিৎসার একজন পথিকৃত ধরা হয়। তিনি ৩০ বছর ধরে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর হাতের নাগালে এইডস চিকিৎসা পৌঁছে দেয়ার ব্যাপারে কাজ করে আসছিলেন।
জাতিংসংঘের এইডস প্রোগ্রামের (ইউএনএইডস) পক্ষ আশঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়েছে, “কিছু সেরা বিশেষজ্ঞ, স্বাস্থ্যসেবা কর্মী এবং স্বাস্থ্য আন্দোলনকারীকে আমরা বিমানটির সঙ্গে হারিয়েছি।”
ওই ঘটনার পর সতর্কতার অংশ হিসাবে দেশের পূর্বাঞ্চলে যে কোনো ধরনের বিমান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ইউক্রেইন কর্তৃপক্ষ।
এরইমধ্যে দুর্ঘটনাস্থলের আকাশ পথ ব্যবহার না করে বেশ কিছু এয়ারলাইন্স নিজেদের রুট পরিবর্তন করেছে বলে জানিয়েছে ইউক্রেইনের ট্রান্সপোর্ট বিভাগ।
অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্স
মাত্র চার মাসের মাথায় বিমানের দুটি বিপর্যয়কর ঘটনায় ভবিষ্যত নিয়ে আশঙ্কায় পড়েছে মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্স।
এমএইচ-১৭ বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার খবরে মালয়েশিয়ার স্টক এক্সচেঞ্জে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার পড়ে যায় ১১ শতাংশ।
এর আগে গত ৮ মার্চ মালয়েশিয়া এয়ারলাইনসের আরেকটি বোয়িং ৭৭৭ উড়োজাহাজ ২৩৯ জন যাত্রী নিয়ে মাঝ আকাশে উধাও হয়ে যায়। ব্যাপক আন্তর্জাতিক চেষ্টার পরও বিমানটির কোনো হদিস এখনো পাওয়া যায়নি।
মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের অর্থায়নকারী ডিভিবি ব্যাংক-এর এভিয়েশন বিভাগের প্রধান বার্টান্ড গ্রাভোস্কি বলেন, “এটি পুরোপুরি কাকতালীয়। কিন্তু ইতিহাসে এমন আগে কখনো হয়নি যে একই এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হারিয়ে যাওয়ার কয়েকমাস পরেই এমন একটি ঘটনা ঘটেছে।“
মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সকে বাঁচাতে দেশটির সরকারের সবোর্চ্চ সহযোগিতা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এদিকে বিমান বিধ্বস্তের খবরে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে রাশিয়া ও ইউক্রেইনের রাজনৈতিক সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টির আশঙ্কায় শুক্রবার এশিয়ার বেশিরবাগ শেয়ার বাজারেই দর পড়েছে।