মন্ত্রীর কথা বলায় ‘মারধর হয়েছিল চতুর্থ দফায়’

বগুড়ার হাসপাতালে তর্কাতর্কির ঘটনার পর প্রথম এবং প্রতিবাদ করায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফায় শিক্ষানবিশ চিকিৎসকদের মারধরের শিকার হয়েছিলেন বলে সিরাজগঞ্জের সেই রোগীর স্বজনদের অভিযোগ।

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধিবগুড়া ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 Feb 2017, 12:19 PM
Updated : 22 Feb 2017, 01:27 PM

তারা বলছেন, এরপর স্বাস্থ‌্যমন্ত্রীর কাছে নালিশ দেওয়ার হুমকি দেওয়ায় চতুর্থ দফায় মারধর করেছিলেন চিকিৎসকরা। মারধরের পাশাপাশি সূচ ফুটিয়ে দেওয়া হয় বলে তার অভিযোগ।

বুধবার সকালে সিরাজগঞ্জ সদরের কোনাগাতি গ্রামে আলাউদ্দিন সরকারের বাড়ি গিয়ে দুই নারীসহ ছয়জনকে নানা রকম নির্যাতনের বর্ণনা পাওয়া যায়।

হৃদরোগে আক্রান্ত আলাউদ্দিনকে (৬২) শনিবার রাতে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। বেড না পেয়ে তার ঠাঁই হয় মেঝেতে। তার শ্বাসকষ্টও ছিল।

তার স্বজনরা বলেন, মাথার ওপর ফ্যান চলায় কষ্ট বেশি হওয়ায় তার ছেলে রউফ ফ্যান বন্ধ করতে চেয়েছিলেন। এ নিয়ে এক শিক্ষানবিশ চিকিৎসকের কথাকাটাকাটির জেরে তাকে মারধর করা হয়।

রউফ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রথমে আসিফ নামে এক চিকিৎসক আমাকে কিলঘুষি মারেন এবং ১০০ বার কানধরিয়ে উঠবস করান। পরে পরিচালকের কক্ষে নিয়ে মারধর করে আটেকে রাখা হয় এবং আবার মারধর করা হয়।”

তাকে উদ্ধার করতে যাওয়ায় পুলিশও হামলার শিকার হয় বলে জানান হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ টিএসআই শাহ আলম।

 

পুলিশ আসায় চিকিৎসকরা উত্তেজিত হয়ে আবার রউফকে মারধর করা এবং তাকে তিন দফা মারধর করা হয় বলে রউফের অভিযোগ।

এ খবর ছড়িয়ে পড়লে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সমঝোতার জন্য বৈঠক বসে পরিচালকের কক্ষে।

রউফ বলেন, “বৈঠকে আমার বোন বিনা ও সেতু বলেন, ‘আপনারা যদি সুষ্ঠু বিচার না করেন তাহলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের কাছে নালিশ করা হবে।’ এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে আমাকে, বোন বিনা ও সেতুকে বেধড়ক কিলঘুষি ও লাথি মারতে থাকেন ডাক্তাররা।

“এ সময় তারা বলতে থাকেন, ‘দেখি স্বাস্থ্যমন্ত্রী তোদের কেমনে বাঁচায়। তোদের বাড়ি সিরাজগঞ্জ, তাই তোরা মন্ত্রীর ভয় দেখাস’।”

এই পরিবারের আরও তিনজনকেও মারধরে অভিযোগ এসেছে।

ঘটনার দিন সোমবার ধারণ করা ভিডিওতে ইন্টার্ন চিকিৎসক আসিফ, আল মামুন রাব্বি, কুতুব উদ্দিনসহ অন্যদের দেখা যাচ্ছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, মারধরের শিকার হচ্ছেন রউফের বোন বিনা ও সেতু।

আলাউদ্দিনের ভাগ্নে মাসুম বলেন, “আমার ভগ্নিপতি মালেককে মারধর ছাড়াও তার শরীরের কয়েক জায়গায় সুচ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, যেখানে এখনও ব্যথা হচ্ছে। ভাই কিবরিয়ার মাথা কেটে গেছে। ডাক্তারদের মারধরে আমার শরীরের বিভিন্ন জায়গা ফুলে গেছে।”

অসুস্থ আলাউদ্দিনের কাছে সার্বক্ষণিকভাবে ছিলেন পুত্রবধূ হাসিনা খাতুন।

তিনি বলেন, “রউফকে মারধরের পর যখন অন্য রুমে নিয়ে আটকে রাখা হয় তখন হাসপাতালে থাকা ননদজামাই মালেক, দেবর মাসুম, আরেক দেবর কিবরিয়া বিষয়টির প্রতিবাদ করায় তাদেরও মারধর করা হয়।

“এ সময় মেঝেতে থাকা অসুস্থ শ্বশুরকে টপকে চিকিৎসকরাও যাতায়াত শুরু করলে শ্বশুর আহত হন। ময়লায় ভরে যায় তার বিছানা। তার পাঁজরেও লাথি লাগে।”

এই ঘটনাটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ‌্যমে তুমুল আলোচনার মধ‌্যে মঙ্গলবার সকালে রোগী আলাউদ্দিন মারা যান।

মাসুম বলেন, “সন্ধ্যায় পরিচালকের কক্ষে বৈঠকে মারধরের খবর ছড়িয়ে পড়লে ডাক্তাররা তড়িঘড়ি করে মামা আলাউদ্দিনকে আইসিইউতে নিয়ে রেখে দেন। মনে হচ্ছে তার আগেই মামার মৃত্যু হয়। আইসিইউতে নিয়ে চিকিৎসা করার নামে ডাক্তাররা নাটক করেছেন।”

আলাউদ্দিনের অপর ভাগ্নে নুরুল ইসলাম খান বলেন, “বিপদে পড়ে ওরা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নাম বলেছিল। সে কারণে আরও বেশি মারধর করা হয়েছে। এটা অন্যায়। আমরা সিরাজগঞ্জের মানুষ তার নাম তো বলতেই পারি।”

আলাউদ্দিনের ছোট ভাই শাহজাহান সরকার বলেন, “স্বাস্থ্যমন্ত্রী আমাদের কোনো আত্মীয় হন না। আমরা নৌকায় ভোট দিই। তাই হয়তো ওরা মন্ত্রীর কাছে নালিশ করার কথা বলেছিল।

“হাসপাতালে এমন ঘটনা আর যেন না ঘটে। কেউ যেন আর ডাক্তারদের দ্বারা নির্যাতিত না হয় - আমরা এমনটাই আশা করছি।”

নিহত আলাউদ্দিনের স্ত্রী শান্তি বলেন, “আমাদের তো সেই রকম কোনো মানুষ নাই। কোথায় অভিযোগ করব। কে এর বিচার করবে। আল্লাহ পাকের কাছে বলি, তিনিই যেন এর বিচার করেন।”

বুধবার দুপুরে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাসুদ আহসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হাসপাতালের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। সাত কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”

এদিকে ঘটনা তদন্তে স্বাস্থ‌্য মন্ত্রণালয়ও একটি কমিটি করেছে। তিন সদস্যের কমিটির প্রধান হচ্ছেন অতিরিক্ত সচিব হাবিবুর রহমান খান। সদস্যরা হলেন বিএমডিসির সদস্য ও বিএসএমএমইউ এর উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ডা.শারফুদ্দিন আহমেদ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. আবদুর রশিদ। কমিটিকে সরেজমিন পরিদর্শন করে পাঁচ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

এ ঘটনায় জড়িত সব শিক্ষানবিশ চিকিৎসকের ইন্টার্নশিপ বাতিলের নির্দেশ ইতোমধ‌্যে দিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম।

নির্বাচনী এলাকা কাজিপুর সফরে থাকা স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিষয়টির তদন্ত হচ্ছে। ইন্টার্ন চিকিৎসক ছাড়া আরও যারা জড়িত আছে তাদের বিরুদ্ধেও অ্যাকশন নেওয়া হবে।”