ভূমি আত্মসাত ও জালিয়াতি মামলার পলাতক আসামি সিলেটের ব্যবসায়ী রাগীব আলী ভারতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাকে ফিরিয়ে এনে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
Published : 24 Nov 2016, 05:48 PM
তারাপুর চা বাগানের দেবোত্তর সম্পত্তিতে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের মাধ্যমে হাজার কোটি টাকার ভূমি আত্মসাত ও জালিয়াতির মামলায় সিলেটের আদালতে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা হওয়ার পর গত সাড়ে তিন মাস ধরে তিনি ভারতে পালিয়ে ছিলেন।
বৃহস্পতিবার বাংলাদেশে ফেরার পথে ভারতের করিমগঞ্জ ইমিগ্রেশন পুলিশ ভিসার মেয়াদ না থাকার কারণে রাগীব আলীকে আটক করে। এরপর বিয়ানিবাজার উপজেলার সুতারকান্দি ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট দিয়ে তাকে বিজিবির কাছে হস্তান্তর করে বিএসএফ।
পরে পুলিশ রাগীব আলীকে সিলেটের অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করলে বিচারক উম্মে সরাবন তহুরা জামিন আবেদন নাকচ করে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন বলে পিপি মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ জানান।
৭৮ বছর বয়সী রাগীব আলী বেসরকারি সাউথইস্ট ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান। ওই ব্যাংকের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চা বাগান থেকে শুরু করে আর্থিক প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা ও মিডিয়াতে ছড়িয়ে আছে তার ব্যবসা।
সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, চা বাগানের ব্যবসার লাভের কিছু অংশ দান করে রাগীব আলী সিলেটে ‘দাতা’র খ্যাতি পান। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখে ‘শিক্ষানুরাগী’ নামও কুড়ান।
তারাপুর চা বাগান নিয়ে অভিযোগ ওঠার পর ১৯৯৯ সালে ভূমি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি রাগীব আলীর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। ২০০৫ সালে ভূমি মন্ত্রণালয় ভূমি মন্ত্রণালয়ের স্মারক (চিঠি) জালিয়াতি ও প্রতারণার অভিযোগে কোতোয়ালি থানায় দুটি মামলা করে।
এর বিরুদ্ধে রাগীব আলী উচ্চ আদালতে গেলে দীর্ঘদিন পর চলতি বছরের শুরুতে তার নিষ্পত্তি হয়। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ গত ১৯ জানুয়ারি রাগীব আলীর বিরুদ্ধে মামলা পুনরায় চালুর নির্দেশ দেয়। সেই সঙ্গে তারাপুর চা-বাগান দখল করে গড়ে ওঠা সব স্থাপনা ছয় মাসের মধ্যে সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়।
ওই আদেশের পর ১৫ মে চা-বাগানের বিভিন্ন স্থাপনা ছাড়াও ৩২৩ একর ভূমি সেবায়েত পঙ্কজ কুমার গুপ্তকে বুঝিয়ে দেয় জেলা প্রশাসন।
মামলা হওয়ার ১১ বছর পর সিলেটে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) অতিরিক্ত সুপার সারোয়ার জাহান গত ১০ জুলাই ওই দুই মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দেন।
এর মধ্যে ভূমি মন্ত্রণালয়ের স্মারক (চিঠি) জালিয়াতির মামলায় রাগীব আলী ও তার ছেলেকে আসামি করা হয়। আর প্রতারণা মামলায় রাগীব আলী, তারাপুর চা-বাগানের সেবায়েত পঙ্কজ কুমার গুপ্ত, রাগীব আলীর আত্মীয় মৌলভীবাজারের রাজনগরের বাসিন্দা দেওয়ান মোস্তাক মজিদ, রাগীব আলীর ছেলে আবদুল হাই, জামাতা আবদুল কাদির ও মেয়ে রুজিনা কাদিরকে আসামি করা হয়।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, ৪২২ দশমিক ৯৬ একর জমির ওপর গড়ে ওঠা তারাপুর চা-বাগান পুরোটাই দেবোত্তর সম্পত্তি। ১৯৯০ সালে ভুয়া সেবায়েত সাজিয়ে বাগানটির দখল নেন রাগীব আলী।
ওই দুই মামলায় গত ১০ আগস্ট রাগীব আলী ও তার একমাত্র ছেলে আবদুল হাইসহ ছয় জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে সিলেটের আদালত। ওই দিনই জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে সপরিবারে ভারতে পালিয়ে যান তিনি।
আসামের পুলিশ কর্মকর্তারা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ভারত প্রতিনিধিকে জানিয়েছেন, বৈধ ভিসায় সেখানে যাওয়ার পর চিকিৎসার কথা বলে হাসপাতালের কাগজপত্র দেখিয়ে প্রথমে এক মাস ও পরে ৪০ দিন মেয়াদ বাড়ান রাগীব আলী।
নভেম্বরের মাঝামাঝি সেই মেয়াদ শেষ হলে তিনি আবারও আবেদন করেন। কিন্তু তখন করিমগঞ্জ জেলা পুলিশ গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে এর বিরোধিতা করলে ভিসা আটকে যায়। পরে বাংলাদেশে যোগাযোগ করে রাগীব আলীর পালিয়ে থাকার বিষয়ে ভারতীয় পুলিশ নিশ্চিত হয়।
গত ১২ নভেম্বর ভারত থেকে বাংলাদেশে ফেরার পথে রাগীব আলীর ছেলে আব্দুল হাইকে গ্রেপ্তার করে জকিগঞ্জ ইমিগ্রেশন পুলিশ।
এরপার রাগীব আলীকে বৃহস্পতিবার সকালে একই চেকপোস্টে ভারতীয় পুলিশ আটক করে বলে সিলেটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুজ্ঞান চাকমা সাংবাদিকদের খবর দেন।
দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও পুলিশের যোগাযোগের মাধ্যমে বিকাল ৩টার দিকে সুতারকান্দি ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট দিয়ে রাগবী আলীকে বাংলাদেশের হাতে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। পরে তাকে সিলেটে নিয়ে তোলা হয় আদালতে।
সিলেটের হাকিম আদালতের পিপি মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ জানান, রাগীব আলীর আইনজীবী জামিন আবেদন করলে শুনানির পর বিচারক তা নাকচ করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। আগামী ৪ ডিসেম্বর মামলার পরবর্তী তারিখ ঠিক করে দেন তিনি।
ব্রিটিশ বাংলাদেশিদের নিয়ে প্রকাশিত বার্ষিক সাময়িকী ‘হু’জ হু’র তথ্য অনুযায়ী, ১৯৫৬ সালে ১৮ বছর বয়সে লন্ডনে যান রাগীব আলী। সেখানে শেয়ার বাজার, বীমা, আবাসন ও রেস্তোরাঁ ব্যবসা করে তিনি বিত্তশালী হন। পরে দেশে এসে ব্যবসায় হাত দেন।
সাউথইস্ট ব্যাংকের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, রাগীব আলী সিলেট টি কোম্পানি লিমিটেড, কর্ণফুলী টি কোম্পানি লিমিটেড, রাজনগর টি কোম্পানি লিমিটেডের মালিক।
ইউনিয়ন সিন্ডিকেট লিমিটেড, রাগীব আলী সিকিউরিটিজ লিমিটেড, দৈনিক সিলেটের ডাকে তার মালিকানা রয়েছে। ইংরেজি দৈনিক ফিনানশিয়াল এক্সপ্রেসের পর্ষদেও তার নাম রয়েছে।
সিলেটের রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, লিডিং ইউনিভার্সিটি ও ঢাকার ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান তিনি। এক সময় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ডেও চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি।
নিজের, স্ত্রীর এবং মায়ের নামে সিলেটের বিভিন্ন স্থানে আরও অনেক স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন রাগীব আলী। মৌলভীবাজার চেম্বার অব কমার্সের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তিনি।