রাগীব আলীমুক্ত হচ্ছে তারাপুর চা বাগান

জালিয়াতির মাধ্যমে দীর্ঘদিন ‘শিল্পপতি’ রাগীব আলীর দখল থাকা সিলেটের তারাপুর চা বাগান ফিরিয়ে নেওয়ার অভিযান শুরু করেছে জেলা প্রশাসন।

সিলেট প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 May 2016, 06:28 PM
Updated : 16 May 2016, 02:02 PM

উচ্চ আদালতের দেওয়া রায়ের প্রেক্ষিতে রোববার বেলা ১১টায় সিলেট সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মীর মো. মাহবুবুর রহমানের নেতৃত্বে এ অভিযান শুরু হয়।

এ সময় তারাপুর চা বাগানের মধ্যে গড়ে ওঠা স্থাপনাগুলো ছাড়া অন্য জমি বাগানটির সেবায়েত পঙ্কজ কুমার গুপ্তকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহবুবুর বলেন, আশির দশকের শেষদিকে জাল দলিল করে ‘প্রায় হাজার কোটি টাকার’ এই দেবোত্তর সম্পত্তি দখলে নেন রাগীব আলী।

গত ১৯ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ছয় মাসের মধ্যে চা বাগানটি দখলমুক্ত করার জন্য জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেয়।

চা বাগান এলাকায় রাগীব আলী নিজের নামে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ ৩৩৭টি প্লট তৈরি করে জমি বিক্রি করে দিয়েছেন। এসব প্লটে গড়ে উঠেছে বহুতল আবাসন ও বিপণী বিতান।

ছয় মাসের মধ্যে এসব স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে বলে জানান মীর মাহবুবুর রহমান।

দেবোত্তর সম্পত্তির সেবায়েত অহিন্দু

১৯১৫ সালের ২ জুলাই বৈকুণ্ঠ চন্দ্র গুপ্ত তার তারাপুর চা বাগানসহ সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি শ্রী শ্রী রাধাকৃষ্ণ জিউড় দেবতার নামে রেজিস্ট্রি দানপত্র করে দলিল করেন। তখন থেকে এলাকাটি দেবোত্তোর সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত।

এর আগে বাগানটি তৎকালীন আসাম প্রদেশের এবং জনসন অ্যান্ড কোম্পানির অধীন ছিল।

বৈকুণ্ঠ চন্দ্র গুপ্তের মৃত্যুর পর রাজেন্দ্র লাল গুপ্ত এ দেবোত্তর সম্পত্তির সেবায়েত হিসেবে নিযুক্ত হন। যুদ্ধের সময়ে রাজেন্দ্র গুপ্ত প্রাণ হারালে তার ছেলে পঙ্কজ কুমার গুপ্ত বাগানটির সেবায়েত হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন।

পরবর্তীতে পঙ্কজ কুমার গুপ্ত ভারত চলে গেলে কথিত পাওয়ার অব অ্যাটর্নি মূলে দেবোত্তর সম্পত্তির সেবায়েত বনে যান দেওয়ান মোস্তাক মজিদ। যিনি রাগীব আলীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়।

একজন অহিন্দুকে দেবোত্তর সম্পত্তির সেবায়েত করা হয় ‘পাওয়ার অব অ্যাটর্নির মাধ্যমে। যার স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন সময়।

পরবর্তীতে এই মোস্তাক মজিদই ভূমি মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব মির্জা ফজলুল করিমের সই জাল করে রাগীব আলীর ছেলে আব্দুল হাইকে ৯৯ বছরের জন্য চা বাগানটি লিজ দেন।

তারাপুর চা বাগান উদ্ধারে গঠিত সংসদীয় তদন্ত কমিটিকে ফজলুল করিম বলেন, আদেশের কপিতে যে স্বাক্ষর করা হয়েছে তা তিনি করেননি।

পুরো বিষয়টি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে করা হয়েছে বলে কমিটি বলেন তিনি।

সংসদীয় কমিটির সুপারিশ

১৯৯৯ সালের ২৫ অগাস্ট ভূমি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে তারাপুর চা বাগান নিয়ে বিশেষ আলোচনা ও কয়েকটি সিদ্ধান্ত হয়।

কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক তৎকালীন সাংসদ মুজিবুর রহমান তালুকদারকে আহ্বায়ক এবং শেখ রাজ্জাক আলী, এনামুল হক, আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী ও কবির হোসেনকে সদস্য করে পাঁচ সদস্যের উপ-কমিটি করা হয়।

এ কমিটি চা বাগানের ৪৪৪ একর ভূমি উল্লেখ করে জানায়, এ ভূমি হস্তান্তর অযোগ্য। এই দেবোত্তর সম্পত্তি বিতর্কিতভাবে হস্তান্তর করা হয়েছে এবং এই হস্তাস্তর বৈধ নয়। দখলকারীর মালিকানা অর্জনের কোনো ভিত্তি নেই।

বাগানের কিছু অংশ অধিগ্রহণের পর দেবোত্তর সম্পত্তির ক্ষতিপূরণ বাবদ ৩০ লাখ ৭৬ হাজার ১৮৯ টাকা কোনোভাবেই রাগীব আলী ভোগ করতে পারেন না বলে মন্তব্য করে উপ-কমিটি।

পরিদর্শন শেষে এই কমিটি যত দ্রুত সম্ভব তারাপুর চা বাগানটি ওই চক্রের কবল থেকে উদ্ধারের সুপারিশ করে।

স্পর্শকাতর বিধায় রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ ও মসজিদের ব্যাপারে স্থিতাবস্থা চেয়ে পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন করে স্থায়ী ও বৈধভাবে তা প্রতিষ্ঠা করার সুপারিশও করে তারা।

উপ-কমিটি চূড়ান্ত সুপারিশে তারাপুর চা বাগান অবৈধভাবে জালিয়াতির মাধ্যমে দলিলপত্র সৃষ্টি করে প্রতারণামূলকভাবে লিজি হিসেবে দখলে রাখার জন্য রাগীব আলীর বিরুদ্ধে অবিলম্বে ফৌজদারী ও দেওয়ানী উভয়বিধ মামলা করতে বলে।

রাগীব আলীর আত্মসাৎকৃত টাকা উদ্ধার ও রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ, মদন মোহন কলেজের ক্যাম্পাসের নাম পরিবর্তন করে একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠনের মাধ্যমে পরিচালনার ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় প্রদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশও করে এই কমিটি।

প্রতারণা মামলা

২০০৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর প্রতারণার মাধ্যমে হাজার কোটি টাকার ভূ-সম্পত্তি আত্মসাতের অভিযোগে কোতোয়ালি থানায় রাগীব আলীর বিরুদ্ধে মামলা করেন সিলেট সদরের তৎকালীন ভূমি কমিশনার এসএম আব্দুল হাই।

মামলায় বলা হয়, রাগীব আলী তার নিজের স্বার্থে পরিবারের সদস্য ও নিকটাত্মীয়দের নামে জাল আমমোক্তারনামা তৈরি করেছেন। তিনি তারাপুর চা বাগান আত্মসাৎ করার জন্য জাল অনুমতিপত্র এবং সন্দেহজনক আমমোক্তারনামার বলে নিজের লোক দিয়ে আব্দুল হাই’র নামে বিক্রি রেজিস্ট্রেশন করে নিয়েছেন।

মামলায় রাগীব আলীর স্ত্রী প্রয়াত রাবেয়া খাতুন চৌধুরী, পুত্র আব্দুল হাই, কন্যা রেজিনা কাদির, জামাতা আব্দুল কাদির, ঘনিষ্ঠ আত্মীয় দেওয়ান আব্দুল মজিদ ও সেবায়েত পঙ্কজ কুমার গুপ্তকে আসামি করা হয়।

পরবর্তীতে এক রিট আবেদনে হাই কোর্টের নির্দেশে এই প্রতারণা মামলা স্থগিত হয়।

প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ গত ১৯ জানুয়ারি মামলাটি পুনরায় চালুর নির্দেশ দেয়।

রায়ে তারাপুর চা বাগানে নির্মিত সব অবকাঠামো ৬ মাসের মধ্যে অপসারণ করে সে জায়গায় চা বাগান করার আদেশ দেওয়া হয়।

রিট আবেদনকারীরা তা করতে ব্যর্থ হলে পুলিশ ও সিটি কর্পোরেশনের সহায়তা নিয়ে স্থাপনা অপসারণের কথাও উল্লেখ করা হয় রায়ে।

এতে ব্যয় হওয়া অর্থ জেলা প্রশাসক রিট আবেদনকারীদের কাছ থেকে গ্রহণ করবেন বলেও উল্লেখ করা হয়।

রায়ে বলা হয়, জেলা প্রশাসক আপিল বিভাগের আদেশগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না- তা পর্যবেক্ষণ করবেন। রিট আবেদনকারীরা আদেশ না মানলে তিনি আইনগত ব্যবস্থা নেবেন।

রাগীব আলী কর্তৃক সরকারের থেকে ক্ষতিপূরণ বাবদ ৩০ লাখ ৭৬ হাজার ১৮৯ টাকা উত্তোলনকে অবৈধ ঘোষণা করে আদেশ পাওয়ার সাতদিনের মধ্যে তা দেবীর নামে নির্ধারিত একাউন্টে জমার নির্দেশও দেওয়া হয়।