দোভিলের সাগর ভ্রমণ ও উপরি পাওনা ট্রোভিল

গত মাসে সমুদ্র দর্শনে ফ্রান্সের দক্ষিণের শহর দোভিলে গিয়েছিলাম। তাও মাত্র ত্রিশ টাকা চাঁদা দিয়ে।

মোয়াজ্জেম হোসেন তারা, ফ্রান্স থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 August 2017, 04:44 AM
Updated : 16 August 2017, 04:44 AM

ফ্রেঞ্চ-বাংলা স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ও বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদ ফ্রান্সের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা মো.জামিলুর ইসলাম মিয়া আঙ্কেল। তার আমন্ত্রণেই গত ২৩ জুলাই স্কুলের শিক্ষার্থী, অভিভাবক, মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদ ও তাদের শুভাকাঙ্ক্ষীসহ আমরা মোট ১০৯ জন সদস্য বেড়াতে গিয়েছিলাম।

আমরা  দুই ভাগে ভাগ হয়ে লাকুরনভ ওবারভিলা মেয়র কার্যালয়ের সামনে থেকে দোভিলের পথে রওয়ানা হলাম। নির্ধারিত সময়ে বাস ছাড়ার পরিবর্তে প্রায় ঘণ্টা দেড়েক পরে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বাস ছাড়লো।

বোধহয় দেশিয় ঐতিহ্য বজায় রাখার জন্যই এই দেরি করা। কারণ, নির্দিষ্ট সময় থাকার পরেও বাচ্চা-কাচ্চাসহ প্রায় আট সদস্যের দুইটা পরিবার সময়মত এসে পৌঁছতে দেরি করছে। আর শ’খানেক লোক বাসে বসে উসখুস করছে আর তাদের পিণ্ডি চটকাচ্ছে।

যাহোক, বাসে ওঠার আগে মেয়র অফিসের সামনে খোলা চত্বরে বেশ কয়েকটা গ্রুপ ছবি তোলার পরে বাস নির্দিষ্ট গন্তব্যে যাত্রা শুরু করল। বাসে উঠেই মাইক্রোফোন নিয়ে বকবকানির দায়িত্ব পড়ে গেল অধমের কাঁধে। বাসের সবাইকে ভ্রমণ সংক্রান্ত সংক্ষিপ্ত বক্তব্য পেশ করার পর পাঁচমিশেলি আয়োজন, অর্থাৎ কৌতুক, গান, ছড়া, কবিতা ও মজার মজার ঘটনাদির আলাপন শুরু হয়ে গেল।

একে একে সবাইকে বাসের সামনে এসে তাদের পরিচিতি তুলে ধরতে আমন্ত্রণ জানানো হলো। দেখা গেল মাইক্রোফোনের সামনে নিজের পরিচয় দিতে একেকজনের চোখে-মুখে রাজ্যের হতাশা এসে ভর করছে। কয়েকজন তাদের পরিচয় দিলেও বেশিরভাগ নিজেদের অপারগতা প্রকাশ করে নিবৃত্ত হলেন।

গান বা কৌতুক বলার জন্য যখন একেকজনকে ডাকা হচ্ছে, তখন সবাই মাথা নিচু করে মুখ লুকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে দেখে হতাশ হতে হলো। মনে হচ্ছিলো, এ যাত্রাটা একঘেয়েমি হতে যাচ্ছে। কিন্তু বাসের একেবারে পেছন দিক থেকে একজন ভাবী স্ব-আগ্রহে এসে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে গাইতে শুরু করলেন।

এরপর একে একে বেশ কয়েকজন গান, কৌতুক, গল্প ইত্যাদি বলে ভ্রমণকে আনন্দে মাতিয়ে তুললেন। এর মধ্যে সহযাত্রী মুক্তিযোদ্ধা ফরহাদ হোসেন তার যুদ্ধকালীন স্মৃতি বর্ণনা করলেন এবং যুদ্ধের ভয়াবহতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতার ইতিহাসের সাথে সহযোদ্ধা ও বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করলেন।

প্রায় ঘণ্টা দেড়েক বাস চলার পর হাইওয়ের পাশে নির্দিষ্ট পয়েন্টে বাস দাঁড়ালো সকালের নাস্তা খাওয়ার জন্য। ততক্ষণে ক্ষুধায় সবার পেট চোঁ চোঁ করছে। কলা, ক্রুয়চোন, ছোট এক বোতল পানি ও ফলের জুস দিয়ে নাস্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

আধাঘণ্টার যাত্রা বিরতি শেষে আবার হৈ-হুল্লোড় করে যে যার আসনে বসে পড়লাম। উপস্থাপনার মাঝে মাঝে ফ্রান্স মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদ কী উদ্দেশ্যে ফ্রেঞ্চ-বাংলা স্কুল স্থাপন করেছে তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা চলছিল। এছাড়া ৫২'র ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও দেশের ইতিহাস ছোট বাচ্চাদের সামনে তুলে ধরছিলাম, যাতে প্রবাসে জন্ম নেওয়া নতুন প্রজন্ম দেশের জন্ম ইতিহাস জানতে পারে।

মধ্য দুপুরে বাস যখন দোভিলে পৌঁছল, তখন আবহাওয়া তার গতিপথ পরিবর্তন করে ঠাণ্ডা বাতাসের সাথে সাথে মুষলধারায় বৃষ্টি হয়ে আছড়ে পড়তে শুরু করেছে। এটা দেখে সবার মন খারাপ হয়ে গেল। প্রায় আধঘণ্টা বৃষ্টিতে আটকা থেকে বাসের মধ্যে বসে সবাই আবহাওয়ার পিণ্ডি চটকাতে শুরু করতে থাকলো।

বৃষ্টি থেমে গেল। এবার হুড়মুড় করে বাস থেকে নামতে নামতেই আকাশে চমৎকার রৌদ্রছায়া হাজির হয়ে গেল, যা দেখে সবাই খুশি হয়ে উঠলো। বাস থেকে নামার পর প্যারিস থেকে নিয়ে আসা খাবারগুলো নামিয়ে একটা জায়গা খোজা শুরু হলো খাওয়ার জন্য।

এর মধ্যে পুলিশ এসে বাঁধা দিল। জানালো- এখানে খাবার খাওয়া যাবে না। তাই বাধ্য হয়ে আরেকটু দূরে একটা জায়গায় একত্রিত হলাম। এবারও পুলিশি বাগড়া! কারণ, সমুদ্রপাড়ে এভাবে যেখানে সেখানে খাওয়া নিষেধ। তিন-চারটে জায়গা বদল শেষে পুলিশ মহোদয় দেখিয়ে দিলেন যে সাগরের একেবারে পাড়ে, বালুচরে চারটে পতাকাবাহী পাইপের মধ্য খালি জায়গায় খেতে হবে!

বাধ্য হয়ে বালুর ভেতর দাঁড়িয়ে সমুদ্রের পানির আছড়ে পড়া শব্দ শুনতে শুনতে খেতে শুরু করে দিলাম। মুরগির কাবাব, গলদা চিংড়ী, ছাগলের মাংস, লেবু সালাদসহ আরও বেশ কিছু আইটেম দিয়ে সাদা ভাত দিয়ে উদরপূর্তি করলাম। সেইসাথে দুয়েকটা বালি চিবানোরও নতুন এক অভিজ্ঞতার সঞ্চয় হলো।

খাওয়া শেষে সবাই সাগরজলে গা ভেজানোর প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেও আমি ও এক বড় ভাই সংগঠক লিটন হাসান ভাইকে নিয়ে দোভিল শহরের দিকে রওয়ানা দিলাম। কারণ আগেরবার এসে সমুদ্রজলে সাড়ে তিন ঘণ্টার মতো কাটিয়ে ঠিক মতো শহরটা দেখতে পারিনি। তাই এবার পুরাতন কারুকাযে ভরা নান্দনিক ধাঁচে গড়া শহরতলী ঘুরে দেখবার মনোবাসনা পূর্ণ করতে ছুটলাম।

শহরে ঢুকেই একটা কফি বারে গেলাম। দুটো কফি অর্ডার দিয়ে বিল দিতে গিয়ে একটা লটারি টিকিট কিনে ফেললাম। টিকিট ঘষে দেখি বেশকিছু নগদ টাকা পেয়ে গেছি। বেড়াতে গিয়ে হঠাৎ কিছু টাকা হাতে চলে আসলে বেশ মজাই লাগে।

কফি খেয়ে সেখান থেকে দুইজনই হাসিমুখে বের হয়ে শহরটা ঘুরতে ঘুরতে পার্শ্ববর্তী পাহাড় ঘেরা বাড়িগুলোর দিকে রওয়ানা হলাম। ছোট একটা স্রোতবাহী লেক পার হলেই সেখানে যাওয়া যায়। সেদিকে যেতে গিয়ে দেখি, মোটরচালিত বোটে করে সবাই পার হচ্ছে। নির্দিষ্ট ঘাটে গিয়ে দেখি সেটা আরেকটা শহর এবং তার নাম ট্রোভিল যা দোভিলের সাথে মিলিয়ে নামকরণ করা হয়েছে।

একেকজন দেড় ইউরো করে ভাড়া দিয়ে বোটে চেপে পার হলাম আরেক নতুন শহর দেখতে। মনে পড়ে গেল, আমাদের দেশে নৌকায় করে নদী পার হয়ে মাঝিকে ভাড়া পরিশোধ করার কথা। যদিও দোভিলের সমুদ্রকূল আর ট্রোভিলের সমুদ্রপাড় একই সাথে বিদ্যমান!

শহরে প্রবেশ করেই একটা সুপারশপে ঢুকে চাহিদামত পানি আর বাদাম কিনে সাগরপাড়ে বসে পড়লাম। ইতোমধ্যে আমরা সহযাত্রীদের থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি। আর আমার মোবাইলে চার্জ শেষ হয়ে যাওয়ায় একেবারে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।

তবুও ভরসা বলতে সাড়ে ৭টায় বাস ছাড়বে আর আমরা নির্দিষ্ট সময়মত পৌঁছে গেলেই হবে। আর  তাও না হলে তো ট্রেনে চেপে প্যারিস যেতে বেগ পেতে হবে না। শুধুমাত্র বাড়তি কিছু টাকা খসবে এই যা। কিন্তু পাহাড় ঘেরা পাদদেশে এমন সৌন্দর্য কাছ থেকে না দেখে ছেড়ে যাওয়া অনুচিত হবে।

যাহোক, এবার আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের ডালপালা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আলাপ আলোচনা করলাম। জানতে পারলাম তিনি রাশিয়ায় পড়াশোনা করে ইউরোপে অভিবাসী হয়েছেন। ছাত্রজীবনে ছাত্র ইউনিয়ন করেছেন কিন্তু প্যারিসে এসে সেই দলের কার্যক্রমে হতাশ হয়ে দল থেকে নিবৃত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক হওয়ায় তার সম্পর্কে আগেই জানতাম, কিন্তু আজকে অনেককিছু জেনে বেশ ভাল লাগলো।

একসাথে সারাবেলা ঘোরাঘুরি শেষে নির্দিষ্ট সময়ে বাসের জন্য নির্ধারিত জায়গায় হাজির হওয়ার তাগিদ থাকায় আবার ফিরতি পথে রওয়ানা হলাম। এবার দেখি ভাটা শুরু হওয়ায় বোটের বদলে সেখানে দশ হাত লম্বা কাঠের ব্রিজ আর নদীর তলদেশ দিয়ে পায়ে হাঁটার পাকা রাস্তা। তাই ব্রিজ পার হতে জনপ্রতি পঞ্চাশ সেন্টিম (পয়সা) ট্যাক্স দিতে হবে। পয়সা দেওয়াতে যতটুকু না বিস্মিত হয়েছি, তারচেয়ে বিস্মিত হলাম কাদাজলের ভাঁজে ভাঁজে জীবিত মাছ পড়ে আছে আর গাঙচিল মহাসুখে ডাকাডাকি করে সেই মাছ ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছে দেখে।

আমরা সেই খাওয়ার দৃশ্য ধারণ করে পাশেই একটি ছিমছাম আভিজাত্যে মোড়ানো একটা রেস্তরাঁয় ঢুকলাম। পেটে ক্ষুধা না থাকলেও দু'কাপ কফির অর্ডার দিয়ে ক্লান্ত শরীর নিয়ে আয়েশ করে বসলাম। কারণ তখনও হাতে আধঘণ্টার মতো সময় আছে। কফিতে চুমুক শেষ হলে বিল দিতে গিয়ে দেখলাম, কফিবারে গেলে অন্তত আরও তিনকাপ কফি খাওয়া যেত।

যাহোক, বিল চুকিয়ে বাইরে এসে দেখি সকলে বাসের জন্য অপেক্ষা করছে। আর আমরাও তাদের সাথে যোগ হওয়ার মিনিট দশেক পরে বাস আসলো। হুড়মুড় করে বাসে উঠে বসলাম আমরা। সারাদিন ভ্রমণ শেষে ক্লান্ত শরীর নিয়ে তাড়াতাড়ি নীড়ে ফেরার তাগিদ যেন সবার একমাত্র উদ্দেশ্য।

যাত্রা শেষের ঘোষণা দিয়ে বাস প্যারিসের পথে রওয়ানা দিলে আবার মাইক্রোফোন নিয়ে হৈ-হুল্লোড় শুরু হয়ে গেল। তানিয়া নাজনীন, ফরহাদ হোসেন, তুহিনা আক্তার রিমা, মৌমিতা, শওকত, জুয়েলসহ আরও অনেকে গান, কৌতুক ও মুর্শিদী গানে আসর জমিয়ে তুললো।

পরিচিত-অপরিচিত সবাই যেন জড়তার সব বাঁধা ভুলে একখণ্ড বাঙালি পরিবার হয়ে গেছে। এরমধ্যে রাতের খাবারের জন্য বাস দাঁড়ালো। সবাই লাইন ধরে কেনা রুটি, মুগডাল ও ছাগলের মাংস দিয়ে উদরপূর্তি শেষে বড় বড় রসালো মিষ্টি স্বাদের তরমুজ খেয়ে ঢেকুর তুলতে তুলতে বাসে চেপে বসলাম।

আমাদের পিছে পড়ে রইলো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যরূপে অতুলনীয় ফ্রান্সের সাগরকন্যা খ্যাত দোভিল। আর উপরি পাওয়া পাহাড় ঘেরা ট্রোভিলের মোহনীয় হাতছানি।

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!