যাচাই করে বিদেশে আসুন

আমাকে অনেকে নানান কথা বলেন। আমি নাকি শ্রমিকদের কাজের কথা লিখে মানহানি করি। আসলে আমি চাই সচেতন করতে, বিদেশের ভূত মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে কষ্ট হলেও নিজ দেশে স্বাবলম্বী হতে।

জাহাঙ্গীর বাবু, সিঙ্গাপুর থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 April 2017, 04:06 AM
Updated : 9 April 2017, 04:06 AM

নীল টুপি, ডিগ্রি পাশ। বিদেশে এসে রিগার, সিগন্যাল-ম্যান, স্ক্যাফোল্ডার, সেফটি সুপারভাইজার, ওয়্যার্ক অ্যাট হাইট সুপার ভাইজার, স্কাফোল্ড সুপারভাইজার, সেফটি কোর্ডিনেটর সার্টিফিকেটধারী, সকালে টুল বক্স মিটিং থেকে পেপার ওয়ার্ক, পারমিট- এমন কোন কাজ নেই করছে না। দেশে বর্তমানে এই রকম ভুরি ভুরি সার্টিফিকেটধারী বিদেশ ফেরৎ বসে আছে, বেকার প্রায় ৩৫ হাজার। শিপ ইয়ার্ড বন্ধ হচ্ছে, বিল্ডিং-এর কাজ কমে যাচ্ছে। তার পরও নতুনরা আসতে চাচ্ছে।

ট্রেনিং স্কুলে ভর্তি হতেই সাড়ে ৩ লাখ টাকা, এখানে আসা পর্যন্ত ১০-১২ লাখ। বেতন দিনে ১৮ ডলার। মাসে সত্তর থেকে একশ ডলার বাসা ভাড়া কেটে নেবে। কাগজে বেশি লেখা থাকবে সেলারির অংক। মার্কেট ডাউন, অনেক কোম্পানি নিরুপায়।

পুরাতনরা আসতে চাইলে লাগছে ৫ লাখের বেশি। পারমিট ১১ মাসের। যারা একবার আসে, তাদের বার বার আসতে হচ্ছে। দেশে সেটেল হতে পারছে না।

প্রায় ইনবক্সে প্রশ্ন আসে, কীভাবে আসা যায়? পুরাতনরাও দেশে থেকে বলে, যে কোনভাবে যেতে হবে, নিয়ে যান। এসেই গণ্ডগোল! বেতন কম, কঠিন কাজ। টাকা ফেরৎ চাই। এটা এখন সেরাঙ্গুনের নিত্য ঘটনা। সাপ্লাই কোম্পানি ছাড়া ডিমান্ডও থাকে না। আগে যারা ৪-৫ হাজার ডলার মাসে আয় করতো, এখন আঠারো ডলারের কাজ করছে।  

সিঙ্গাপুর আসতে নতুন-পুরাতন সাবধান। মিনিস্ট্রি অব ম্যান পাওয়ার কাগজে-কলমে আইন-কানুনে, বাস্তবেও স্বচ্ছ। কোম্পানিগুলোও তাদের ডকুমেন্টে পাকা। আপনি-আমি ইচ্ছে করেই আসছি। জেনে-শুনেই আসছি। আর এখানে এসে পরিবেশ নষ্ট করছি।

ওই যে পাশের বাড়ির আবুলের ছেলে বাবুল বাড়ি করেছে, ব্যবসা করছে, শুধু আমার ছেলে বেকার। আরে, সবাই আবুল বা বাবুল না, হাতের পাঁচ আঙ্গুল এক সমান না। ক্লাসের সবাই কি ডাক্তার- ইঞ্জিনিয়ার হচ্ছে? বিদেশের লাগেজগুলো দেখেই বিদেশে আসার চিন্তা করা কি ঠিক? না খেয়ে মরলে দেশে মরেন, বাবা- মায়ের কিংবা আপনার আসার জন্য ৮-১০ লাখ আর মূল্যবান সময় বাঁচবে। 

আমরা নিজেরা নিজেদের কৃতদাস ভাবি। ভাবতে বাধ্য হচ্ছি। একটা ছেলে বিদেশে আসতে চাইলে লাখ লাখ টাকা ধার দিচ্ছি। দেশে কিছু করতে এক টাকাও দিচ্ছি না। দেশে থেকে জীবন থেকে শিখতে দিচ্ছি না। বিদেশে কিছু লোক ভালোও থাকে। পরিবার নিয়ে থাকে। খবর নিলে জানা যায়, তার বিশাল কষ্টের ইতিহাস।

যাক, বিদেশে আসবেন আসুন। শতকরা পঞ্চাশ ভাগ ভালো থাকলে বাকি পঞ্চাশের অবস্থা খারাপ। সেই খারাপে আপনার নাম থাকলে আপনি ভুক্তভোগী। ফেসবুকের হাসিমাখা ছবি, আলো ঝলমলে ব্যাকগ্রাউন্ডের ছবি দেখে বিদেশের শ্রমিক হবেন না।

নোয়াখালি কবির হাটের একজন, দেশে তার দুইটা দোকান, উনি এসেছেন। এখন বলছেন, প্রতিদিন কানে ধরছেন। আগামী মাসেই চলে যাবেন। ফাঁকে থেকে ১০ লাখ আর এক বছর বরবাদ। সাদা রসগোল্লার মতো ফেসবুক প্রোফাইল দেশে তোলা ছবির মুখ এখন ঢেকে রাখেন।

প্রবাসে ভালো আছেন যারা আছেন, যারা নেই কষ্টে আছেন। যারা আসবেন, বুঝে-শুনে-ভেবে চিন্তে আসবেন। বিনিয়োগ আর লভ্যাংশ ভেবে আসবেন। ভিসা মানে আইপি হচ্ছে, রিজেক্ট হচ্ছে। টাকার অঙ্কও বাড়ছে। হাফ পেমেন্টের পর আইপি ক্যান্সেলের ব্যবসাও চলছে। বার বার বলি, একবার দেশ ছাড়ে যে, মাতৃভূমি তাকে পর করে।

অতএব, ১১ মাসের পারমিট, ষোল থেকে আঠার ডলার বেতন পার ডে, ৮-১২ লাখ খরচ করে আসা, ইউ-টার্ন হলে কমপক্ষে ৫ লাখ খরচ! এটা চিকিৎসা বা ঘুরাঘুরির জন্য আসা নয়। ব্যবসা, ঘুষ, রাজনীতির অর্থের শ্রাদ্ধ করা নয়। ভিটে, জমি, সুদের টাকা। বাবা-মা ভাই, আত্মীয়-স্বজনের টাকা। কষ্ট দেহের। আসবেন, আসুন। সব কাজ করার মানসিকতা রাখুন।

বিদেশের মজা নিন। ইচ্ছামতো গালি দিন আমাকে। বিভিন্ন সভা, সেমিনার, পত্রিকা, ফেসবুক স্টেটাসে বলি, লিখি- আমি ভুল করেছি, আপনারা করবেন না। সে ভুল করেছে, আপনি করবেন না।

সিঙ্গাপুর সত্যি একটি সুন্দর নিয়মের দেশ, শান্তির দেশ। তবে তা এ দেশিয়দের জন্য, যাদের অনেক টাকা তাদের জন্য। শ্রমিকদের কিছু অংশ ভালো আছে। বাকি যারা জানে, তারাই জানে।

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি

এই লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!