বাস্তবিকই ব্যাপারটা তাই। এখানকার সেকেন্ড-হ্যান্ড শপগুলোতে গেলেই এর প্রমাণ মেলে। রেডক্রস চালিত কিছু সেকেন্ড-হ্যান্ড শপ আছে, যেখানে এখানকার অধিবাসীরা তাদের ব্যবহৃত পোশাক, তৈজসপত্র, খেলনা, আসবাবপত্র- এসব দোকানে দান করে দেন। এসবের বিক্রি করা অর্থ মানবকল্যাণে ব্যয় হয়।
সব সূচকে সবচেয়ে উন্নত দেশগুলোর মধ্যে ডেনমার্ক একটি। ক্ষুদ্র একটি রাষ্ট্র অত্যন্ত মজবুত অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এর অন্যতম কারণ আমার কাছে মনে হয়েছে, এরা অত্যন্ত হিসেবি ও পরিকল্পনা অনুযায়ী চলে। এক ফোঁটা জলও হিসেব করে খরচ করে এরা।
কোথাও পড়েছি বা শুনেছি, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধর মত কোন ভয়াবহ ঘটনা ঘটলে তা মিঠা পানির দখলদারিত্বের জন্য ঘটবে। শিপ বিল্ডিং ছাড়া বড় কোন শিল্প-কারখানা নেই, দুগ্ধজাত পণ্য, কৃষি, কর, নকশা প্রণয়ন- এদের আয়ের অন্যতম উৎস। প্রতিটি নাগরিক গুণে গুণে কর পরিশোধ করেন। কর ফাঁকি দেন শুধু বহিরাগতরা, বিশেষ করে এশিয়ানরা।
একটি বিশেষ ব্যবস্থার কারণে এদেশে কর্মহীন বা কর্মবিমুখ লোকজনদের না খেয়ে- না পড়ে থাকতে হয় না। বৃদ্ধদের কিছু বাড়তি টাকার প্রয়োজন হয়,শিশুদের মিউজিক সিডি, খেলনা, চকোলেট ইত্যাদি কেনার প্রয়োজন হয়। এ বিশেষ ব্যবস্থার ফলে তারা তাদের এ প্রয়োজনগুলো মেটাতে পারে।
ডেনমার্কসহ স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলোতে এ ব্যবস্থা প্রচলিত। স্ক্যান্ডিনেভিয়ার কয়েকটি দেশের জনগণ প্রচুর বিয়ার পান করে, বিশেষ করে ডেনমার্কে বিয়ার পানের প্রচলন অত্যধিক। বিয়ারের ক্যান, বোতল ময়লার বিনসহ যত্রতত্র পড়ে থাকে। এতে বেকার লোকদের কিছু আয়ের পথ তৈরি হয়, অন্যদিকে আবর্জনা পরিষ্কার সর্বোপরি আবর্জনার পুনঃব্যবহারও নিশ্চিত হয়।
ধরুন, আপনি পেট বোতলে আমাদের দেশের মামের মতো আধা লিটারের এক বোতল পানি কিনেছেন। এখন এই প্লাস্টিক বোতলের জন্য দোকানদার আপনার কাছ থেকে অতিরিক্ত দেড় ক্রোনার বেশি নেবে (এক ক্রোনার সমান বাংলাদেশি প্রায় ১১ টাকা)। এভাবে দেড়-দুই লিটারের কোক বা পেপসি বোতলের জন্য তিন ক্রোনার (৩৩ টাকা ), বিয়ারের টিনের ক্যান বা বোতলের জন্য এক ক্রোনার বেশি নেবে। এবার আপনি আপনার পানি পান করার পর প্লাস্টিক বোতলটি দোকানদারকে ফেরত দিলে আপনার দেড় ক্রোনার ফেরত পাবেন।
পানির বোতলের ক্ষেত্রে যা হয়, অনেকেই পানি পান করার পর তা সংরক্ষণ করেন। অনেকগুলো বোতল হলে তা দোকানে ফেরত দিয়ে ওই টাকার সওদাপাতি কেনেন বা নগদ টাকা নেন। আবার অনেকেই বোতলটি বিনে বা বিনের পাশে যত্ন করে রেখে দেন। যিনি রাখেন তিনি জানেন, কেউ না কেউ বোতলটি তুলে নেবে।
দোকানে বোতলটি ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়াটি বেশ আধুনিক। প্রতিটি সুপার শপে একটি করে মেশিন বসানো থাকে। মেশিনে বোতলটি দেওয়ার পর মেশিন স্বয়ংক্রিয়ভাবে বোতলের লেবেলের বার কোড রিড করে এর মূল্য নির্ধারণ করে।
প্লাস্টিকের বোতল, কাচের বোতল ও ক্যান আলাদা আলাদা প্রকোষ্ঠে জমা করে। অনেক বোতল জমা হলে শপ কোম্পানি এসব বোতল পুনঃপ্রক্রিয়ার জন্য পাঠায়। সব বোতল বা ক্যান মেশিনে দেওয়ার পর নীল বোতামে চাপ দিলে মোট মূল্যের রশিদ বেরিয়ে আসবে। আর লাল বোতামে চাপ দিলে টাকাটা আফ্রিকার সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের কল্যাণে গঠিত ফান্ডে জমা হয়ে যাবে। অর্থাৎ টাকাটা আপনি দান করলেন।
এবার রশিদ নিয়ে ক্যাশ কাউন্টারে গেলে আপনার বোতলের মূল্য পরিশোধ করবে। চাইলে ওই পরিমাণ টাকার কেনাকাটাও করতে পারেন আপনি। জিনিসপত্রের দাম বেশি হলে অতিরিক্ত টাকা পরিশোধ করবেন, কম হলে বাকি টাকা ফেরত পাবেন।
বাস্তবতা হলো, অনেকেই পানির বোতল সংরক্ষণ করলেও বিয়ারের ক্যান বা বোতল সংরক্ষণ করে না। বিয়ার পানের পর খালি ক্যান থেকে স্টার্চের বাজে গন্ধ হয়। তাই বিয়ারের ক্যান বিনে ফেলে দেন বা যেখানে বসে পান করেন, সেখানে স্তুপ করে রেখে দেন।
সামারের দিনগুলো হয় দীর্ঘ এবং আবহাওয়া থাকে অনুকুলে। বিশেষ করে সাপ্তাহান্তের দিনগুলিতে প্রচুর লোকজন পার্কে, খোলা মাঠে, রাস্তার পাশে বসে পান করে। এ সময় অনেক মেলা ও কনসার্টের আয়োজন হয়। প্রচুর বিয়ারের ক্যান, পানির বোতল বিনে, মাঠে, ফুটপাতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে।
পহেলা মে এক কনসার্টে বাংলাদেশি মুদ্রায় কোটি টাকার ক্যান সংগৃহীত হয়। মে-জুন মাসে সাত দিনব্যাপী এক (রস্কিল ফেস্টিভ্যাল ) মিউজিক ফ্যাস্টিভেল হয়। সারা ইউরোপ থেকে লোকজন জড়ো হয় এই মেলায়। এসব ক্যান কুড়ানোর জন্যও অনেক লোক তৎপর থাকে।
অভিবাসীদের সংখ্যা যখন এত বেশি ছিল না, তখন স্থানীয়রা এসব ক্যান সংগ্রহ করতো। বিশেষ করে একটু বয়স্ক এবং শিশুরা। দিনে দিনে অভিবাসীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ফলে স্থানীয়রা পিছু হটে যায়। সামারে পূর্ব ইউরোপ থেকে শত শত লোকজন আসে ক্যান সংগ্রহ করতে।
রুমানিয়ার একটি যাযাবর জাতিগোষ্ঠী আছে যারা ফুটপাতে রাত কাটায়। সামারেও রাতের বেলা অনেক সময় চার-পাঁচ ডিগ্রিতে তাপমাত্রা নেমে আসে। এরা ক্যান সংগ্রহ করে, আবার কেউ কেউ রাস্তার পাশে বেহালা, হারমোনিয়াম, গিটার বাজিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। এরা হাজার বছর পূর্বে ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে ইউরোপে পাড়ি জমিয়েছিলো।
কিছু চাইনিজ আছে, মূল ভূখণ্ডের কিনা জানি না, তবে এরা খুব পরিশ্রমী। শীতে মাইনাস তাপমাত্রায় মেট্রো ট্রেনে ক্যান কুড়ায়। এ সময় খুব বেশি ক্যান পাওয়া যায় না। সবাই ঘরেই পান করে। এরা চুরির মতো হীন কাজ করে না, তবে খুব হিসেবি। একটু কৃপণই বলা চলে। এক ঘরে অনেকে গাদাগাদি করে থাকে। দু’জন থাকার মতো একটা রুমের ভাড়া প্রায় ৪০-৪৫ হাজার টাকা, সে রুমে এরা পাঁচ-ছয়জন থাকে।
ইদানিং আফ্রিকার অনেক অভিবাসী ক্যান কুড়ায়। এদের হাতটানের অভ্যাস আছে। তালা লাগানো সাইকেল কাঁধে করে নিয়ে যেতে দেখেছি অনেক আফ্রিকানদের। অভিবাসী না থাকলে এ দেশে সাইকেলে তালা লাগানোর প্রয়োজন পড়তো না।
চুরি ও মিথ্যা বলা এ জাতি থেকে বিদায় নিয়েছে বহু আগে। সব ধরনের চুরি বা পকেট কাটার সাথে জড়িত মরক্কো, তিউনিশিয়া, আলজেরিয়ার লোকজন। বিশেষ করে মরক্কো। মনে হয় এরা সবাই 'আলি বাবা'!
যারা ক্যান কুড়ায়, তাদের স্থানীয়রা খুব সম্মানের চোখে দেখে। তারা মনে করে ক্যান কালেক্টররা অনেক পরিশ্রমের কাজ করে, সেই সাথে পরিবেশের সুরক্ষা করছে। অনেক এশিয়ানদের দেখেছি এটাকে নিয়ে অবজ্ঞাসূচক মন্তব্য করতে। কেন এ মানসিকতা? সে তো চুরি করছে না, বা ভিক্ষা চাচ্ছে না।
অনেকে এ পরিশ্রমের কাজটা সানন্দে করছে কারণ অন্যের অধীনে কাজ না করে সে স্বাধীনভাবে আয় করবে বলে। কিন্তু ইদানিং ক্যান কালেক্টররা বিরক্তিরও কারণ হচ্ছে। বিয়ার পান শেষ হওয়ার পূর্বেই একধিক ক্যান কালেক্টর পানকারীর কাছে যেয়ে ক্যান দেওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করে। অনেক সময় মূল্যবান কিছু পাওয়া গেলে তা যথাযথ অথরিটির কাছে জমা দেয় না।
সর্বোপরি পরিবেশের সুরক্ষা সেই সাথে বেকারদের অন্নসংস্থান-সবকিছু মিলে এটা এক অভিনব পন্থা। সরকার এ ব্যবস্থা তুলে দিতে চেয়েও দেয়নি। প্রত্যেকের কাছ থেকে দুই-চার ক্রোনার যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তার বিনিময়ে অনেক লোকের জীবিকা নির্বাহ হচ্ছে।
এ ব্যবস্থা না থাকলে সরকারকে এসব পরিষ্কারের জন্য অনেক জনবল নিয়োগ দিতে হতো, যা অনেক ব্যয়বহুল। তবে সরকার ক্যান কালেক্ট করে যারা আয় করছে তাদের আয়ের ওপর কর আরোপ করতে যাচ্ছে।
এই প্রসঙ্গে একটি কথা উল্লেখ করা যায়। বেশ কিছুদিন পূর্বে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ক্যান্সার আক্রান্ত এক শিশু তার চিকিৎসার জন্য দেশবাসীর কাছে এক টাকা করে সাহায্য চেয়েছিলো। যতদূর মনে পড়ে, জনগণের স্বতঃস্ফূর্ততায় শিশুটির চিকিৎসার পরও অনেক অর্থ উদ্বৃত্ত হয়েছিলো। যে কোন কিছুই করা সম্ভব যদি থাকে সদিচ্ছা আর সঠিক পরিকল্পনা।