আবুধাবিতে প্রবাস জীবন: শ্রমজীবী মোশাররফের গল্প

প্রতিটি জীবনেরই একটা কাহিনি আছে। সে কাহিনি কখনও কখনও সিনেমাকেও হার মানায়।

জাহাঙ্গীর কবীর বাপপি, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Jan 2017, 12:11 PM
Updated : 7 Jan 2017, 08:36 AM

সে কাহিনি জানতে হলে কাহিনির চরিত্রটির একটু নিবিড় সান্নিধ্যে আসতে হয়। তার প্রতি স্নেহ-সহমর্মিতার মন বাড়িয়ে দিতে হয়,এরপর অবলীলায় জেনে নেওয়া যায় তার জীবনের সাতকাহন। আজ শুনুন এমনি এক প্রবাসীর জীবনের গল্প।

মোশাররফ  হোসেন (২৭) আবুধাবি-প্রবাসী বাংলাদেশের একজন রেমিটেন্স সৈনিক। খালিফা স্ট্রিটের আল নুর হাসপাতালের কাছে একটি লেবানিজ বেকারিতে ক্লিনারের কাজ করেন। বাড়ি চট্টগ্রাম জেলার মিরেরশরাই থানার বারৈরহাটে।

মোশাররফ দৈনিক ১০-১২ ঘণ্টা কাজ করে বেতন পান মাসিক ৭০০ দিরহাম (১৫ হাজার টাকার কিছুটা বেশি)।  অবকাশের একটুও সুযোগ নেই।  সার্বক্ষণিক খাটতে হয়। কারণ ওখানে তার অধঃস্তন কেউ নেই।

মোশাররফ বলেন, “বড় ভাই বিয়া শাদি করি বউ পোলাপাইন লই আলেক (আলাদা) থাকে।”

কেন ‘আলেক’ থাকেন- সে কথায় মোশাররফ বলেন,“ভাই বিয়া শাদি করছেন, কিন্তুক কাম কাজ কিছু করেন না, ৪/৫ মাস আগে আব্বা বাড়িত্তুন বাইর করি দিছে। হেতাইনের তিন পোলাপাইন আর বউরে আমরা  খাওয়াইত হাইত্তাম তবু,কারণ কি  হেতাইন আবার নেশাটেশা করে।

“ফরে আশা ব্যাংক থেকে লোন লই অটোরিকশা নামাইছিল সেইটা ছালাইত। হেইদিন আবার ফোনে কইল,ভাইরে কোমরের ব্যাথা,গাড়ি ছালাইতে পারির না। মার ফেডের ভাইতো,ভাইরে বইল্লাম আপনে ভালাভাবে চইল্লে কষ্ট করি বাইরে ঘরভাড়া দি থাকন লাগে না। আব্বার চা’র দোকানে বসেন,সন্তানদের ভবিষ্যৎ আছে না? ভাই বইল্ল ফ্যামিলির সাথে আলোচনা করি সিদ্ধান্ত নিব।”

মোশাররফের ছোট ভাই মীর হোসেন (২৩) আবুধাবিতেই থাকেন। নির্মাণ  শ্রমিক। বেতন পান এক হাজার দিরহাম (সাড়ে ২১ হাজার টাকা প্রায়)। দুই ভাইয়ের আয়ে সংসারটা  দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল।

দুই বোনের বিয়ে দিলেন,নিজে বিয়ে করলেন,বাবা গ্রামের বাড়িতে একটা চায়ের দোকান দিলেন। সংসারের কাজের ফাঁকে ফাঁকে মা এসে বসতেন ওখানে।

তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছিল মোশাররফদের সংসারের তরী। কিন্তু জীবনতরী তো নিস্পন্দে এগোয় না। কখনো আবার ঝড় ঝাপটায় পড়ে টালমাটাল হয়।

মোশাররফ দীর্ঘশ্বাস চেপে বলেন, “হঠাৎ করি আব্বার ক্যান্সার ধরা পইড়লো। বেদিশা হই গেইলাম। ডাক্তার দেখাইতে ৫০-৬০ হাজার টাকা লাইগলো। ডাক্তার যেই মতে কইল সেই মতে চিকিৎসা কইরলে লাখ লাখ টেকা লাইগবো। কই পামু?এখন বাড়িত শুই আছে অষুদের উপর। সপ্তায় পনেরশ’ টেকার  অষুদ লাগে।”

মোশাররফ আবুধাবিতে কলকাতার এক পরিবারে কাজ করেছেন কিছুদিন ধরে। রান্নাবান্নার কাজ করেন। এ ধরনের কাজকে মোশাররফরা  বলেন ‘টুটকা-কাম’। এই টুটকা কাজ থাকলে যেন একটু হাফ ছেড়ে বাঁচা তাদের।

সাড়ে তিন বছরের আগে বিয়ে করেছেন মোশাররফ। ঘরে বউ আর দুই বছরের কন্যা মায়েশা আক্তার চাঁদনী। চাঁদনী পসর রাতে হয়তো জন্মেছিল সে। মেয়েকে দেখা হয়নি তার।মোবাইলে ছবি দেখেছেন কেবল।

মোশাররফ চোখ ছলছল করে বলেন,“বাড়িথিক্যা মেয়েলোক বইলতেছে আইসবার জইন্ন্য। কিন্তুক ছোড মিয়ারে ফাডান লাইগবো। পাঁচ বছর হেই মিয়া দেশে যায় নাই। আম্মা বইলছেন,দুইজন এক লগে আইসলে তোমরা খাইবা কি?”

মোশাররফ কণ্ঠে পুরুষালি ঋজুতা নিয়ে বলতে থাকেন, “মেয়েলোকের কথায় বাধ্য হই যদি দ্যাশে যাই,ভাই রাগ কইরবো,মা রাগ কইরবো, ওদের সাথে দ্বন্দ্ব হইব। ভাবতেছি পরে যাব। বুঝেন না ৭০০ টাকা (দিরহাম) বেতন ফাই,মোবাইল, খানা,হাত খরচে ৪০০ ছলি যায়।

“টুটকা কাম থাকলে কষ্টমষ্ট করি চলি। নইলে অসুবিধা হয়। মেয়েলোকের কথা শুইনলে ছইলবো!”

আমি জিজ্ঞেস করি, “চাঁদনীকে দেখতে ইচ্ছে করে না?” কথাটা বলতে আমার দিকে অসহায় নির্বাক একনজর দেখলো মোশাররফ। তারপর ঝট করে মাথাটা ঘুরিয়ে নিল দেয়ালের দিকে। 

জানি এখন কী হচ্ছে ওদিকটায়। যা হচ্ছে তা আমাকেও আক্রান্ত করলো পলকে। সাহস হল না ওর দৃষ্টিটা একটু নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিতে।

চুপিসারে ফিরে আসার পথে দেখি,কী যেন পড়েছে ওর চোখে।  শার্টের আস্তিন দিয়ে তা সরানোর প্রাণান্ত চেষ্টা চলছে। এমন  সময় নাকি মানুষকে একা থাকতে দিতে হয়।

লেখক: আবুধাবি প্রবাসী সংবাদকর্মী

এই লেখকের আরও লেখা:

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা, আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!